Sunday, April 12, 2020

শর্মিষ্ঠা-র ছোটগল্প






সিস্টেম

শেষ গাড়ি

পুরোনো কালের সুইচটেপা ছোটো ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে রেখে মজিদ বলল। "দাদা বলতাসিল, পদাতিক ক্যানসেল হইগেসে।"

"অত সিন্তা করতে লাগবা না। ব্যাগে শতরঞ্জী আসে। গাড়ি ফেল হলে গতবারের মতন, জুড়ানো সিঙাড়া খেয়ে, রাতে নাক ডাকাবে এখন স্টেশনে! " বলে ফিক করে হাসলো শামীমা।

শামীমা আজ খুব ভালো জামাকাপড় পরেছে। জরি চুমকির জারদৌসি তুঁতে সালোয়ার খানা আজ শাটিম থেকে বেরিয়েছে। ডাক্তার দেখানো রোজের ব্যাপার তো আর না! যৌথ পরিবার, সন্তান সব পিছনে ফেলে শুধু বরের সাথে কলকাতা আসার ঘটা আর কোনো উপায়ে সম্ভব ছিল কি?

শামীমার বর, মজিদ, লোকটির গা ঝকঝকে কালোকপাল, চোখ, গালের হনু আদিম গুহাবাসী মানুষের মতো। চোখগুলি সারাবছরই অল্প লালচে। দাদার মত না নিয়ে কোনো কাজ করা তার ধাতে নেই। সবকথাতেই ঘাড় নেড়ে রাজি হয়ে যাওয়া সেজ ছেলের সমস্ত রকম লক্ষণ তার মধ্যে বর্তমান। মনের রাজপথ-ঘুরপথ প্রায় সবই মানুষটির সহজ - সাদা, নুড়ি বিছানো ধরনের

শামীমার কথায়, কপালে চিন্তার ভাঁজ সরিয়ে, চেষ্টা করে হাসে মজিদ। তারপর ধীরে ধীরে বলে, "কাল তো আবার সানোই।"

"ইস্কুলের অডার ধরতা জাওয়া?"  

মজিদ কিছু না বলে মুখ নীচু করে নখ কামড়ায়। শেয়ালদা থেকে লাস্ট গাড়ি এগারটায়। সেটার দিকেই তাকিয়ে ছিল মজিদ। কিন্তু সে গাড়ি না চললে এখন হয় গৌর কিমবা গরীবরথ ভরসা। অত তাড়াতাড়ি কি আর দেখানো হবে? গাড়ি ধরতে পারায় তেরো আছে আজ।

কাল সেঞ্জোসেপ স্কুলের অর্ডার ধরতে যাওয়া আছে মজিদের। সেইন্ট জোসেফের ডাকনাম এবং ভালোনাম দুই-ই এখন এলাকার লোকের মুখে মুখে, ‘সেঞ্জোসেপ’ হয়ে গেছে। এই বুধবারটির দিকে পথ চেয়ে বসে আছে মজিদ কতোদিন। সকাল সাড়ে দশটার মধ্যে হেডদিদিমনির রুমে পৌঁছতে না পারলে, অর্ডারটা এই বছরের মতো হাত থেকে বেরিয়ে যাবে। হয় মনোরমা কিমবা আবরনী টেলর্সের হাতে। আজকাল অনলাইন সেল আর রেডিমেডের যা রমরমা! স্কুলড্রেসেই যা একটু হাতে কিছু আসে। সারাবছর খালি ফলস-পিকো আর ব্লাউজের উপর দিয়ে চললে শামীমার অপারেশনের জোগাড় এই ঈদে কেন সামনের ঈদেও হবে না।

শামীমার লুকোনো টাকা সব তো এই যাতায়াতেই উবে যায়! ভোর ভোর উঠে রান্নাঘর, সন্তান সামলায় শামীমা। তারপর খাওয়াদাওয়া চুকলে চৌকির তলা থেকে কুলোটি টেনে এনে বসে বারান্দায়। কুলোর কোলে বিড়িপাতা, মশলা আর মায়ের স্মৃতি জড়ানো কাঁচিটির ডালা সাজিয়ে হাঁটুর উপর থুতনি রেখে বসে। মা যেমন বসতো তার ছোটোবেলায়। অন্য আরও দুটি বোন ও একটি দিদির মতো জরুরী অভ্যাসে পাতা পাকায় সেও। সারাদিন একটি একটি করে সাত-আটশো-হাজারখানা বিড়ি বাঁধে শামীমা। তারপরও কটা টাকাই বা আঁচলে বাঁধা পড়ে তার!

টিউমারটা এখন আসলে তাদের কাছে কোনো সমস্যার নয়। ওটা সরিয়ে রেখেই ভাবতে হবে। কারণ চারভাইএর এতোবড় পরিবার, যেখানে মজিদের আয় নামমাত্র, সেখানে দিন চলা বা চালানোটাই মোদ্দা সমস্যা। নিজের ভাগের তিন তিনটে সন্তানকে দুবেলা ভরপেট খাবার আর ছিটেফোঁটা লেখাপড়া জোগাতে পারাটাই রূপকথা। কাল নেহাত পেট ব্যাথায় ফিট হয়ে গেছিল শামীমা। নাহলে আজকে হঠাত এভাবে আসার তো কোনো কথা ছিল না!
~





উপভাষার সুর

'দিদি-ই, আপনের নাম্বরটা মোকে দিবেন?'

দিদি-ই টানটি বেশ সুরেলা। অমৃতার ঠিক বাঁ-পাশে বসেছিল রোগাসোগা মেয়েটি। হাতের লোম তার চকচকে সোনালী। চোখের কোনা দিয়ে তার হাতলে রাখা হাতটুকু আগ্রহ নিয়ে দেখছিল অমৃতা। গলা শুনে এবার তাকাল সোজাসুজি। মেয়েটি শামীমা।

‘কিছু বলছেন?’
'আপনের ক নাম্বার দিদি-ই?
'পাঁচ’।
'আমাদের
সব্বিশ'। গলা নামিয়ে বলল মেয়েটি। তারপর নিজেকেই নিজে শোনাবার মতো করে বিড়বিড় করল সে। 'ম্যাডাম আজ লেট করে দিলেন। সাড়ে পাঁসটা বেসে গেল। অ্যাখনো...'

ক্লিনিকের দোতলা। সারি সারি সাদা চেয়ার পাতা। যেন অনিচ্ছুক বড়দের
 ক্রেশ। সবাই উসখুস করছে। ঘড়ির দিকে বারবার তাকালেই কি ঘড়ি তাড়াতাড়ি চলে? না মনে হয়।

'ট্রেন ধরতে হবে দিদি-ই! স্টেশনও তো সে অনেকখানি। মালদা পৌঁসাতে পৌঁসাতে সেই সকাল হয়ে
সাবে।'

'মালদহ? সে তো অনেক দূর! অতো দূর থেকে আসছেন?' অমৃতা একটু ইতস্তত করল, 'ওখানে বোধহয় ডাক্তার নেই ভালো, না'?

'আসে। অনেক দেখা
য়েসি। ধরতে পারে নাই। এ ম্যাডাম বলতাসেন, টিউমার আসে। একসিরা করে দেখবা লাগবে। একবার করায়েসি, সানেন! পাঁস মাস আগে। বলতাসেন আবার দেখবা লাগবে। সকাল আটটা থেকে বসে আসি। একসিরারিপোর্ট দেখাব ম্যাডামকে, দেখেননা, বসে আসি তো আসিই।'

'সেই তো!' শহরের মানুষেরা, 'আই ডোন্ট কেয়ার'কে শুকনো মুখে 'সেই তো' বলা অভ্যেস করে রাখে

'
সারাটা দিন সাইলো। বিকাল সারটার সময় হ্যারা বলতাসে, ‘নাম ল্যাখান, পয়সা দিয়ে জান’। বলতাসে, 'অ্যাটা রিপোর্ট দেখানো লগে সশো টাকা দিবা লাগব। ঐ ন, বুজলেন দিদি-ই!লিপস্টিক মাখা, শাড়ি প্লিট করা, এয়ারহোস্টেসের মতো তরুণীটির দিকে ইশারায় আঙুল দেখিয়ে শামীমা ফিসফিস করল,এখন বলসে-এ, সব্বিশে নাম। ট্রেন কি করে আর পাব দিদি-ই?' ভাষায় এতো সুর থাকে? অমৃতাকে সুরটা একটু একটু করে কাছে টেনে নিচ্ছিল। 

হাসলো শামীমা। চোখে চোখ রাখা সহজ হাসি।
'বারবার আসা জায়, বলেন দিদি-ই? গাড়ি, ডাক্তার, অষুধ, টেস্ট, থাকা, খাওয়া - অ্যাতো পয়সা পাবো কোইত্তে?
- দিদি-ই আপনের নাম্বরটা মোকে দিবেন?' 

অমৃতা ছোটো করে ঘাড় নেড়েছিল। 'দেব।'                                
বরেন্দ্রভূমির ভাষায় অদ্ভুত এক সুরের মায়া খেলা করে। মহানগরের মানুষ বেসুরের ট্র্যাফিকে অভ্যস্ত। সে সাধারনত শোনে ও শোনায় হিন্দি-ইংরাজির পপকর্ন। বাংলা ভাষার এতো সুরের জন্য তার কান তৈরী থাকে না।

শামীমার গলার দিদি-ই ডাকে কি যেন একটা ছিল। অপ্রস্তুত অমৃতা খানিক হিপনোটাইজ্ড মতো হয়ে গিয়েছিল তাতে। 
~
সুযুক্তি

একজন পেশেন্ট - গড়ে দশ মিনিট। সেই হিসাবে পাঁচ থেকে চব্বিশে নামলে, উনিশ জন পেশেন্টে মোট দেরীর পরিমাণ দাঁড়ায় তিন ঘন্টারও বেশী।

শামীমাকে দেওয়া কথা রাখতে গেলে, অমৃতার এখন তার পার্টনারের অনুমোদন লাগবে। বাচ্চা কাঁধে সারাদিনের ডাক্তার দেখানোর প্রজেক্টে আরও তিনঘন্টা দেরীর প্রস্তাবে সায়ন নিশ্চয় খুব খুশী হবে না!
 বাদশার হাতে মোবাইলটা গুঁজে দিল অমৃতা। এখন সে খানিক ভিডিও টিডিও নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। মা বাবাকে খুঁজবে না।

কিছু একটা পাকিয়ে উঠছে, অমৃতা আর তার পাশের জনের মধ্যে। দেয়ালে হেলান দিয়ে, ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে, অনেকক্ষণ ধরেই লক্ষ্য করছিল সেটা সায়ন। ছেলেকে বসিয়ে রেখে, অমৃতা এখন উঠে গেল সায়নের কাছে। ছোটো করে তাকে বোঝাবার চেষ্টা করলো সমস্যাটা।

সবটাই বললকিন্তু শামীমার বয়ানের সবথেকে জোরের জায়গা, যেটা সে অনুবাদ করে উঠতে পারলো না - তা হলো ভাষার ঐ লুকোনো সুরটুকু। সুরকে যে ভাষায় সাজানোর চেষ্টা করা বৃথা, সায়নের মুখে বিরক্তির রেখা পড়ে সেটা স্পষ্ট বুঝলো অমৃতা।

আমরাও তো সেই সকাল থেকে বাচ্চা নিয়ে নাকানি চোবানি খাচ্ছি! খাচ্ছি না?’ - চাপা গলায় সায়ন লে উঠল। সিস্টেম আছে তো সব কিছুর একটা! উনি জনে জনে পেশেন্টকে কনভিন্স না করে, ডাক্তার এলে তার সাথে কথা বলুন - অ্যালাউ করার হলে তিনি করবেন!' সায়নের কথাগুলোও খুব ফেলে দেবার মতো না। কিছু সুযুক্তি সেখানে নিশ্চয় আছে।

সুরের ঘোরটা কেটে গেল অমৃতার। একরকম মন গুছিয়েই নিল সে। হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি দেখানো হয়ে গেলে সময়ে বাড়ি পৌঁছনো যাবে। বাদশাকে টাইমে খাইয়ে, ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া যাবে। এমনকী হয়তো শোবার আগে নেটফ্লিক্সে একটা ভালো সিনেমাও দেখা হয়ে যেতে পারে।

রিসেপশন এলাকাটা বড়ো ছোটো জায়গা। অমৃতাকে কিছুই বলতে হলো না। শামীমা দুজনের বডি ল্যাঙ্গোয়েজ থেকেই বুঝে গেলো পরিস্থিতি। নম্বর দেবার ব্যাপারে অমৃতার আর মত নেই। 

থাকার কথাও কোনোদিন ছিল না অবশ্য। হাজারটা এমন অসম নিয়মকানুন তো সংসারে চিরকালই আছে। আর পৃথিবী যদ্দিন মানুষের দখলে, তদ্দিন থাকবেও। কেউ তার বেড়ার ভিতরে বসে নিজেরটুকু গুছিয়ে নিতে ব্যস্ত হবে আর যার উপায় নেই সে বেড়া বাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করে চলবে। ঐ ওরই মধ্যে যে যেমন করে পারবে একটু করে বেঁচে নেবে।
~



দেশোয়ালী বোন         

শামীমা ব্যাগটা সীটে রেখে, জরির ভারী ওড়না মাথা ঢেকে, কানের পাশে ঘুরিয়ে নিতে নিতে উঠে গেল। সামনেই ওয়াশরুম। হাতল ঘুরিয়ে ঢুকল শামীমা। বন্ধ হয়ে গেল সাদা দরজাটা।

দুনিয়ায় যা কিছু ঘটে, তার সবটাই ব্রেকিং নিউজ নয়। একেবারে সাধারণ ব্যাপারও নেহাত কম ঘটে না। আর তারই মধ্যে কিছু কিছু ঘটনার খোলামকুচি, এক একজনের ভিতর ফুঁড়ে ঢুকে যায়। কি সব তল্লাশি চালায়। অমনিই প্রায় যমজ একখানা ঘটনা খুঁজে পেতে তুলে না আনা অবধি যেন ছাড়ান নেই।
সাদা দরজাটা বন্ধ হয়ে যেতেই আরেকটা ঠিক এরকমই সাদা দরজার নব ঘুরিয়ে নিভে যাওয়া মুখ করে বেরিয়ে এলো ষোলো বছর আগেকার অমৃতা। ক্লিনিকের সীটে হেলান দিয়ে অনায়াসে পিছনে হেঁটে গেছে সে। দু হাজার তিন সালের কলকাতায়।

সবে তখন শহরে এসেছে সে মা বাবার হাত ধরে। অটো, বাস, ট্রাম, ট্যাক্সি, ফেরী, মেট্রো সব একে একে চড়ে চড়ে জানছে, জনসমুদ্রে সাঁতরে চলার নিয়মকানুন। ঘেমো, ভিড়ে ঠাসা, ভিখিরিময়, ন্যাংটো একটা শহরকে সে দেখে ফেলছে বিভিন্ন ফুটপাতের ধারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। 

আবার শপিং মলের ঠান্ডা করিডরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মেপে নিচ্ছে কাচে ঘেরা স্নব কলকাতাটিকেও। সুদৃশ্য নারী পুরুষ, মৃদু সেন্ট মাখানো হাওয়া, ব্রাউণী, চিজ কিংবা পপকর্ণের হঠাৎ হঠাৎ কয়েক দমক গন্ধ। অ্যাড আর আলোর বাড়াবাড়ি চোখকে প্রশ্ন করতেও ভুলিয়ে দিচ্ছে সেসবখানে।
 

অমৃতার গায়ে তখন ঢিলেঢালা, রঙ জ্বলে যাওয়া, সুতির চুড়িদার। প্লিট করা ওড়না। তাকে দেখেই বোঝা যায় টেইলর বা কাস্টোমার দুজনের কেউই খুব একটা ফ্যাশনদুরস্ত নয়। কানে সোনার রিং। নারকোল তেল ঘ
ষা চুলে সটান একটা বিনুনী। বাঁ হাতের কোলে রুমাল। ঘড়ির অভ্যেস সবে ধরেছে। মাধ্যমিকের পর। 

চশমাটার স্ক্রু খুলে গিয়ে একটা ডাঁটি আলাদা হয়ে গিয়েছিল তার। বিনা চশমায় সে তো বাসের নম্বরও পড়তে পারে না। এ অবস্হায় চশমার শোরুমটা সামনে পেয়ে কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছিল।

উর্দিধারী হাসিমুখ অ্যাটেনডেন্টরা অবশ্য অল্প কয়েক সেকেন্ডেই বুঝে নিয়েছিল, যে এখান থেকে চশমা করাবার রেস্ত তার পার্সে নেই।

অতএব দূর থেকে চশমাটার উপর একবার চোখ বুলিয়েই বিরক্তমুখে জানাল একজন, ‘ইটস নট আওয়ার ব্র্যান্ড। উই ডোন্ট রিপেয়ার দেম হিয়ার'।

‘প্লীজ ঠিক করে দিন না। ওটা ছাড়া আমি দেখতে পাই না। কত লাগবে বলুন - দিয়ে দেব আমি’। গলা শুকিয়ে আসছিল অমৃতার।

ম্যানেজার ভদ্রলোক চেয়ার থেকে উঠে এসে গলা নামিয়ে বললেন, ‘উই কান্ট হেল্প ইউ। প্লীজ গো অ্যান্ড ফাইন্ড সাম চিপ শপ - অ্যাট বৌবাজার মে বী’।  

তখনও মুখে তড়বড়ানি রপ্ত হয়নি। কোনখানে, কীভাবে ইংরেজির আধুলি ছুঁড়ে মারতে হয় আর কোথায় গোঁয়ারের মতো গোদা বাংলা, তেমন এলেম তৈরী হয় নি। লজ্জায় এতোটুকু হয়ে গিয়ে সেখান থেকে স্রেফ পালিয়ে বেঁচেছিল অমৃতা। নিজেকে একটা পোকার বেহদ্দ লেগেছিল। ঘুরে ফিরে সেদিন সারাদিন খালি, ধুলো রাস্তার পাশে, কুন্ডু অপটিক্যালের ধুলো কিচকিচ দোকানটা - স্ক্রুডাইভার হাতে প্লাস্টিকের টুলে বসা বাচ্চুকাকুর হাসিমুখখানা বারবার মনে পড়ছিল।

শামীমা চোখে মুখে জলহাত বুলিয়ে সাদা দরজাটা ঠেলে বেরিয়ে এলো। চোখের কালো সুরমার টান তার কিছুটা ঘেঁটে গেছে।

ষোলো বছর আগের অমৃতাও এতক্ষণে রুমালে চোখ মুছে নিয়েছে। চোখে মুখে জল দিয়ে, শপিংমলের বাথরুমের সেই সাদা দরজাটা দিয়ে বেরিয়ে এসেছে তখনকার অমৃতা। এই এখনকার অমৃতার মুখোমুখি বসবে সে এখন। ফিরে তাকাবে শহরের খোপ কাটা দুনিয়াদারির ওপারে। যেখানে গাছ আর মাঠে হেলান দিয়ে বড় হয় মফস্বল। খুলে ধরবে নিজের মফস্বলি রোজনামচা। এখন সে নানাভাবে এই অমৃতাকে অন্তত এইটুকু বোঝাবার চেষ্টা করবে যে, শামীমা আসলে তার বড়ই আপন কেউ।   
সেই শামীমা। যার কালো চুমকি বসানো ব্যাগে, একটা রাতও হোটেলে থাকার আর পয়সা নেই। মাথা গুঁজে রাতটুকু কাটিয়ে দেবার মতো কোনো আপনজন নেই তার এ শহরে। এইমাত্র মজিদ, দুজনের রাতের খাবার, একটা পাউরুটির প্যাকেট জোগাড় করে ফিরল।
~


পিকপকেট

'ডাক্তার আসতে তো দেরী আছে, চল্ না, নীচে গিয়ে একটু চা-টা খাবি?' অমৃতা পায়ে পায়ে উঠে এসেছে সায়নের কাছে।

ক্লিনিকের বাইরে একটা ঝুপড়ির সামনে গিয়ে পৌঁছেছে ওরা। বাদশা এতোক্ষণে সায়নের কোলে ঘুমিয়ে পড়েছে। তাকে ঘাড়ে নিয়ে সায়ন, 'দুটো চা দেবেন!', বলে। গুমটির সামনে থেকে একটু সরে দাঁড়ায় তারা। রাস্তার আলো জ্বলতে শুরু করেছে।

‘ধরে নে, আর কিছু না, একজন মফস্বলের মানুষকে আমি কমফোর্ট দিতে চাইছি!'

'কিন্তু তুই জানিসও না ও সত্যি বলছে কি না! লোকে নিজেরটুকু গুছিয়ে নেবার জন্য আমাদের দেশে কি কি করে তোর ধারণাও নেই। মনে আছে তোর সিটি সেন্টারের বাইরে সেই লোকটার কথা? তুই তো ছিলি! দেখিসনি?’ বাইরের পরিবেশে এসে সায়নের গলা এখন বেশ শান্ত শোনাচ্ছে। শান্ত, কিন্তু নিজের অবস্হানে অনড়।

হ্যাঁ। অমৃতার ভালোমতোই মনে আছে। তখন সদ্য চাকরী সায়নের। অমৃতা তখনও জয়েনিং পায়নি। শনিবা
রের সিটি সেন্টার। বিকেলের আড্ডা সেরে ওরা দুজন, সেদিনও চা খাচ্ছিল। তবে সেটা এমনি পাতি খুরির চা নয়, শপিংমল সুলভ দামী, লম্বা ভাঁড়ের কেশর দেওয়া ‘মাশালা-টি’। 

অমৃতাই প্রথম দেখেছিল, পেস্তা রঙের শার্ট পরা বয়স্ক ভদ্রলোকটিকে। সায়নের পাশে এসে দাঁড়িয়েছি
লেন তিনি সাধারন বাঙালী বাবাদের মতো, শার্ট প্যান্ট চশমা পরা। মাথার চুল সাদা। হাতে একটা মাথা বাঁকানো কালো লাঠি। লাঠির মাথায় রাখা শিরা উঁচু হাতখানা বেশ কাঁপে
খানিক কিন্তু কিন্তু করে সায়নকে জিজ্ঞাসা করলেন,'এক্সকিউজ মি! বাবা, একটু শুনবে?' 

'হ্যাঁ, বলুন!'

'আমি
... মুর্শিদাবাদের লোক এই এদিকে বিধান নগরে এসেছিলাম এক বন্ধুর ফিউনারেল অ্যাটেন্ড করতে। কোথায় যে পিকপকেটটা হয়ে গেল! ইয়ে, মানে মোবাইলটাও গেছে।' এখনো মনে আছে, ভদ্রলোক হিপ পকেটে হাত ঢুকিয়ে দেখালেন তলাটা কাটা। সায়ন কিছু বলছিল না, তবে ইমোশনটা তখন-তখনই খেয়ে গেছিল নিশ্চিত। কলকাতায় তারও পিকপকেট কম হয়নি!

'আমার পায়ে আবার একটু সমস্যা আছে। বুঝলে বাবা? এতোটা রাস্তা পাবলিক ট্রান্সপোর্টে একা একা যাতায়াত করতে পারি না আর। বুড়ো হয়েছি তো! গাড়ি নিতে হয়। তোমার যদি বাবা কোনো অসুবিধে না থাকে, দেড়দুহাজার টাকা …’।

সায়ন চুপ করে শুনছিল।

'দেখো ইয়ংম্যান, আমার দুই ছেলে আছে। তোমার চেয়ে বড়ই হবে। দুজনেই তারা অনসাইটে থাকে এখন। মূর্শিদাবাদে বুজলে, আমার নিজের বাড়ি, একটা নিজস্ব পরিচিতি আছে। এভাবে অচেনা কারো কাছে সাহায্য চাওয়াটা আমার পক্ষে নেহাত লজ্জার বিষয়। '

কয়েক মুহূর্ত ভাবতে সময় নিচ্ছিল সায়ন। ভদ্রলোকের কথা যদি বাই এনি চান্স সত্যি হয়? এরকম পরিস্থিতিতে তো তার নিজের বাবাকেও পড়তে হতে পারতো! বন্ধুর ফিউনারেল অ্যাটেন্ড করতে এতোদূরে এসেছেন যখন তখন বন্ধুটি নিশ্চয় খুব কাছের। ছেলেরা কাছে থাকে না। পায়ের সমস্যা। এই বুড়ো বয়সে লোকটি কি আর তার নিজের পকেট কেটে এতোগুলো মিথ্যে কথা বলছেন? 
বেশী আর বোঝাতে হয়নি সায়নকে। বিশ্বাস করে ঠকার কিছুটা রিস্ক নিয়েও লোকটিকে সে দুহাজার টাকা আর নিজের কার্ড দিয়ে বলেছিল, 'সাবধানে যাবেন। যতো রাতই হোক, বাড়ি পৌঁছে একটা খবর দেবেন।'

‘এই তো! কার্ডে তোমার অ্যাড্রেস, ফোন নম্বর সবই আছে। আমি গিয়েই তোমায় কুরিয়ারে চেকটা পাঠিয়ে দেব।’

তখন ওলা উবের ছিল না কলকাতায়। ভদ্রলোক কষ্ট করে, লাঠি ঠুকে ঠুকে, পা টেনে টেনে গিয়ে, একটা দাঁড়িয়ে থাকা হলুদ ট্যাক্সিতে উঠে গিয়েছিলেন। যাবার সময় ইশারা করেছিলেন, ফোনে কথা হবে।
 এস নাইনের জানলা থেকে সেদিন সূর্য ডোবার আকাশটা অন্য অনেক দিনের তুলনায় বেশী কমলা লেগেছিল সায়নের।

দুদিনেও যখন সেই ফোন এলো না, সায়ন তখন নিজেকে বুঝিয়েছিল যে, দুমিনিটের একটা গোছানো নাটক, দুহাজার টাকা দামে সে কিনেছে।
 

সায়ন নিজেও মফস্বলের ছেলে। কিন্তু এ শহরে লাট খেতে খেতে সে এরকম অনেক দেখেছে। শুনেছে। চোট খেয়েছে। তারপর একসময় এই মহান নাগরিক সিস্টেমের সাথে সে যুঝে নিতে শিখে গেছে।

অতএব, আট বছর আগের সায়ন এই মূহুর্তে সামনে চলে এলে, ষোলো বছর আগেকার অমৃতাকে আপাতত হাল ছাড়তে হয়।
~



মাঝনদী

পকেটের ফোনটা গোঁ গোঁ করলে, ‘হ্যাঁ দাদা, বলেন’
– ঘাড় হেলিয়ে এক কানে, ফোনটা নিয়ে সে উঠে যায়। দরজা অবধি এগিয়ে যেতে যেতে সে বলে, হ্যারা অ্যাকটু সাইলেই পারে। দিবা সাস্যে না। ইশারাটা রিসেপশনিস্টের দিকে।

শামীমা একবার শেষ চেষ্টা করে। হাতব্যাগটা নিয়ে এক পা দুই পা করে রিসেপশনের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
 
প্রায় শোনা যায় না এমন গলায় বলে,
আমরা ম্যালা দূর থেকে আসত্যাসি দিদি-ই

ম্যাডাম এলে ওঁনার সাথে কথা বলুন। লিস্টের বাইরে তো আর কিছু হবে না! মাঝে ঢুকিয়েছি শুনলে ম্যাডাম আবার রাগ করবেন। তাছাড়া অন্য পেশেন্টরাই বা ছাড়বে কেন?এসব বলার সময় চোয়াল শক্ত করা একটা রূঢ় ভাব রাখতে হয় চোখে মুখে। আর বলা হয়ে গেলে দ্রুত, কম্পিউটর স্ক্রিনের দিকে মুখ ফিরিয়ে নিতে হয়। এমনই শেখানো হয়েছে মেয়েটিকে। যদিও হলপ করে বলা যায় না যে এরকম পরিস্হিতিতে, এভাবেই কথা বলতে সে ভালোবাসে।

শামীমা ধীরে ধীরে এসে বসে। প্রেসক্রিপশনের কোনা মুড়তে থাকা মজিদ ফিসফিস করে শামীমার কানে। - ‘ম্যালা সিস্টেম হ্যাদের’।

মনের তলায় তলায় দুটি মানুষ, কেউ কাউকে বলে না, রসুল চাচার টিনের চালাটির দিকে ফিরে ফিরে চায়। রসুল চাচার একচালা ঘর। জানলার শিক পেরিয়ে মাঠের গরম হাওয়া লি লি করে আছড়ে পড়ে বাংলা ক্যালেন্ডারে। লম্বা লম্বা কালো আঙুলে, চৌকো কাগজ মুড়ে মুড়ে, রসুল চাচা সাদা বড়ির পুরিয়া বানিয়ে দেয়। ক্যানসার রোগীরা শেষ কয় মাস ঘরে ফিরে, রসুল চাচার বড়ি খায়। সেরে তারা যায় না ঠিকই। কিন্তু যাবার দিন অবধি রসুল চাচা সাহস দেয়। বাড়ি বয়ে এসে বুড়োটা সবদিন দুটো কষ্টের কথা শোনে। 

আর হ্যাদের ঠান্ডা ঘর। ইংরাজি সাইনবোর্ডের গরম। 'সরি, এক্সকিউজ মী, থ্যাঙ্ক য়্যু' বাক্যির ডগায় ল্যাজায়। মফস্বলের দর্জি দোকানী মজিদ আর তার বৌ শামীমা, শহরের মহান এসব কলোনিয়াল কেতার কাছে এখনও বড় জুজু। এসি ঘরের ভারী দরজা ঠেলে ঢুকে, ডাক্তারের সাথে দুএক কথা কয়ে আসার মতো হিম্মত মজিদের নেই। সেই মুরাদটুকু জোগাতে এখনও তাকে কম করে তিনবার জন্ম নিতে হবে। 

রিসেপশনের উল্টোদিকের দেয়ালে তখন ডিসকভারি চ্যানেল অন করা আছে। মিউটে। গ্রেট মাইগ্রেশন চলছে। ওয়াইল্ড বিস্টদের সিনটা চলছে এখন। দেখা যাচ্ছে, মোটামুটি সবাই কোনো না কোনো ভাবে নদী পেরিয়েই যায়। আর খুব অল্প কিছুজন, দলছুট, দুএকখানা ওয়াইল্ড বিস্টপালাতে না পেরে জলের মাঝখানে থমকে দাঁড়িয়ে যায় আর ফাঁকা চোখে তাকিয়ে থাকে ক্রমে এগিয়ে আসা কুমীরটার দিকে। এই আমাদের শামীমা আর মজিদ যেমন এখন তাকিয়ে আছে! কখনো অপারেশন প্যাকেজগুলির চকচকে প্যামফ্লেটগুলোর দিকে, তো কখনো খচখচিয়ে প্রিন্ট হতে থাকা এটিএম মেশিনটার দিকে। 
~


টানা ও ঠেলা

বেখেয়ালে মাঝে মাঝে তারা উঁচু পর্দায় কথা বলে ফেলে - মফস্বলের মানুষের এই এক বদ স্বভাব। বাতাস যে এখানে আকাশের হুকুমতে আর নেই, দেওয়ালের খোপে খোপে ছিপি আঁটা – ভুলে যায় তারা। ভুলে যায় এখানে তাদের গাছতলার খোলা আলাপের মন-মর্জি আর চলবে না।

'দিদি গোড়ায় রাজি সিল, কিন্তু বরটা সারবাই সায় না'। শামীমার বরকে শামীমা বলছিল কথাটা। পাশে বসে সেটা স্পষ্ট শুনতে পেল অমৃতা। আরো কিছু কথা হচ্ছিল। কিন্তু আর তেমন খেয়াল করল না সে।

‘বরটা’ শব্দটায় সে একটু অপ্রস্তুতের মতো থমকে রইল। সায়ন তার কাছে বন্ধু, প্রেমিক, সন্তানের পিতা। ‘বরটা’ শব্দটা মনে মনে নেড়েচেড়ে, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে হাওয়ায় রেখে দিলো সে। এবং এই মূহুর্ত থেকে নিজের অজান্তেই মজিদ নামের ভদ্রলোকটিকে মনে মনে ‘শামীমার বর’ বলে ডাকতে শুরু করল অমৃতা। কারণ কোথাও সে আঁচ করেছে, ভীতু মানুষটা খুব চেষ্টা করছে ‘শামীমার বর’ হয়ে ওঠার।

শামীমার বর খানিক ঘাড় গুঁজে থাকার পর দোনো মোনো করে উঠে দাঁড়ালো। যাচ্ছি যাবো করে অনিচ্ছুক পাগুলো টেনে টেনে গেল সায়নের দিকে। যেদিকে মোটা কাচের দরজাটা। যে দরজাটার গায়ে লাল রঙ দিয়ে বড় বড় করে লেখা পি ইউ এস এইচ -‘পুশ’। সায়ন আর মজিদ, দুজনেই তারা দাঁড়িয়ে আছে দরজাটার দিকে।

‘বলতাসি কী, আমাদের একটু তাড়া আসিলো’। দরজাটা নয়, সে বোধহয় সায়নকে একটু ঠেলা দেবার চেষ্টা করছে, ইমোশনালি। মানুষটাকে খোলার চেষ্টা করছে, কিন্তু খুব ভালো পেরে উঠছে না।

প্রতিপক্ষকে বেশী কথা বলার সুযোগ দিতে নেই। তাতে মনটা নরম হয়ে যাবার ঝুঁকি থাকে। এসব এখন যথেষ্ট শিখে নিয়েছে সায়ন। যেটুকু আপাতত সে করতে পারে সেটা হলো, মজিদকে বুঝিয়ে দেওয়া যে, নিজে হলে এই পরিস্থিতিতে কী করতো সে!

বুড়ো আঙুলে রেডমী নোটের পাতাটা নিভিয়ে সায়ন বলে - 'আপনি এক কাজ করুন। সোজা ম্যাডামকে ডায়াল করুন

সায়ন খেয়াল করে না, লেখা ঘষে যাওয়া নোকিয়া এগারোশর ঢেউ ঢেউ বোতামগুলোর গায়ে অপ্রস্তুতভাবে হাত ছোঁয়ায় মজিদ।

মজিদের দৃষ্টি এতোটাই নির্বাক যে তা সিধে বর্শার মতো বিঁধিয়ে দিতে জানে। মজিদের অজান্তেই সায়নকে তা এখন বিঁধছে রীতিমতো। অস্বস্তি হয় সায়নের। সে তবু বলে চলে, ‘ফোন না ধরলে, রুমের ভেতরে গিয়েও কথা বলে আসতে পারেন। সেক্ষেত্রে, এমনও হতে পারে, হয়তো আমাদের অনেক আগেই আপনার হয়ে গেল!'

খুব কিছু না বুঝেই সায়নও আসলে যথেষ্ট ঠেলছে শামীমার বরকে। মজিদ অস্ফুটে বলে - ‘দেখতাসি’। তারপর মাথা নীচু করে খুব মন দিয়ে সে দেখে  নিজের পায়ের দিকে। ওখানে জুতোর গায়ে আবিষ্কার করে, কাদায় শুকিয়ে আছে গতসপ্তাহের ধুলোর ছবি।

রিসেপশনের অন্য প্রান্ত থেকে কিছু শোনা যায় না ঠিকই। কিন্তু আরো দুজোড়া চোখ, সিরিয়াল দেখার সাসপেন্স নিয়ে, পাশাপাশি বসে দেখছে শেষ অঙ্কের চাপানউতোরটুকু। সাবটাইটেল পড়ে নিচ্ছে নিজের নিজের মতো করে।
~

নিষ্পত্তি

হাত ঘেমে উঠেছে মজিদের। অনেকখানি দূরাশা আর কী হয়, কী হয়, ধুকপুকুনি নিয়ে অগত্যা সিঁড়ির ল্যান্ডিংএ অপেক্ষা করছে শামীমার বর। ফোনটোন হবে না তার দ্বারা। যদি বাই চান্স ঢোকার মুখে ম্যাডামের সাথে একটু চোখাচোখি হয় আর কী!

ম্যাডাম ঢুকলেন পৌনে ছটায়। গটমট করে। বাঁ হাতে ইয়াব্বড় হাতব্যাগ। ডান হাতে কোরিয়ান এয়ারপোর্ট থেকে কেনা জলের বোতল। লিফট থেকে বেরোতে বেরোতে, কানে ফোন চেপে আছেন ডানদিকে ঘাড় কাত করে। দেরী বিশেষে ব্যস্ততার এই অভিনয়টুকু তিনি করেই থাকেন।

শামীমার বর সিঁড়ি থেকে গলা বাড়িয়ে দেখলো হিসাবে বড়সড় ভূল হয়ে গেছে। লিফট থাকতে কি ডাক্তারের সিঁড়ি দিয়ে উঠবা লাগে?

অল্পক্ষন পরে একজন আকাশী শার্ট ট্রাউজার পরা অ্যাটেনডেন্ট ডাক্তারের টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ‘গুড ইভনিং ডক্টর। সাতাশজন টোটাল। এই লিস্টের কপি’।

‘ওয়েট করতে বলো। তার আগে আরো ছজন আর্জেন্ট আছে। পাঠিয়ে দাও।’ শামীমা আর অমৃতা সহ পেশেন্ট লিস্টে থাকা সাতাশজন আপাতত কাত হয়ে শুয়ে থাকলো ম্যাডামের টেবিলের একপাশে।

বাইরে আজকের ছয়জন অতিথি পেশেন্ট ঢোকার জন্য রেডি হয়ে আছে। ম্যাডামের সাথে তাঁদের ফোনে কথা হয়েই আছে। ইনফ্যাক্ট ম্যাডামই নাকি তাঁদের বিশেষ দরকারে ডেকেছেন।

দেরী হচ্ছে। সাতটা বেজে গেল। বাইরে রাস্তার হলুদ আলোয় স্যাঁথ স্যাঁথ করে নীল বাস পেরিয়ে যাচ্ছে। বাসস্টপে ক্রমশ ভিড় আলগা হয়ে আসছে।
অপেক্ষা আর ফুরোচ্ছেই না। স্পেশাল রিকোয়েস্টের পেশেন্টরা একে একে শেষ হচ্ছে। অনেক বেশী সময় নিচ্ছে তারা।

প্রায় পাকা অর্ডারখানা এ বছরকার মতো, হাত থেকে এভাবে পিছলে বেরিয়ে যাবে। আর নখ খাওয়া ছাড়া মজিদের কিছু করার থাকবে না। অনেকবার আঙুল মটকে, পায়চারী করে, মজিদ পায়ে পা ঘষে ঘষে শামীমার পাশের চেয়ারে এসে বসলো। প্রস্তরযুগের মানুষটি তার পাথুরে হাতিয়ারগুলিও যেন সব হারিয়ে ফেলেছে।

বসে থাকতে থাকতে হঠাৎই, অনেকটা সাহস জোগাড় করে, শামীমার বর, ‘শোনেন না দিদি,’ – শামীমার সীটের ওপাশ থেকে অল্প ঝুঁকে, এদিকের সীটে বসা অমৃতাকে বলে, - ‘আপনার কাজ সারা হয়ে গেলে পর, ম্যাডামকে একবার বলবেন, যে এরম মালদা থেকে একজন পেশেন্ট আসে-এ, শামীমা - তাকে যদি আগে একটু ডেকে ন্যান! ট্রেন ধরার ব্যাপার আসে। শুধু রিপোর্টটুকুই দেখাবে। ব্যস। এটুকু বলবেন গা! ওতেই আমাদের কাস হয়েজাবে’।   

অবশেষে সাড়ে সাতটা নাগাদ অমৃতার ডাক এলো। দেখানো শেষ হলে বেরোবার আগে অমৃতা শামীমার প্রয়োজনের কথাটুকু তুলল ডাক্তারের কানে।

'কতোজনকে আর মাঝে ঢোকাবো, বল?’ অনেক গায়নোকলজিস্টের মতো ইনিও পেশেন্টদের ‘তুই তুই’ করে কথা বলেন। ‘তবু তোরা বললিই যখন, দেখি একবার মেয়েটাকে! শামীমা নাম বললি তো? দাঁড়া, দেখি! ওদিকে আমার রিসেপশনের মেয়েরা আবার রাগ করবে।' বলে ইন্টারকমের সাদা রিসিভার তুললেন তিনি।
 

অমৃতা অল্প স্বস্তি পেল। যাক্। কাজ হয়ে যাবে, আশা করা যায়।
 বেরিয়ে এসে শামীমার দিকে চেয়ে ঘাড় নাড়লো সে। ইশারায় রিসেপশনের দিকে দেখালো, ওখানে ফোন করে ডেকে নেবেন ম্যাডাম।

অমৃতার পিছনে দরজাটা বন্ধ হলো। একটি কথাও না বলে, খুট করে ফোনটা নামিয়ে রাখলেন ডাক্তার। ভুরু কুঁচকে আছে তাঁর। এক পেশেন্টের মুখে খবর পাঠাচ্ছে আরেক পেশেন্ট! ধ্যেত। এটা আবার একটা সিস্টেম হলো? 

এই এখুনি বোধহয় ফোন আসবে রিসেপশনে।
 বাইরে শামীমা আর মজিদ রিপোর্টের গোছা হাতে রেডি হয়ে, তাকিয়েই রইল বন্ধ দরজাটার দিকে। কখন যে ডাক আসে বলা যায় না!





No comments:

Post a Comment

একনজরে

সম্পাদকীয়

একটি বিষয়ে আমাদের সকলের একমত হতেই হবে ভিন্ন মতের ও ভিন্ন রুচির বহুস্তরকে সম্মান জানিয়েও, যে, আমরা এই মুহূর্তে প্রায়শ্চিত্ত করছি। মানুষ...

বেশিবার পড়া হয়েছে যেগুলি