Monday, April 13, 2020

শু ভ দী প না য় ক -এর কবিতাগুচ্ছ




চতুর্দশীর কবিতাগুচ্ছ 

 ( উৎসর্গ : সুধীন্দ্রনাথ দও  ও বুদ্ধদেব বসু )

কৃষ্ণাচতুর্দশী   ১

তটিনী, এসো সুশোভিতা পাতার অরণ্যে, ফুলের বসনে । নির্ধারিতা চাঁদ তোমার অপেক্ষায় সম্মোহক হয়ে আছে । চক্ষুদ্বয়ের প্রতি শ্রদ্ধা নেই, এসো আকিঞ্চন আনন্দে । সহজ ছিল না রাত্রি, ধাত্রী, এ মনের দেনা বাড়ে চক্রবৃদ্ধি হারে । নেমেছে তমাল তমসা, প্রবুদ্ধ ছায়ার মতো সারিসারি তালগাছ, দিবারাত্রি বিশ্ব নিখিল নীরবতায় ব্যর্থ, যদি তোমার কুন্তলে তার যোগ্য ঠাঁই না হয় । এসো, চঞ্চলা স্রোত থেকে নির্বাণ নৌকা হয়ে, মাটির সরেস বুকে, সে বুকে ক্ষরিত দুধের স্বাদ তন্ময় হয়ে আসে, শিশুর আহার মেটে, আদুরে জিভের লোভ পুনরায় তাকে স্মরণ করে । এসো হলুদ শেফালি, কাতর মালিনী, বকুলের মতো এসো গাছের তলায় । ফুটেছে উন্মোচিতা শরীর, জানুদেশ আঁধার চেয়েছে । আড়ালে ঢেকেছে দুটি প্রমাণিত স্তন, গ্রীবার স্পর্শে তবু ঝিনুকের হার, আঁট করে বাঁধা চুল বেসামাল রাতের বাতাসে । কেন ময়ূরের ঠোঁট চেয়ে বসে না বুকের কুঁড়িকে ? হেঁতালের শাখা থেকে উড়ে আসে মনস্তাপের একটি কণা, আছে মসজিদ, আজান ধ্বনিতে বাজে ভ্রূকুটির পরোয়ানা । তটিনী, ডাক দিয়েছিলে অদ্ভুত ভালবেসে, অপাংক্তেয় হয়ে । আমার তো পতাকা নেই, ঘৃণার শবর গেছে বিভাজিকামূলে, বিহঙ্গী যেমন ডাকে, আমি সেইমতো যাই, দুয়ার নেই, বেরিয়ে আসার এক অবতংশ আছে । নবীনপত্রে যাকে লিখি কাব্যের নায়িকা ভেবে, প্রাজ্ঞঅহং সে সুন্দরী চিত্রায়ণের মাঝে মৃত্যুকে অতিক্রম করে গেছে, এসো বাঁধন শক্ত করো, সমাপ্ত বইখানা তোমার ঠোঁটের ফাঁকেই পড়ে আছে, অনাহারে যাত্রীরা পার হয়ে যায় । তটিনী, খর্ব তরু ছেয়ে গেছে যমুনার দুইধারে, কাঠের টুকরো হয়ে ভেসে এসো মরা পুরুষের পাশে ।

কৃষ্ণাচতুর্দশী  ২

অয়ি, আজ দোতলার বড় ঘরটা খালি করা হল । লোকজন আসবে, ঠাকুরদালানে মূর্তি গড়ার কাজ কতদূর, পায়ে পায়ে একবার গিয়ে সে খোঁজ নিয়েছ বুঝি ? নামানো হয়েছে চন্দনপিঁড়ি, পঞ্চপ্রদীপদানি, এইবার তবে হোক আলপনা দেওয়া শুরু । এসেছে নতুন কাপড়, দিঘির পাড়েই হবে গৃহিণীদের স্নান । আমার টেবিল আর লেখার খাতা উঠে গেছে পশ্চিমের ঘরে, বইয়ের আলমারি এসে ঘরের মেঝেতে নতুন করে দাঁড়িয়েছে । বারান্দা থেকে চোখে পড়ে দূরের বাগান, আলোহীন, সজ্জাহীন, উপাসনা ভেঙে গিয়ে ডেকে ওঠে কাক । আমার ঘরেতে ধুলো, অভিমান, পুজোর আনন্দ যে ভাগ করে নেব, অমন উপায় নেই মনে  । পুনরায় কাঁসরের শব্দে বেজে ওঠে শাঁখ । অয়ি, কোথায় হারিয়ে গেছ তুমি আত্মীয়দের মাঝে ! কোথায় নিয়েছে নদি জীবনের শেষতম বাঁক ? পরিখা রয়েছে গাঁথা সকলের মনের ভিতরে, সামন্তদের শাল-ইজারার কথা, পরিচিতা সমাদৃতা মুখের আড়ালে ঘূর্ণিজল বেড়ে ওঠে তৎক্ষণাৎ । অয়ি, আমি তোমাকে বহুদিন স্নানরতা দেখিনি, কেবলই উন্মাদ ডানা নিয়ে ফিরে ফিরে গেছি, ভেবেছি, -- সমস্ত আকাশ ভেঙে নামুক বৃষ্টি, আমি ঘাসেদের দেখাশোনা করি । পিঠটান করে লাল ব্লাউজ পরে আয়নায় ঘুরে ফিরে দেখে নিলে যদি, কেন দেখতে পেলে না সেই দৃশ্যে এক পাগল খুঁটে তুলছে আকন্দের ত্বক, কাঁধের ওপরে ফেলা হল বহুমুখ আঁচলের যথার্থ প্রকৃতি । আছে চওড়া পাড়, সুতোর সামান্য কাজ ছড়িয়েছে শাড়ির বিভূতি । মানুষকে ভালবেসে অল্পই লাভ হল, ধার্য হল চিন্মোহন গারদ, অব্যক্ত শিলা সারাজীবন ভাঙতে হল, অয়ি, --- অখণ্ড খাতার ভিতর !



কৃষ্ণাচতুর্দশী  ৩

একটি অমৃতফল থাকুক না হয় আমার হাতে, আর সবই তো কেড়ে নিয়েছ । আমার চোখের জরা, আমার মুখে চেপে ধরা কৃতজ্ঞ-স্তন, জীবনযাপনরীতি, পৌরাণিক পাখি, স্বপ্নের মূলে পেতে রাখা দুটি হাত, সবই দিয়েছি তোমাকে । আমি ওসবে সুখী ছিলাম না বলেই, ভেবেছি ওগুলো নিয়ে যেন আর কখনো না কাটে আমার এই একার বসবাস । আবার নতুন করে ভেঙে পড়ল গন্ধ-জড়ানো শীতরাত্রি, যে লেখার জন্ম শিশিরের ফোঁটায় এইমাত্র হল, মনে হল তার ঝরে পড়ার বড় প্রয়োজন ছিল আমার অনাবশ্যক বেঁচে থাকা প্রতিটি পাতার ওপরে । যথারীতি লেখা আছে কালো মাটির কাহিনি, পীড়িত লোহার পাত, স্তূপে স্তূপে জমে ওঠা পরিত্যক্ত কাগজ, যেন টান পড়েছে সংসারে, বিক্রি হচ্ছে কৃষ্ণচাঁপার ছড়ানো শিকড় । অামি মৌলিক, যেকোনও তটে, সবুজের দীর্ঘে, আয়়ুর জারণে, তাই নাভির গোপন থেকে শাড়িটুকু খুলে দিয়ে বলেছিলে, 'আজ এই মঙ্গলঘটে এইটুকু পাপ আঁকা হোক ।' ফিরে তাকালাম, অজস্র কীটের জন্ম হল, আজ তারা চলে গেছে মাটির গভীরে । মৃণালে ফুটেছে মৃত্যু, আমার বুকের 'পরে তোমার এই পা দুটি থাক, নুপূর হারিয়ে গেছে সেই কবে । চিরদিন কালোমেঘ জমে ছিল আমাদের মাথার ওপরে, পরাধীন সব ধান ঝেড়ে বেছে নিয়ে গেছে চাষী, একটি শ্মশানবট থাকুক না হয় এই পোড়া নাটমন্দিরের পাশে, আর সবই তো গিয়েছে ভেঙে । সামাজিক মেলামেশা,  রৌদ্র থেকে সরে আসা ছায়া, লুপ্ত দ্রাবিড় বন, পাশাপাশি ছুঁয়ে থাকা, আকাশের চাঁদ আজ বুকডোবা জলে থিতিয়ে পড়েছে, আঁখি, তোমার সুধার মতো  লুটিয়ে পড়ল ঐ তিনহাত অহেতুক সাক্ষ্যপ্রমাণের গায়ে । জ্বলন্ত উড়ানটুকু থাক, আঙুরগোছার মতো ঝুলে থাকা শোকের ভিতরে ।



কৃষ্ণাচতুর্দশী  ৪ 

মৃতের মাদুর পাতা মাটির দাওয়ায়, প্রাণময় হাঁড়ি ভুসাকালি গায়ে মেখে উনুনে চেপেছে কাঠের জ্বালে । গলায় সদ্যফোটা ফুলের মালা, কপালে স্নানসিক্ত স্বপ্নচন্দনের টিপ, মলিন বসনা,--- অগোচরে এইভাবে চিহ্নিত মীরা । এতই আষাঢ় তার বাহুমূলে গাঁথা, আমি ছুটি তার সেই কান্তস্নিগ্ধ শরীরের সন্ধানে, প্রথমে ছলনাময়ী, অন্তরে অস্পষ্ট দ্বিধা, পরে বুঝি, ভিতরে সে বিকশিত, কতখানি গোপনচারিণী ! একদিন অনাদি শিহরণ জেগে উঠল, সন্ধ্যায় নেমে এল মীরার শরীর জুড়ে প্রসন্নবিনোদিনী । আহা ! অধোমেঘ, উৎপল যাকে ঘিরে কল্লোললিত, জন্ম থেকে সূচে বেঁধা, গলিত আগুন জ্বেলে তার পাশে স্থির হয়ে বসে একমনে কী যেন পড়ছে মীরা, হতে পারে বনমালির চিঠি, খড়ের চালের থেকে পেড়ে নেওয়া সুতোবাঁধা একখানি প্রেমের পুস্তিকা । এসো প্রেম, ধারণ করো তাকে, তৈলতপ্ত দেহে, সুগন্ধি চুলে, চিকচিকে ঘামে ভেজা কুচফলের মতো বুকে । উর্বরা মীরা, বিকল্প নেই যার পৃথিবীতে । নবীনপল্লোভশোভা ছুটে চলে স্পর্শসুখে, গোলাপবাগানে । মীরার শূন্যহাত ভরে যায় ছায়ানটে, ভরে যায় ক্ষমার আগুনে । নতুন চালের পায়েস, ক্ষীর আর সুস্বাদু সম্মানে গান বাঁধে মীরা, প্রাপ্য তার অর্পিত নগ্ন দুই কাঁধে, ঢেউ আসে মুকুলিত নেশার নয়নে, উঠোনে তুলসীচারা জল পায়, দীপ জ্বলে তার নিচে নভোনীল রাতে ।





কৃষ্ণাচতুর্দশী   ৫

ছিল অন্তত কিছু, নইলে এতদূর এলাম কীভাবে ! আজ নেই, পরাজয় স্বীকার করেই ফিরে যেতে হবে, কিন্তু ফিরতে যদি ইচ্ছে না করে, যদি মনে হয় ফিরে গিয়ে কী পাব আমি ! থেকে যাওয়ার মতোও যদি কিছু না থাকে, তা হলে কোথায় গিয়ে দাঁড়াব এতদিন পর ? আমাকে সাজিয়ে তোলে চন্দনের ফোঁটা, চোখ দুটো বুজে আছে তুলসীপাতার ভারে, পোড়াধূপ চারিপাশে, অথচ গন্ধ ছোঁয় না আমাকে, ফুলের স্তবকও এখন অস্তিত্বহীন । শুধু দূরে বসে আছে কিছু মানুষ, যারা সংবাদ পেয়ে প্রথমে বিশ্বাস করতে চায়নি । ভেবেছিল, আমার বেদনা বুঝি বাঁচাবে চিরদিন অযথা সুখের হাত থেকে । সত্যি হয়নি সেসব । এখন জানি, কত মিথ্যে সাজাতে হয়েছিল জীবনে, কত মূর্তিতেই ঈশ্বর নামেনি, মন্দির খালি ছিল, তবুও সেখানে বিশ্বাস পেতেছিল দু'একজন । নতুন শিকের জানলা দিয়ে তাদের কেউ কেউ আমাকে দেখে যেত । আজ বিছানা-তোশক একপাশে গোটানো, এতদিন মেলে রাখা ছিল, ওষুধপত্র ফেলে দেওয়া হয়েছে, চশমা সরিয়ে রাখা ব্যবহৃত স্মৃতি হিসেবে, বইগুলো হয়ত কারোর কাজে লেগে যাবে, লেখাগুলো ছাপা হবে নতুন মলাটে । টাঙাবে ছবি, আসবে সংবর্ধনা, আলোচনাতেও নামটুকু বারবার ফিরে ফিরে আসবে । তবু, যে হৃদয় একদিন আমাকে ব্যক্তিগত করে পেয়েছিল, তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কেউ থাকবে না ।


কৃষ্ণাচতুর্দশী  ৬

একদিন বইপত্র পড়তে পড়তে তুমি ঠিকই বুঝতে পারবে যেসব বই এতকাল পড়ে দেখার প্রয়োজন ছিল, আমরা তা অনেক দেরিতেই খুলি । হয়তো সময় থাকতে পড়ে ফেলতে পারলে আমরা মিটিয়ে দিতাম পরস্পরের দেনা, অবসান হত তর্কের, যারা চলে গিয়েছে, তারা পাশে থাকত,  নতুন আলাপ থেকে বঞ্চিত হতাম যদিও, কিন্তু পুরনো সোনার মতো জীবন বড় দামি হত । দেরিতে পড়তে পেরে মনে হয়, এতকাল যা কিছু পড়েছি, সেসব ছাপিয়ে কেন এই লেখা এর আগে পড়িনি ! হারানো কাগজ যদি পুনরায় ফিরে আসে নতুন করে, রোজকার ব্যবহৃত পেয়ালা যখন ভেঙে গিয়ে সম্পর্ক ত্যাগ করে দিতে চায়, সেসময় সুখ ও অসুখের যন্ত্রণা ভেসে ওঠে প্রাণে । অনাসক্ত, মুখাপেক্ষী সরল প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে গিয়েছি আমরা, কিছু বই এসব ছায়ারই নক্সা বয়ে নিয়ে চলে । অস্ত্রখণ্ড, মেয়েদের শরীরের বিপুল বিপর্যয়, পুরুষের অদেখা মন, শিহরে অভাব, সেই টানে দৃষ্টিক্ষুধায় লোভ, সব কিছু জমা আছে এই সব বইয়ের পাতায় । কোলাহলে যে ভুল করেছে জীবন, শব্দ থেকে দূরে সেই ভুল আবারও সে ফিরে পেতে চায় । পাবে, তুমিও পাবে, ঝুলন্ত ফলের মতো পাখির ঠোঁটের ছোঁয়া, ভিতরে ভিতরে নষ্টযাপন, ধোঁয়া, পাহাড়ি বরফ থেকে আগুনের গলিত মুক্তি, সবই পাবে, শুধু একদিন দেখো বইগুলো খুলে ।







শুক্লা চতুর্দশী  ১

ভেঙে পড়ে অস্তরাগ, চিরদিন জাগতে জাগতে আজ এর ভেঙে পড়া বড় জরুরি ছিল । সন্ধ্যার সম্মুখে ভেঙে যেতে ডেকে ওঠে কয়েকটি নিষ্ঠুর পাখি । মাছেরা জলের গভীরে নেমে যায় । পতঙ্গেরা পাতার ডগায় বসে অপেক্ষা করে নতুন শিকারের । যুবতীরা ছুটি পায় সারাদিন পর, বেছে নেয় আড়ালে লুকিয়ে থাকা পুরুষদের । শিশুরা ফিরে আসে, যে ট্রলার সমুদ্রে গিয়েছে, তাও এসে তীরে পৌঁছায় । আজ ২০১৯ সালের শেষে যা কিছু ঝুলন্ত ছিল, সেই সব অপেক্ষা ভেঙে পড়েছে । আমারও ভাঙন ধরেছে, প্রথমেই নড়ে ওঠে খাট, জলভরা গ্লাসটাও মেঝেয় হঠাৎ পড়ে ভেঙে যায় । কাঁপছে রোদের আলো, খসে পড়ে অজানা দেওয়ালঘড়ি, বুকশেল্ফ থেকে পড়ে যায় বই, থালাবাসনের শব্দ শুনি রান্নাঘরে । এমনও হওয়ার ছিল, এমনই গভীরে ভাঙে অহেতুক প্রেমের হৃদয় । যন্ত্রসঙ্গীত, বেহালাবাদক, সবকিছু ফিরে গেছে এতদিন পর । জানালার কাচ খুলে দেখি, রাতের সাগরজল ভোরে এসে দাঁড়িয়েছে দুয়ারের কাছে, ভালবাসা চাইছে । সিঁড়িটা অটুট ছিল, তাই ভয়ে ভয়ে নামি । পাক দেওয়া ঘূর্ণির মতো, যেভাবে নেমেছি এর আগেও । সিঁড়ির বাঁকের মুখে কোনভাবে জড়িয়েছি তাকে, উনিশ বছর আগে । হাঁফ ধরা, গণনাবিহীন জীবন ছিল আমার, চেপে ধরি তার সেই আতরগন্ধমাখা সুকোমল দেহ, ভেঙে পড়ি বিপন্নতা নিয়ে, আমাকে তাড়িয়ে আনে লোভাতুর চঞ্চল স্নেহ । এখন চারদিকে গরিবিয়ানার চিহ্ন, কর্ণিকার অপচয়, সশব্দে জল পড়ে, শ্যামাপোকা নির্জনে এসে ফিরে ফিরে যায় ।

     
শুক্লা চতুর্দশী  ২

মনে পড়ে যায় :  জমাট অন্ধকারে এক পাহাড়ি রাস্তায় সেবার গাড়ি থেকে নেমে পড়ে বললাম, তোমরা সকলে ফিরে যাও, আমি পথ পেয়ে গেছি । ফুটে থাকা শিমুল জানাল, একটি মেয়ে গাড়ির ভিতরে বসে আছে, সে আমাকে বিদায় দিতে রাজি নয় । তবু গাড়িটা বাঁক নিয়ে মিলিয়ে গেল । সেদিনই প্রথম আবিষ্কার হল, আমার ভিতরে স্নান করে চলেছে অন্যকেউ । ক্রমশ আসছে ভুল, দ্বিধার শিকড় যেন জড়িয়ে ফেলছে, গা থেকে ফুড়ে বেরোচ্ছে পাতা, বাড়ছে নিঃসঙ্গ আয়ু, অনুপস্থিতির সুযোগে । পাহাড়ের ঢাল বেয়ে সেইমতো নামছি, প্রথমে চায়ের দোকান, কেউ কেউ অস্থির হাতে বিস্কুট খাচ্ছে, সুরার দোকান ঘিরে লোকেদের অহেতুক ভিড়, সেসব পেরিয়ে আরও নিচে গিয়ে দেখি মাইলস্টোনের গায়ে গাড়ি থেকে নেমে নতমুখে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয় সেই মুখ । মাথায় উলের টুপি, হৃদয়ে কীসের এত আয়োজন ছিল কখনো বুঝিনি আগে । থেমেছি গভীর উদ্বেগ নিয়ে, সুতোর প্রান্তে যেমন বাঁধা থাকে গিঁট, তেমনই দৃষ্টি ফেরানো রাত চিরকাল আমার গোপনে বেড়ে গেছে রোজ, লেখা নেই বলে কেউ তা কখনো পড়ে দ্যাখেনি  !



 
                                                             
শুক্লা চতুর্দশী  ৩

আমলকির বাগানে একদিন দেখি ঝরা পাতা ও বৃক্ষশাখার মধ্যে দিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে ঐশ্বরিক আলো । সালটা কত মনে নেই, আমি ছিলাম জন্মগত কবি, সারারাত আকাশের শরীরে পুড়তে পুড়তে ভোরের প্রথম রোদে পৃথিবীতে নেমে এসে দেখি ঐ আলোয় জীবনবিমুখ হয়ে কাঠের চেয়ারে বসে আছ তুমি, শহর ছাড়োনি । বোমার আঘাতে বাড়িঘর জ্বলছে, দোকানবাজার সব গুটিয়ে গেছে বহুদিন হল, কেবল ভাসমান শুকনো পাতার দল ঘিরে রেখেছে বাগানের একবৃত্ত পুকুরের জল, যার দিকে নিরালায় চেয়ে আছ তুমি । ক্ষমার সমাধি আছে দূরে, আছে আবির ছড়ানো কিছু বেসামাল হাত, নাইটগ্রাউন পরে বসে আছ, নিরুপায় সব সাজ ঢেকে গেছে নতুন সকালে । আমি হ্যাঙারে টাঙানো গতরাত্রের ওভারকোট এনে তোমার পিঠে পরিয়ে দিলাম । সম্বিৎ ফিরেছে যেই, মনে হল অভুক্ত তুমি, নিয়তির সব চিঠি যেমন খোয়া যায় আঁধারে, তোমার কাহিনিও ঠিক তেমনই । শুরু হল ক্যানভাসে রঙ ঢালা, ছবির খেয়ালে উঠে এলে তুমি । এবারের নদিপথে, ঝর্নাপথে, যে শ্রম বৃথাই নষ্ট করেছি, তার চেয়ে এ উপত্যকা অনেক আলাদা । মাটির গাঁথুনি এত দৃঢ়, বৃষ্টির জল পেলে ধুয়ে গিয়ে গর্তে পড়ে না । দেখি, মাটির রঙের মতো ঘটনার ভার নিয়ে বসে আছ একা । ঝরে পড়তে পারে করবী ফুল, হঠাৎ পেরতে গিয়ে আছড়ে পড়তে পারে শোকাতুর ফিঙে । যে ফল মরেছে আমারই মতো আধখানা হয়ে, পিঁপড়ের দল তাকে আটকে দিতে পারে । প্রতিটি রহস্য, তুষারপাত, জড়িত কৃষি, সবই দেখেছি এই নেশার বাগানে । বারবার সরিয়েছি হাত, তবু এসে গাল ছুঁয়ে, চুলের আড়াল ছুঁয়ে দিয়ে গেছে ফাঁকি । আমি তো কখনো বুঝিনি, আমাকে বোঝাও তুমি, এই অপ্রস্তুত সময়ে কীভাবে আনবে তুমি আমাদের সন্তানকে ? পুকুরঘাটের এই দীর্ঘ পিছল, আশেপাশে রেলিঙের রক্ষাটুকু নেই, বাড়ির অসংখ্য ফাঁক, কেন সেসব তুমি শুনতে চাও না ? ফুল থেকে জন্ম নেয় প্রেত, ডিম থেকে নখের আঁচড়, প্লাবনের মুখে এসে ছেড়ে যায় হাত, ভেঙে যায় বৈঠার পাত । ভুলের মাশুল থেকে মুছে যায় রাত, আসে প্রশ্নে ঘেরা এমন সকাল ।

শুক্লা চতুর্দশী  ৪

নৌকাবাড়ির ছাদে বসে আছি, ডিসেম্বরের রাতে পাহাড়ের মাঝখানে এই যে বিরাট ঝিল, জলের উপরিতল বরফে পরিণত হয়েছে, সেখানেই বাঁধা আছে নৌকা, ভিতরে ঘর, বিছানাপত্র, রান্নার আলাদা জায়গা রয়েছে, এসব ডিঙিয়ে সিঁড়ি উঠে গেছে ছাদে । আছে ভাঙাপাত্র, সেদ্ধডিম, মগভরা কফি । এসব কি মানুষকে বড় বেশিদিন ভাল রাখতে পারে ? তার চাই বিপজ্জনক সেতু, ভবিষ্যতহীন কিছু দুষ্প্রাপ্য সম্পর্ক, অযথা বেদনা, সৃষ্টিকে একা একা ঘুরে দেখার আনন্দ । গরমের দিনে এই নৌকা ভেসে যেতে পারে ঝিলের কিনারা ধরে । আদায় করতে পারে শুভেচ্ছা, পাড় থেকে দু'একজন ছুড়ে দেবে খুচরো পয়সা । ভাসতে ভাসতে অন্য নৌকাও এর কাছে আসতে পারে । গতবছর ছিপ হাতে তরমুজভর্তি এক নৌকার সঙ্গে মাছ বিনিময় হল । পালংশাক ও গাজর দিয়ে গেল অন্য আরেকটি নৌকা । দু'মুটো চাল চাপিয়ে এবারেও বেরিয়েছিলাম সবজির খোঁজে, দোকানবাজারে তেমন কিছু খুঁজে পাইনি, ফলে পেড়ে আনলাম অপ্রয়োজনীয় আপেল । জ্যোৎস্নার নিচে বাঁধা এই নৌকায় আর কিছুদিন থাকব । চলছে মিলিটারি শাসন, নামছে কার্ফিউ, আসবে সামাজিক মানুষের ঢল, ব্যারিকেডে পথ আটকে যাবে, এখন আর মেলামেশা আগের মতো নেই, সবই লিখিত, চুক্তিবদ্ধ, নিয়মরক্ষায় বেরিয়ে পড়েছে সকলের মন । ভাবি, চাঁদের সামনে দিয়ে ভেসে যায় যে ধূসর মেঘরাশি, তার কিছু পাওনা ছিল কি না, তারারা ফোটেনি আজ, ব্যস্ত ওরাও নিজস্ব লেখালিখি নিয়ে ।

No comments:

Post a Comment

একনজরে

সম্পাদকীয়

একটি বিষয়ে আমাদের সকলের একমত হতেই হবে ভিন্ন মতের ও ভিন্ন রুচির বহুস্তরকে সম্মান জানিয়েও, যে, আমরা এই মুহূর্তে প্রায়শ্চিত্ত করছি। মানুষ...

বেশিবার পড়া হয়েছে যেগুলি