Monday, April 13, 2020

দেবাঙ্কুর কুন্ডু-র গল্প





জন্ম, মৃত্যু আর সন্ত্রাস

 "তিতলি, ও তিতলি। বলি তোর নীল জ্যাকেটটা নিয়েছিস তো? ওখানে কিন্তু খুব ঠান্ডা পড়ে ।"প্রতিমাদেবীর গলায় উদ্বেগের স্বর স্পষ্ট ।
-" ওহ্ মম,অত টেনশন নিও না। আমি সব ঠিকঠাক গুছিয়ে নিয়েছি। " তিতলি হাসিমুখে মায়ের সামনে এসে দাঁড়ালো।    
   প্রতিমাদেবীর চোখ ছল ছল করে উঠলো। ধরা গলায় বললেন ," সাবধানে যাস মা। ফোন করবি কিন্তু প্রতিদিন।"   
   তিতলি হাসল, "মাত্র এক মাসই তো। দেখতে দেখতে কেটে যাবে। " তিতলি জড়িয়ে ধরল মাকে। প্রতিমা দেবী ওর কপালে চুমু খেলেন। তিতলি বেরিয়ে গেল। ওর মালপত্র আগেই গাড়িতে তোলা হয়ে গেছে। 
-"বাই মম" গাড়িতে উঠে হাত নাড়ল তিতলি। 
    প্রতিমাদেবীও হাত নাড়লেন।অস্পষ্ট স্বরে বললেন, "দুর্গা দুর্গা "। তিতলির বাবা ওকে এয়ারপোর্টে ছেড়ে দিয়ে আসতে গেলেন। তিনিও যেতেন, কিন্তু ইদানিং বাতের ব্যথায় হাঁটতে কষ্ট হয় । সেই ছোট্ট তিতলি এখন সাতাশ বছরের যুবতী। ওদের কোম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভ আমেরিকায় গেল।
   প্রতিমাদেবী হাসলেন ,কিন্তু পরক্ষণেই তাঁর মুখের ওপর নেমে এলো একটা বিষাদের ছায়া। তিতলির ছোট বেলার কথা ভাবলে আজও মনে পড়ে সাতাশ বছর আগের সেই ভয়ঙ্কর দিনটাকে। 

                                *************

   দিল্লিতে কোম্পানির কাজ সেরে হাওড়াগামী ট্রেনে চড়ে বসলেন অনিমেষবাবু, সঙ্গে তার স্ত্রী প্রতিমাদেবী। দীর্ঘ নয় বছরের দাম্পত্য জীবনেও সন্তান না হওয়ায় প্রতিমাদেবী খুবই দুঃখিত,সব সময় কেমন যেন উদাসীন থাকেন।অনিমেষ বাবু তাই যেখানেই যান স্ত্রীকে নিয়ে যান সঙ্গে করে,একা ছাড়তে পারে না। 
   এসি কামরা ,বাইরের কোলাহল থেকে মুক্ত। ট্রেন ছাড়ার কয়েক মিনিট আগে এসে উঠলেন এক মুসলমান দম্পতি। আপাদমস্তক বোরখায় ঢাকা ভদ্রমহিলার কোলে এক ঘুমন্ত শিশু। তাঁরা এসে বসলেন অনিমেষবাবুদের মুখোমুখি বার্থেই। 
   কোলের শিশু দেখে প্রতিমাদেবীর মনটা কেমন ছটফট করে উঠলো। ভেজা চোখে তাকালেন স্বামীর দিকে। অনিমেষবাবু তাঁর কাঁধে হাত রাখলেন। 
   ট্রেন ছেড়ে দিল। বেশ কিছুক্ষণ কাটার পর ওই মুসলমান ভদ্রমহিলা তাঁর স্বামীর কানে কানে কিছু বললেন। ভদ্রলোক একবার স্ত্রীর দিকে,একবার বাচ্চার দিকে আর সবশেষে অনিমেষবাবুদের দিকে তাকালেন।অনিমেষবাবু মন দিয়ে একটা বই পড়ছিলেন আর প্রতিমাদেবী উদাস চোখে তাকিয়ে ছিলেন বাইরের দিকে। 
-" শুনিয়ে " মহিলা কন্ঠে দুজনেই চোখ তুলে তাকালেন। সেই মুসলমান ভদ্রমহিলা বোরখার আড়াল থেকে প্রতিমাদেবীর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। 
-"হ্যাঁ বলুন, স্যরি...জ্বী, বোলিয়ে" প্রতিমা দেবী আমতা আমতা করে বললেন, কারণ সম্বোধনটা তাকেই করা হয়েছে। 
-"হাম্ জারা  শৌচালয় যাঁনা চাহ্তে হ্যাঁয়। আপ জারা বচ্চিকো... "
-"হ্যাঁ মানে হাঁ " বলতে বলতে প্রতিমাদেবী হাত বাড়িয়ে দিলেন। ভদ্রমহিলা অতি সন্তর্পনে তার শিশু সন্তানটিকে প্রতিমাদেবীর হাতে তুলে দিলেন।বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে প্রতিমাদেবীর মনের মধ্যে এক অদ্ভুত অনুভূতি হল যা এক মা ব্যতীত আর কেউ হয়তো বুঝতে পারবে না । হৃদয়ের শূন্য ভান্ডার যেন নিমেষে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল। পরম মমতায় বাচ্চাটিকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন তিনি। ঘুমোচ্ছে, ঘুমোক।কি সুন্দর নিষ্পাপ মুখখানা...। 
-"ওহ হামারি বিটিয়া হেঁ" মুসলমান ভদ্রলোক বললেন, "হামারা নাম মজিবুর আলী ঔর উয়ো হামারা বিবি জাহানারা বেগম। " অনিমেষ ভাবে তাঁদের পরিচয় দিলেন। কথায় কথায় জানতে পারলেন মুজিবুর আর জাহানারা তাদের বাচ্চাকে নিয়ে কলকাতায় যাচ্ছেন পাকাপাকিভাবে ওখানেই বাস করতে। 
   সেই সময় উত্তরপ্রদেশে এক রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা ঘটে গিয়েছিল। উত্তরপ্রদেশের এক উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিবিদ কোনো এক অজ্ঞাত আততায়ীর হাতে খুন হন।আর যায় কোথায়,'হত্যাকারী মুসলমান' এই ধ্বনি নিয়ে রাজ্যজুড়ে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা মুসলমানদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে দেয়। ব্যাস! উত্তরপ্রদেশে  শুরু হয়ে গেল দাঙ্গা। সেইসঙ্গে গোটা দেশে সাম্প্রদায়িক আগুন দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে। 
   তবে সবচেয়ে বেশী আতঙ্কিত হয়ে ওঠে দিল্লিতে বসবাসকারী মুসলমান মানুষজন। মুজিবুরও বুঝতে পেরেছিল দিল্লিতে তারা সুরক্ষিত নয়। যেকোনো মুহূর্তে হিন্দু সন্ত্রাসবাদীরা শেষ করে দিতে পারে তাদের। তাই সে তার পরিবার নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে দিল্লি থেকে। 
    অনিমেষবাবু মনে মনে ভাবলেন, সন্ত্রাসবাদের কোনো ধর্ম হয় না অথচ তারা ধর্মের নামেই সন্ত্রাস চালায়। এটাই সবচেয়ে বড় প্রহসন। 
  আচমকা কলকাতা কেন এই প্রশ্নের জবাবে মুজিবুর বলেছিল যে, শুধু তারা নয়,তাদের বহু পরিচিত মানুষ আজ কলকাতাগামী কারণ বোধহয় গোটা ভারতবর্ষের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ একমাত্র জায়গা যেখানে নির্দোষ মানুষ সুরক্ষিত থাকতে পারে। কোনো জাতি-ধর্মের বাছবিচার করে না সেখানকার মানুষ। 

                              ***************

  মাঝরাতে আচমকা বিকট শব্দে ঘুম ভেঙে গেল অনিমেষবাবুর । চোখ খুলেই বুঝতে পারলেন অন্ধকারে তাদের কূপের আশপাশ দিয়ে কয়েকটা ছায়ামূর্তি যেন ছুটোছুটি করছে। পরক্ষনেই সেই কানফাটানো শব্দটা শুনলেন আরো একবার। তারপরই কানে এলো, "হারামজাদা মুসলমান,আজ তেরা খেল খতম।"সেই সঙ্গে কয়েকটা কাতর আর্তনাদ। ভয়ে শিউরে উঠলেন অনিমেষবাবু, কি হচ্ছে এসব। প্রতিমাদেবী ঘুম ভেঙে ভয় পেয়ে জড়িয়ে ধরলেন স্বামীকে। অনিমেষবাবুর অবস্থাও তথৈবচ ,কিছু বলতে পারছিলেন না। 
-" উয়ো লোগ আঁ গ্যাঁয়" মুজিবুরের গলা শোনা গেল, "আব হাম লোগোকো মার ডালেঙ্গে...। "
   অন্ধকারে ওর মুখ না বোঝা গেলেও গলার স্বরে ভয় আর অসহায়তা সুস্পষ্ট হয়ে উঠল। 
-"কারা ওরা" অনিমেষ বাবু মাথা নেড়ে বললেন,"আই মিন কৌন হ্যাঁ উয়ো লোগ? "
-"আতঙ্কবাদী। "
-"সন্ত্রাসবাদী!"অনিমেষবাবুর প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার যোগাড়। অজানা ভয় যেন পা থেকে মাথা পর্যন্ত ওনাকে নাগপাশে বেঁধে ফেলল। মাথা গুলিয়ে যাচ্ছিল। সন্ত্রাসবাদী, শেষ পর্যন্ত সন্ত্রাসবাদীরা তাঁদের ট্রেনে হামলা করল, "হে ভগবান, এই বিপদ থেকে আমাদের বাঁচাবে কে...। "
-"বেহেনজ্বী" কান্নাভেজা নারী কন্ঠে অনিমেষবাবুর চমকে উঠলেন। প্রতিমাদেবীও চোখ তুলে তাকালেন। অন্ধকারে এতক্ষণে চোখ সয়ে গেছে। বুঝতে পারলেন জাহানারা এসে দাঁড়িয়েছে তাঁদের সামনে। 
-"উয়ো হামে মার দেঙ্গে অর হামারি বচ্চিকো ভি নেহি ছোড়েঙ্গে।" জাহানারা ,না,জাহানারা নয়,এক মা যেন আর্তনাদ করে উঠলো,"আপ হামারে বেটি কো বাঁচা লিজিয়ে...রেহেম কিজিয়ে বেহেনজ্বী হাম পার" বলতে বলতে কোলের শিশুটিক বাড়িয়ে দিল প্রতিমাদেবীর দিকে। 
   আধো অন্ধকারে জাহানারার চোখের দিকে তাকিয়ে প্রতিমা দেবী স্তব্ধ হয়ে গেলেন। বাইরে সন্ত্রাসবাদীদের চিৎকার, গুলির আওয়াজ, আর্তনাদ মরণাপন্ন মানুষের গোঙানি সব যেন ক্ষণিকের জন্য হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। কালো জলভরা চোখ দুটিতে কি যেন এক অপরিসীম মাতৃত্ববোধ লুকিয়ে ছিল...প্রতিমা দেবী বুকের ভেতর কে যেন হাহাকার করে উঠলো। অনিমেষবাবু কি যেন বলতে চাইছিলেন ,কানে গেল না তাঁর। যন্ত্রচালিতের মত হাত বাড়িয়ে দিলেন জাহানারার দিকে। 

                                   ************

   ডোর বেলের শব্দে ঘোর কাটল প্রতিমাদেবীর। দরজা খুলে দেখেন অনিমেষবাবু দাঁড়িয়ে আছেন, "তিতলিকে প্লেনে তুলে দিয়ে এলাম, বুঝলে। কালকে আমেরিকায় ল্যান্ড করে যাবে।"বলতে বলতে থমকে গেলেন তিনি।স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন কিগো ,"আজ তোমাকে এতো অন্যমনস্ক লাগছে কেন? " প্রতিমাদেবী কান্নাভেজা গলায় বললেন ,"তিতলির বাবা-মার কথা খুব মনে পরছে গো।" -"ছাড়ো না,পুরোনো কথা ভেবে আর কি লাভ।" অনিমেষ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। 
   প্রতিমাদেবী জলভরা চোখে তাকালেন স্বামীর দিকে। অনিমেষবাবু তাঁর কাঁধে হাত রাখলেন,"তুমি না একদিন বলেছিলে ও আমাদের মেয়ে, আমরাই ওর বাবা-মা।"
   তা বটে প্রতিমাদেবীর বুকের ভেতর থেকে যেন একটা দুঃখের পাথর আস্তে আস্তে নেমে গেল । সেদিন হিন্দু সন্ত্রাসবাদীরা হামলা চালিয়েছিল ট্রেনে।বেছে বেছে প্রত্যেক মুসলমানকে হত্যা করেছিল তারা। আবালবৃদ্ধবনিতা কেউ বাদ যায়নি। মুজিবুর আর জাহানারাও মারা পড়েছিল তাদের গুলিতে। প্রতিমাদেবী কিন্তু শিশুকন্যাটিকে কোল ছাড়া করেননি। তাঁর মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে রেখেছিল সন্ত্রাসবাদীগুলো।অনিমেষবাবুর উপর অত্যাচার চালিয়েছিল তাঁর ধর্মীয় পরিচয় সম্বন্ধে সুনিশ্চিত হতে।তারপরও প্রতিমাদেবী এক মুহূর্তের জন্যও কাছছাড়া করেননি বাচ্চাটাকে। যেভাবে তিনি বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরেছিলেন তাকে যে, শয়তানগুলো কল্পনাও করতে পারেনি যে, ওটা তাঁর সন্তান নয়। 
   সে কি ভয়ঙ্কর রাত! আজও মনে পড়লে অজান্তেই প্রতিমাদেবী শিউরে ওঠেন। হত্যালীলা সাঙ্গ করে সন্ত্রাসবাদীরা যখন নেমে গেল ট্রেন থেকে ,চারিদিকে তখন রক্ত ,মৃত মানুষের ভিড়, অর্ধমৃতদের গোঙানি,আহতদের আর্তনাদ,জীবিত সহযাত্রীদের চিৎকার,কান্না আর তার মাঝে এক অনাথ শিশুকে কোলে নিয়ে প্রতিমাদেবী। ঘুম ভেঙে কাঁদছে শিশু, অথচ তিনি নিরুপায়, কান্না থামানোর কোনো উপায় নেই। 
    অনিমেষবাবু একবার বলতে চেয়েছিলেন, "এবার ওদের বাচ্চাটার... "
   প্রতিমাদেবী গর্জে উঠেছিলেন, "ওদের মানে কাদের, ও আমাদের মেয়ে। আমরাই ওর মা-বাবা। " পরক্ষণেই স্বামীর বুকে মুখ গুঁজে কাঁদতে শুরু করেছিলেন। অনিমেষবাবু দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলেন। মুজিবুর আর জাহানারার লাশের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, "তবে তাই হোক। আজ থেকে ও আমাদের মেয়ে, তিতলি। "
    অভিশপ্ত রাত কেটে যায়, নতুন সকাল আসে। পুলিশ উদ্ধার করে জীবিত যাত্রীদের। কলকাতায় ফিরেই তাঁরা আইনগতভাবে দত্তক নিয়েছিলেন বাচ্চা মেয়েটিকে। ফর্মে লিখেছিলেন, রাস্তা থেকে কুড়িয়ে পাওয়া শিশু। 
    জন্ম নিল তিতলি সান্যাল, অনিমেষ সান্যাল ও প্রতিমা সান্যালের একমাত্র সন্তান। 

                              ***************

    তিতলি কোনোদিনই আমেরিকায় পৌঁছোতে পারে নি। প্লেনটাকে হাইজ্যাক করেছিল কিছু মুসলমান সন্ত্রাসবাদী। তাদের পরীক্ষায় যারা মুসলমান বলে গণ্য হয়ে নি, নির্মমভাবে হত্যা করা হয় তাদের। তিতলিও ছিল মৃতদের দলে। 
    তিতলির জিনিসপত্রের মধ্যে থেকে উদ্ধার হয় একটা রক্তমাখা লকেট, যেখানে জ্বলজ্বল করছিল শিবের ছবি। প্রতিমাদেবী ওটা তিতলির গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন যাতে কোনো বিপদ-আপদ না আসে...। 

1 comment:

  1. দারুন হয়েছে বন্ধু, ভালবাসা নিও

    ReplyDelete

একনজরে

সম্পাদকীয়

একটি বিষয়ে আমাদের সকলের একমত হতেই হবে ভিন্ন মতের ও ভিন্ন রুচির বহুস্তরকে সম্মান জানিয়েও, যে, আমরা এই মুহূর্তে প্রায়শ্চিত্ত করছি। মানুষ...

বেশিবার পড়া হয়েছে যেগুলি