পাথরচাপরি মেলায় সেখ সাজাহান ও তাঁর দলের অন্য সদস্যরা
বীরভূমের
পাথরচাপরিতে দাতাবাবার উরসের মেলায় ঘুরতে ঘুরতে যা আমাদের সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করেছিল তা হল একদলি গান। একদলি গানের মূল গায়ক
একজন। তিনিই একক অভিনয় ও গানে এগিয়ে নিয়ে যান মূল পালা । খোল, করতাল, তবলা, খঞ্জনী – বাদ্যযন্ত্র বলতে এই। কীর্তনের সঙ্গে মিল আছে একদলি গানের। একদলি গানের
শ্রোতা হিন্দু মুসলমান ভক্তরা। তাদের জন্য
ছোট ছোট ভক্তিমূলক পালা গেয়ে শোনান এনারা। আলাপ হল বর্ধমান জেলার আউসগ্রাম থানার
প্রতাপপুরের আব্বাস শেখ ও তার দলের দুয়ারীদের সঙ্গে। দাতাবাবার নামে যারা মানত
করেন তারা এই উরসে এসে গায়কের মাধ্যমে দাতাবাবাকে
গান শুনিয়ে শিরনি চড়ান। নানুর থানার বন্দর থেকে
এসেছেন শেখ সাজাহান তার দল নিয়ে। সত্যপীরের পাঁচালী গান গাইতে উনি পৌঁছে যান জেলায়
জেলায়।
খোল করতাল বাজিয়ে লোকজন জড় করে মেলার একটা অস্থায়ী আস্তানার ধারে সেখ সাজাহানের গান শুরু করলেন-
“গায়ক- আরে দুয়ারী সকল,
এই পাথর চাপুরি কেন হল, আর পাথর চাপুরির আগে
কি নাম ছিল, আর দাতাবাবার জন্মভূমি কোথায়, আর কোথা থেকে দাতা মেহেবুব শাহ এখানে এলেন তোমাকে জানাই-
(গান) আরে দাতাবাবার জন্মভূমি বর্ধমান জেলায়।
দুয়ারী- আরে কে আনিল রে, কোথায় ছিল রে আমার এই দাতাবাবার নাম।
গায়ক- বর্ধমান জিলা, বর্ধমান জিলা বলতে তো অনেক বড়। বর্ধমান ডিসটিকে মঙ্গলকোট বলে একটা থানা আছে। সেই মঙ্গলকোট থানার পাশে, একটা ছোট্ট মত গেরাম আছে পদিমপুর।
তোমাকে জানাই-
(গান) সেই গেরামে দেখ আমার দাতার জন্ম হয়।
দুয়ারী- আরে কে আনিল রে, কোথায় ছিল রে আমার এই দাতাবাবার নাম।
গায়ক- আরে পদিমপুরে দাতার জন্ম, আমি বলিয়া জানাই।
দুয়ারী- আরে কে আনিল রে, কোথায় ছিল রে আমার এই দাতাবাবার নাম।
(গান) আরে দাতাবাবার জন্মভূমি বর্ধমান জেলায়।
দুয়ারী- আরে কে আনিল রে, কোথায় ছিল রে আমার এই দাতাবাবার নাম।
গায়ক- বর্ধমান জিলা, বর্ধমান জিলা বলতে তো অনেক বড়। বর্ধমান ডিসটিকে মঙ্গলকোট বলে একটা থানা আছে। সেই মঙ্গলকোট থানার পাশে, একটা ছোট্ট মত গেরাম আছে পদিমপুর।
তোমাকে জানাই-
(গান) সেই গেরামে দেখ আমার দাতার জন্ম হয়।
দুয়ারী- আরে কে আনিল রে, কোথায় ছিল রে আমার এই দাতাবাবার নাম।
গায়ক- আরে পদিমপুরে দাতার জন্ম, আমি বলিয়া জানাই।
দুয়ারী- আরে কে আনিল রে, কোথায় ছিল রে আমার এই দাতাবাবার নাম।
গায়ক - ছোট
বেলায় উনার মা মারা গেছে। গরীবের ছেলের যদি মা মারা যায় তবে সেই ছেলের কি অবস্থা
হবে? একটা নোংরা ছেঁড়া জামা একটা ছেঁড়া প্যান্ট পরে উনি ঐ পদিমপুরে
মিঞেদের ঘরে চাকরি করতেন। কি চাকরি? না গরু চরাইতেন। যে গরু
চরায় তাকে বলে রাখাল বাগাল। তা আমার দাতা মেহবুব শাহকে বাগাল বলা মানে আমার
বেয়াদপি করা। তাহলে?
উনি গরু চরাতেন ভাই,
(গান) ওরে পদিমপুরের কথা আমি কিছু বলে যাই।
উনি গরু চরাতেন ভাই,
(গান) ওরে পদিমপুরের কথা আমি কিছু বলে যাই।
দুয়ারী- আরে
কে আনিল রে, কোথায় ছিল রে আমার এই দাতাবাবার নাম।
গায়ক- তখনকার যুগে গরীবকে বড়লোকরা খুব ঘেন্না করত। তখন উনার নাম তো দাতা মেহবুব শা ছিলেন না। উনার নাম ছিলেন- বেঁচো সাহেব। বেচু রূপে ওদের ওখানে উনি ছিলেন। তা ওদের ঐ মিঞেদের বিবিরা ঐ পচা ভাত আর তেনা তরকারী আমার বেচু বাবাকে খেতে দিতেন। তা উনি খুব দুঃখের উপরে ছিলেন। কেমনধারা ছিলেন?
দুয়ারী – কেমন?
(গান)
গায়ক- ও আমার আল্লা জানে কার কপালে কি আছে।
দুয়ারী - আমার মউলা জানে কার কপালে কি আছে।
গায়ক- এইভাবেতে দিনের পরে ও দিন গুজারিয়া যায়।
দুয়ারী- ও আমার আল্লা জানে কার কপালে কি আছে। ...”
প্রায় কুড়ি মিনিটের এই ছোট্ট পালায় বর্ণিত হল দাতা মেহবুব শাহ্র ইতিহাস।
ছোটবেলায় তাঁর নাম ছিল পাচুসাহেব। মঙ্গলকোটে মালিকরা একবার ঘটনাচক্রে খুনের আসামী হলে কিশোর পাচুসাহেব অলৌকিক ক্ষমতায় তাদের বাঁচিয়ে চলে আসেন রাজনগর থানার পাথরচাপড়ি। তখন এই জায়গার নাম ছিল কালিয়াচক। সেখানেও খান সাহেবদের গরু চরাতেন। খাবার খেতে দিলে তার প্রায় সবটাই বিলিয়ে দিতেন অন্য রাখালদের মধ্যে। এইভাবেই উনি পরিচিতদের সম্বোধনে দিনে দিনে হন দাতাবাবা। জোহরের নামাজের সময় উনি গরুগুলোকে বক করে গাছে তুলে দিয়ে নামাজ পড়তেন। লোকের জমির ধান খেলে লোকে অভিযোগ করত। পরে তারা মাঠে গিয়ে দেখত ধান যেমন ছিল তেমনি আছে। একদিন জলের হাহাকার। আজ যেখানে চাঁদপুর, ওখানে একটা পাথরে চাপড় দিয়ে জল বের করে উনি মানুষের পিপাসা দূর করেন। সেই থেকে এই জায়গার নাম হয় পাথর চাপড়ি। এই গল্প যাদের বিশ্বাস হয় না তারা নিশ্চিত জানেন হজরত ইব্রাহিম আর বিবি হাজেরার পুত্র ছোট্ট ইসমাইলের পায়ের আঘাতে কেমন করে জলের ফোয়ারা হয়েছিল। সেই জমজমার জল যেমন পবিত্র তেমনি পবিত্র চাঁদপুরের ইঁদারার জল।
গান গেয়ে আদায় হল একশ কুড়ি টাকা। দল উঠিয়ে সাজাহানদা চলে গেলেন অন্য আস্তানার খোঁজে।
কিছুদিন পরেই আমাদের সুযোগ হয় নানুর থানার পুন্দরাতে শেখ সাজাহানের একদলি গান শোনার। সাজাহানদা সারাদিন ভাঙাচোরা জিনিস কেনেন গ্রামে ঘুরে ঘুরে। মাইকে গান বাজে। কোথাও গাছ তলায় বসে জিরিয়ে নেন খানিক। সাইকেলের দুপাশের ঝোড়ায় সব বোঝাই করে বিকেলে বাড়ি ফিরে আসেন। বন্দর গ্রামে উনার বাড়িতে বসে একদিন (৩০-০৩-২০১৭) কথা হয়েছিল অনেকক্ষণ। তাঁর কথাগুলি একজায়গায় সাজিয়ে দিলাম।
“আমার মায়ের নাম বদরুন্নেসা বেগম, আব্বার নাম সেখ তরিবর। আমরা আগে ছিলাম গঙ্গারামপুরে। পঁয়তাল্লিশ বছর হবে চলে এসেছি এই বন্দরে। এমনি সময় মনোহারি ব্যবসা করি। ঝাঁকা সাইকেল আছে। ভাঙাচোরা মাল কিনি। আর মাইকে চিপে গান ভরা আছে। দিয়ে মাইক বাজে। আমি যাই পাপুরি বনগ্রাম স্রান্দি। মাল বেচি নানুরে। নানুর আমাদের বাজার। চাষের কাজ কম করি। খাওয়ার মত ধান হয়। আমরা গরীব মানুষ। বুঝলেন?
গান শিখেছি যাদের কাছে তারা সব গায়েব হয়ে গেছে। আমার নিকটজন ছিল সব। আমার স্ত্রীর জামাইদা হত। তাঁর কাছ থেকে আমি শিখেছি। এবার গুরু শিষ্য লাগল একদিন। তারপর একদিন রাতে উঠে হেঁটে চলে গিয়েছি সাইথিয়া। চামর কিনে এনে গান শুরু করেছি। এগুলো সাধনার জিনিস। এবার আমার কাছ থেকে আমার ছেলে শিখবে। ওর শিখা হয়ে গেছে। ভয় করছে গাইতে। সব পালা ও জানে। পালার মাঝে যখন চা খেতে বসি মিনিট দশেক রেস্ট নিই। দু চারটে ইসলামি গান, ফকিরি গান ও কলি যুগের গান গায়। আমাদের মুসলমানদের বিয়েতে যে গান হয় তাতে ঢোল বাজায়। আমাদের কাছে বিয়ের গান দু চার লরি আছে। কত নেবেন? হিন্দুরাও মানত করে। বর্ধমানে খণ্ডঘোষ থানায় যাই। ওখানে হিন্দুদের ঘরে গান করেছি। আজ যেমন মুসলমানদের ঘরে গাইব, কিন্তু পাড়াটা হিন্দুদের। মুসলিমদের গান হিন্দু পাড়ায় হবে। কার্তিক মাসে বর্ধমানের ভাতারে একটা গ্রামে পীরের থানে দশ দিন গান করে এলাম। জয়নাল উদ্ধার কাহিনী। আমরা আমাদের মত সাজিয়ে নিই। এই গেল পাথরচাপরি মেলায় আমাদের বায়না দিলে মুসলমানি বিয়ের গান গাইতে হবে। যাব। হাসাবার জন্য রঙ্গ রসিকতা করতে হয়। ওটা বলা হয় কমিক। লেটো গানের মত কথা কাটাকাটি হয়। কিন্তু লেটোর ছকে গাওয়া হয়না। মানে খারাপ কথা হয়না। ওখানে মেয়েছেলে বেটাছেলে থাকবে। শিক্ষিত অশিক্ষিত বিভিন্ন ধরণের মানুষ থাকে। তাই। এইসব গাইতে আমাদের বই লাগে না। সব মনে থাকে।
গায়ক- তখনকার যুগে গরীবকে বড়লোকরা খুব ঘেন্না করত। তখন উনার নাম তো দাতা মেহবুব শা ছিলেন না। উনার নাম ছিলেন- বেঁচো সাহেব। বেচু রূপে ওদের ওখানে উনি ছিলেন। তা ওদের ঐ মিঞেদের বিবিরা ঐ পচা ভাত আর তেনা তরকারী আমার বেচু বাবাকে খেতে দিতেন। তা উনি খুব দুঃখের উপরে ছিলেন। কেমনধারা ছিলেন?
দুয়ারী – কেমন?
(গান)
গায়ক- ও আমার আল্লা জানে কার কপালে কি আছে।
দুয়ারী - আমার মউলা জানে কার কপালে কি আছে।
গায়ক- এইভাবেতে দিনের পরে ও দিন গুজারিয়া যায়।
দুয়ারী- ও আমার আল্লা জানে কার কপালে কি আছে। ...”
প্রায় কুড়ি মিনিটের এই ছোট্ট পালায় বর্ণিত হল দাতা মেহবুব শাহ্র ইতিহাস।
ছোটবেলায় তাঁর নাম ছিল পাচুসাহেব। মঙ্গলকোটে মালিকরা একবার ঘটনাচক্রে খুনের আসামী হলে কিশোর পাচুসাহেব অলৌকিক ক্ষমতায় তাদের বাঁচিয়ে চলে আসেন রাজনগর থানার পাথরচাপড়ি। তখন এই জায়গার নাম ছিল কালিয়াচক। সেখানেও খান সাহেবদের গরু চরাতেন। খাবার খেতে দিলে তার প্রায় সবটাই বিলিয়ে দিতেন অন্য রাখালদের মধ্যে। এইভাবেই উনি পরিচিতদের সম্বোধনে দিনে দিনে হন দাতাবাবা। জোহরের নামাজের সময় উনি গরুগুলোকে বক করে গাছে তুলে দিয়ে নামাজ পড়তেন। লোকের জমির ধান খেলে লোকে অভিযোগ করত। পরে তারা মাঠে গিয়ে দেখত ধান যেমন ছিল তেমনি আছে। একদিন জলের হাহাকার। আজ যেখানে চাঁদপুর, ওখানে একটা পাথরে চাপড় দিয়ে জল বের করে উনি মানুষের পিপাসা দূর করেন। সেই থেকে এই জায়গার নাম হয় পাথর চাপড়ি। এই গল্প যাদের বিশ্বাস হয় না তারা নিশ্চিত জানেন হজরত ইব্রাহিম আর বিবি হাজেরার পুত্র ছোট্ট ইসমাইলের পায়ের আঘাতে কেমন করে জলের ফোয়ারা হয়েছিল। সেই জমজমার জল যেমন পবিত্র তেমনি পবিত্র চাঁদপুরের ইঁদারার জল।
গান গেয়ে আদায় হল একশ কুড়ি টাকা। দল উঠিয়ে সাজাহানদা চলে গেলেন অন্য আস্তানার খোঁজে।
কিছুদিন পরেই আমাদের সুযোগ হয় নানুর থানার পুন্দরাতে শেখ সাজাহানের একদলি গান শোনার। সাজাহানদা সারাদিন ভাঙাচোরা জিনিস কেনেন গ্রামে ঘুরে ঘুরে। মাইকে গান বাজে। কোথাও গাছ তলায় বসে জিরিয়ে নেন খানিক। সাইকেলের দুপাশের ঝোড়ায় সব বোঝাই করে বিকেলে বাড়ি ফিরে আসেন। বন্দর গ্রামে উনার বাড়িতে বসে একদিন (৩০-০৩-২০১৭) কথা হয়েছিল অনেকক্ষণ। তাঁর কথাগুলি একজায়গায় সাজিয়ে দিলাম।
“আমার মায়ের নাম বদরুন্নেসা বেগম, আব্বার নাম সেখ তরিবর। আমরা আগে ছিলাম গঙ্গারামপুরে। পঁয়তাল্লিশ বছর হবে চলে এসেছি এই বন্দরে। এমনি সময় মনোহারি ব্যবসা করি। ঝাঁকা সাইকেল আছে। ভাঙাচোরা মাল কিনি। আর মাইকে চিপে গান ভরা আছে। দিয়ে মাইক বাজে। আমি যাই পাপুরি বনগ্রাম স্রান্দি। মাল বেচি নানুরে। নানুর আমাদের বাজার। চাষের কাজ কম করি। খাওয়ার মত ধান হয়। আমরা গরীব মানুষ। বুঝলেন?
গান শিখেছি যাদের কাছে তারা সব গায়েব হয়ে গেছে। আমার নিকটজন ছিল সব। আমার স্ত্রীর জামাইদা হত। তাঁর কাছ থেকে আমি শিখেছি। এবার গুরু শিষ্য লাগল একদিন। তারপর একদিন রাতে উঠে হেঁটে চলে গিয়েছি সাইথিয়া। চামর কিনে এনে গান শুরু করেছি। এগুলো সাধনার জিনিস। এবার আমার কাছ থেকে আমার ছেলে শিখবে। ওর শিখা হয়ে গেছে। ভয় করছে গাইতে। সব পালা ও জানে। পালার মাঝে যখন চা খেতে বসি মিনিট দশেক রেস্ট নিই। দু চারটে ইসলামি গান, ফকিরি গান ও কলি যুগের গান গায়। আমাদের মুসলমানদের বিয়েতে যে গান হয় তাতে ঢোল বাজায়। আমাদের কাছে বিয়ের গান দু চার লরি আছে। কত নেবেন? হিন্দুরাও মানত করে। বর্ধমানে খণ্ডঘোষ থানায় যাই। ওখানে হিন্দুদের ঘরে গান করেছি। আজ যেমন মুসলমানদের ঘরে গাইব, কিন্তু পাড়াটা হিন্দুদের। মুসলিমদের গান হিন্দু পাড়ায় হবে। কার্তিক মাসে বর্ধমানের ভাতারে একটা গ্রামে পীরের থানে দশ দিন গান করে এলাম। জয়নাল উদ্ধার কাহিনী। আমরা আমাদের মত সাজিয়ে নিই। এই গেল পাথরচাপরি মেলায় আমাদের বায়না দিলে মুসলমানি বিয়ের গান গাইতে হবে। যাব। হাসাবার জন্য রঙ্গ রসিকতা করতে হয়। ওটা বলা হয় কমিক। লেটো গানের মত কথা কাটাকাটি হয়। কিন্তু লেটোর ছকে গাওয়া হয়না। মানে খারাপ কথা হয়না। ওখানে মেয়েছেলে বেটাছেলে থাকবে। শিক্ষিত অশিক্ষিত বিভিন্ন ধরণের মানুষ থাকে। তাই। এইসব গাইতে আমাদের বই লাগে না। সব মনে থাকে।
|
যেটা গলসি যাব বলছি, ওখানে চার রাতে চারটে বই হবে। পালা যে একটা শিখেছি তা তো নয়। বিভিন্ন ধরণের শিখেছি। যেমন কোন পীরের কাহিনী দিয়ে একটা বই হয়। কোন বাদশার কাহিনী দিয়ে একটা বই হয়। কোন নবীর কাহিনী দিয়ে একটা বই হয়। যেমন ইসুবালা ইউসুফ নবি বিবি জোলেখা, যেমন ইব্রাহিম নবি, মুসা নবি, ইসা নবি। আমার ঘরে কোরান শরিফ আছে। বারো নম্বর সুরায় আছে। চোদ্দ নম্বর সুরা হচ্ছে ইব্রাহিম। ইব্রাহিম খলিলুল্লা যে ইসমাইলকে কুর্বানি দিয়েছে। বুঝতে পেরেছেন? এই মশাটা কোথা থেকে এল? মশাটা হচ্ছে ইব্রাহীম নবীর সৈন্য। যুদ্ধ করতে গিয়ে পেরে উঠছে না। তখন নাকে ঢুকে গেল মশা। আর সৈন্যগুলোকে সব মশাতে কামড়াতে লাগল। সব যুদ্ধ করা বাদ দিয়ে গাঁ দিকে ছুটতে লাগল। কুয়াশার মত আল্লা মশা পাঠিয়ে দিল। বুঝলেন? এমন বিরাট বিরাট ঘটনা আছে। খাজা মইনুদ্দিন চিস্তি- গরীবের নামাজ, আজমীঢ়ে। পৃথ্বীরাজের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিল। যেমন বড় পীর আবদুল কাদের জিলানী। যেমন ধরুন আমার হজরত মহম্মদ। যেমন রুস্তম সুরাব। বাপ বেটার লড়াই। বেটাকে বিনা পরিচয়ে ওর বাবা মেরে দিলে। ওইসব কাহিনী আমার নখে, সব মুখস্ত। এমন এমন বই আছে। যেমন আজান নসাদ। হিন্দু মুসলমানের লড়াই। সমাজ হিসেবে গান হয়। সব গান সবখানে হয় না। গাজী কালু চম্পাবতি বই। গাজী একটা শাহ্ সেকেন্দার বাদশাহর ছেলে। কালুকে দরিয়া থেকে তুলে নিয়ে এল। চম্পাবতি আর গাজীর রূপ একই রকম। পরীরা তুলে নিয়ে এসে মসজিদের ভিতর পরীক্ষা করছে কার কেমন রূপ। ঘুমন্ত অবস্তায় তুলে নিয়ে চলে গেল। চম্পাবতি আবার ব্রাহ্মণের মেয়ে। তাহলে দেখছেন সব সমাজে সব গান শুনবে না। আপনি কত পালা নেবেন? এসব কিতাবে লেখা আছে। নবী সাহেবের পাঁচ পুরুষ থেকে ধরে এলে টানা চোদ্দ রাতের পালা আছে, সেও গেয়েছি। বাদশাহি পালা আছে। মহরমের সময় কারবালার পালা গাই। পীরতালার উরসে গান গাই। আঠাশ রাতে পৃথিবী সৃষ্টির কাহিনী আছে। গোলেনুর মনোহারা – একদিনের ছেলের সঙ্গে বারো বছরের মেয়ের বিয়ে। শহিদে কারবালা। মানে কিতাবের আমার কাছে শেষ নাই। যা গান জানি একবছর গান করা যাবে। আমি এই গান চুয়াল্লিশ বছর করছি। বছরে দেড়শ নাইট একশ আশি নাইট গান গাই। যেমন ধরুন যখন কেউ ছড়া শুনতে চায়। দেখলুম দূরে একটা মার্ডার হয়েছে। সেইটা কেন মারল, কি কারণে মারল কি হল না হল এগুলো সব ঢোলের তালে কথায় কথায় বলি। আমাদের মানে বই লাগে না। নানুরের ঘটনা ধরুন বর্ধমানে গেয়ে শোনালাম। আমায় কাহিনীটা বলে দিলে আমি তরজার মত কবির মত গেয়ে শুনিয়ে দেব। মানে হিস্ট্রি বলতে পারেন। যে অমুক গেরামে এই এই ঘটনা হয়েছে, ছিনতাই করেছে, কি মেরে দিয়েছে, কি বিয়ের ব্যাপারে মারা গেল। তবে পাটিগত গল্প বলি না। কোন দল এসে গান থামিয়ে দেবে তার ঠিক নেই। কোথায় তিনমুল কোথায় সিপেম তো আমরা ধরুন জানি না। এখন মজা করতে গিয়ে কেউ যদি বম নিয়ে চলে আসে? কেউ কাঠি দিয়ে কাটবে। মানে পিস্তল। এখন রাখাল বাগাল বম নিয়ে খেলা করছে। আমরা এমন কাহিনী তাই বলি না।
গেরামের পাশে একরাতে গান করলে বারশ টাকা দেবে। দূরে হলে আড়াই হাজার দু হাজার দেবে। মেদনীপুর গেলে ছহাজার টাকা লাগবে একরাতে। আর গাড়িভাড়া। গেছি আরামবাগের ওদিকে তেলিপুকুর। চাঁচাই গেছি। বাঁকুড়া ইন্দাস হুগলী সব গেছি। পাকুড় এইদিকে গেলে দুহাজার আড়াইহাজার এমন নিই। চারটে লোক। দুয়া নেওয়ার জন্য সব দশ বিশ টাকা দেয়। ধরুন একজন এল অমুকের কেন বিহা হলনা জানতে চাইল? ঠিক আছে। ওর যে কেন বিয়ে হল না সেটা আমাকে ব্রেন খাটিয়ে বলতে হবে। যে এই কারণে ওর বিয়ে হয় নাই। আপনার নামে দশ টাকা দিলে আপনি তো আর পড়াং করে রেগে যাবেন না। আপনাকেও তাতাইতে হবে। তখন আপনি ডবল দেবেন। একে খানিক রাগিয়ে দেবেন। সে আবার চল্লিশ টাকা দিয়ে দিল। এইভাবে বেশ রঙ্গ হয়। কাউকে ভালবাসা দিয়ে পয়সাটা আদায় করতে হয়, কাউকে রাগিয়ে পয়সাটা আদায় করতে হয়। এ মানে অনেক রকমের কৌশল।
|
চল্লিশ বছর আগে হবে। বাতাসপুরে স্টেশনের ধারে গ্রামে গান করছি। এক মুরুব্বির মত ব্রামহন, একশ বছর বয়স হবে, দিয়ে আমাকে বলছে, বাবা তুমি খুব চালাক। আমি বললুম কেন
বলুন তো? তখনকার যুগে পঞ্চাশ টাকা বিরাট ব্যাপার। বাজী ধরে বললেন, সত্যপীরের গান অনেক শুনেছি, কেউ জবাব দিতে পারেনি।
বল দেখি হনুমানের মাথায় কবে শেয়াল রা কেটেছিল বল দিকিনি। কি রকম প্রশ্ন দেখুন। আমি
বললুম চেষ্টা করব। গান গাইতে গাইতে গাইতে গাইতে ব্রেনে চলে এল। একটা হিন্দুদের
মেয়ে আশীর্বাদ চাইতে এসেছে- আমি বললাম, তোমায় আশীর্বাদ করবে
রাম রঘুবান- আমার দোয়ারি বলল- আর আশীর্বাদ করবে বীর হনুমান। যখনি বলেছে কথাটা চলে
এল। কেন চলে এল? যখন বিশল্যকরণী আনতে যায় হনুমান লক্ষণের
জন্যে গন্ধমাধবে, হনুমান তো জানেনা বিশল্যকরণী কোনটা,
চিনে না বলে পাহাড়টাকে তুলে নিয়ে চলে আসছে। সেই পাহাড়ে ছিল শিয়াল।
দিয়ে হুকি হ হুকি হ বলে ডাক দিয়েছে। সেই শুনে আমায় একশ টাকা দিয়ে দিলে। তখন তিরিশ
টাকা পচিশ টাকা এক রাত গান করে পেতাম। বলল, বটে বাবা,
বহু গায়ককে শুধিয়েছি কেউ জবাব দিতে পারেনি। দেখুন তাহলে। আসলে কি
বলি, সরস্বতী সদয় না হলে গান বাজনা বিদ্যে হয় না। এমন এমন
মানুষ আছে কিতিক্যাল একটা একটা প্রশ্ন করে। আমি তো সেখানে ধুলোপীর হব না। হারা
যাবে না। তা হলে আমার সম্মানে লাগবে। লাগবে না? বলে বেড়াবে
অমুক মূল গায়েনকে এই প্রশ্ন করেছি বলতে পারেনি। বলবে না? আমি
কোথাও হেরে আসি না। একটা আসরে একটা মেয়ে আসরে চিঠি লিখে পাঠাল, ডিমের ভেতরে বাচ্চা মরল, তার নিশ্বাসটা কোথা দিয়ে
বেরোল? কি বলবেন আপনি? মারাত্মক প্রশ্ন
নয়? আর উত্তর বলে দিলেই তো পালাবে। আমিও টাইম হলে বলি। সেই
উত্তর শোনার জন্যে বসে থাকে। উত্তর বলে দিলেই গান শেষ।”
এদিকে
আড্ডার সময়ও শেষ। দুয়ারীরা হাজির অনুষ্ঠানের জন্যে। প্রতিশ্রুতি দিলেন, সময় পেলেই আবার একদিন কথা হবে। তার দলের
সঙ্গেই আমরা পুন্দরা পৌঁছলুম সন্ধ্যে সাড়ে ছটার সময়। পুত্রের মঙ্গল কামনায় মানসিক
করেছিলেন এক ভক্ত। সত্যপীরের নামে গান শোনালেন গ্রামের সকলকে। সাজাহানদা সামান্য
মেকআপ নিয়ে পরলেন জমকালো পোশাক। হাতে নিলেন চামর। আসর বসল খামারের মত ফাঁকা
জায়গায়। পীরের মাজারটা আলাদা করে অন্ধকারে চোখে পড়ল না। একটা লোহার তরোয়াল মাটিতে
গেঁথে পীর-পয়গম্বর, কৃষ্ণ-বলরাম,
সাবিত্রী-সত্যবান, শিব-পার্বতী, ওস্তাদ-শিক্ষাগুরু,
মাতা-পিতা, চৌদিক-আসর, সত্যপীর
বন্দনা করে শুরু করলেন ‘আলী-দিলবাহার’ পালা।
সাক্ষাৎকার গ্রহণের
তারিখ ৩০-০৩-২০১৭
সাক্ষাৎকার ও লেখা সুব্রত ঘোষ
স্থির চিত্র- সুব্রত ঘোষ
সাক্ষাৎকার ও লেখা সুব্রত ঘোষ
স্থির চিত্র- সুব্রত ঘোষ
No comments:
Post a Comment