Tuesday, April 14, 2020

সম্পাদকীয়




একটি বিষয়ে আমাদের সকলের একমত হতেই হবে ভিন্ন মতের ও ভিন্ন রুচির বহুস্তরকে সম্মান জানিয়েও, যে, আমরা এই মুহূর্তে প্রায়শ্চিত্ত করছি। মানুষ, তার অকারণ অহঙ্কারের শাস্তি পেয়েছে বহুবার। কিন্তু তার পর মানুষ ভুলে গেছে সবকিছুই। মানুষ প্রকৃতির চেয়ে নিজেকে বেশি বুদ্ধিমান মনে করে। যেন বা, প্রকৃতি আছে, মানুষ আছে বলেই। খুব ক্ষুদ্র এবং সীমাবদ্ধ ইন্দ্রিয়ক্ষমতা এবং বৌদ্ধিক ক্ষমতার অধিকারী আমরা। বিজ্ঞান হোক বা দর্শন, গান হোক বা কবিতা, আমাদের সমস্ত কিছুই হল একটা অন্ধকার ঘরে হাত বাড়িয়ে কালো বেড়াল খুঁজে যাওয়ার মতো। হয়তো এই খোঁজার পদ্ধতির একটা রিজনিং তৈরি করতে পারি আমরা। কিন্তু এই খুঁজে পাওয়াগুলি হয় অপ্রত্যাশিতই। আর এই খুঁজে পাওয়ার বেশ কিছুকাল পরে আবিষ্কার করি, যেটুকু খুঁজে পেয়েছি তা আংশিক মাত্র। অপ্রত্যাশিত কিছু করে প্রকৃতি আমাদের জানান দেয়, তোমরা যা জেনেছ, তা সামান্য একটা অংশের অংশ মাত্র। যখন সেটি জানবে, তার পরেই সেই জানাটা যে কত ক্ষুদ্র তা বুঝতে পারবে। অপ্রত্যাশিতর কাছে আমাদের নতজানু হয়ে থাকতে হয়। প্রকৃতির এই অপ্রত্যাশিতকেও আমরা ঈশ্বর নাম দিয়ে নিজেদের মতো করে রূপ দিয়েছি। আমাদের কল্পনায় প্রকৃতি হয়েছে অলৌকিক, ঈশ্বর এবং তাকে ঘিরে তৈরি হয়েছে ধর্ম। প্রকৃতি হেসেছেন। কারণ তিনি এমন একজন কবি, যিনি, ছবি লেখেন, ছিঁড়ে ফেলেন। অথচ এখনও আমরা এই চরম বুদ্ধিমান চরম হৃদয়বান কবি, দার্শনিক এবং বৈজ্ঞানিককে ভালোবাসতে পারলাম না। তাকে আঘাত করেই গেলাম। আঘাতের পর আঘাত। পুড়িয়ে দিলাম লক্ষ লক্ষ গাছ। আমাদের নগরসভ্যতার হাইওয়ে চলল প্রকৃতির বুকের উপর দিয়ে। প্রকৃতি আর সহ্য করতে পারছিলেন না। মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি সম্পর্কে তাঁর ধারণাই আছে। ফলে, আজ আমাদের এই দশা।
অবস্থাটি যা দেখা যাচ্ছে, তার চেয়েও ভয়ংকর সন্দেহ নেই। কারণ করোনা ভাইরাস বা কোভিড-১৯ এর  সঙ্গে সঙ্গেই আসতে চলেছে দুর্ভিক্ষ। চল্লিশ কোটি মানুষ কাজ হারাতে চলেছেন। সেই সঙ্গে বিপন্ন হতে চলেছে তাঁদের পরিবার। আমরা ঠিক খিদে বুঝিনা। আমরা যুদ্ধও দেখিনি। ডিস্টোপিয়া কাকে বলে, তা মেধা দিয়ে বোঝার চেষ্টা করেছি আর ফিল্ম দেখে। কিন্তু সেই ডিসটোপিয়াই এখন আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছে।
তবু, বলব অবস্থাটি এতটাও নিরাশাজনক না হলেও হতে পারে। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের কথা ভাবুন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, মন্দা, মন্বন্তর, প্লেগ, মহামারী, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ইত্যাদি ইত্যাদি। ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা তখন কী করেছি? একদিকে যখন ধ্বংস হয়ে চলেছিল মানবসভ্যতা, আরেকদিকে তেমনি, একটার পর একটা কালজয়ী সাহিত্য, চিত্রকলা, কবিতা রচিত হয়েছে। নাটক রচিত হয়েছে। ফিল্ম নির্মিত হয়েছে। মানুষ খুঁজে পেয়েছে নতুন করে বলার ভাষা। ধ্বংসস্তূপের উপরে দাঁড়িয়েই।
ওপর ওপর মৃদু দার্শনিকতা, ভাসা ভাসা বিষাদ আর সংকটবিহীন চর্বিতচর্বণের সময় হয়তো শেষ হয়ে এলো। মানবসভ্যতা টিকবে কিনা জানি না। কিন্তু টিকলে, এবার আমাদের সৃজনের ইতিহাস অন্য ভাবে রচিত হবে।
দীর্ঘদিনের অচলাবস্থা কাটিয়েই। এটুকুই এই চরম অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ের আশাবাদ।


বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা। নতুন বছরে সব অন্ধকার কেটে যাক, এটাই প্রার্থনা।

হিন্দোল ভট্টাচার্য

সম্পাদকীয় দপ্তর-- বেবী সাউ  হিন্দোল ভট্টাচার্য  মণিশংকর বিশ্বাস  সন্দীপন চক্রবর্তী শমীক ঘোষ

abahaman.magazine@gmail.com

@ 9051781537

চুয়াং ৎসে এবং লিয়েহ ৎসের লেখা: পুনর্লিখনে গৌতম বসু






চুয়াং ৎসে :  তিনটি টুকরো

 শব্দভাবনা 



মাছ ধরার জন্য প্রয়োজন হয় মাছধরার জালের, কাজ মিটে গেলে আমরা কি আর জালটাকে মনে রাখি? ভুলে যাই। খরগোশ ধরার জন্য আমরা খরগোশ ধরার ফাঁদ পাতি। খরগোশ ধরা হয়ে গেলে, ফাঁদটিকে গুরুত্ব দেওয়ার আর দরকার আছে কী? শব্দ তার অর্থের কারণে বেঁচে আছে; একবার অর্থ হৃদয়ঙ্গম করতে পারলে, তুমি শব্দকে ভুলে যেতে পারো। কোথায় সন্ধান পাই সেই ব্যক্তির, যিনি শব্দ ভুলেছেন, তার সঙ্গে আমার যে দুটো কথা আছে !

*



বাঁধের ধারে চুয়াং ৎসে



হাও নদীর বাঁধের ধারে এক মনোরম দিন; চুয়াং ৎসে আর তাঁর বন্ধু হুই ৎসে সেখানে বেড়াচ্ছেন। বাঁধের স্বচ্ছ জলে রুপোলী মাছেরা খেলে বেড়াচ্ছে । চুয়াং ৎসে মুগ্ধনয়নে দেখছিলেন সেই দৃশ্য, দাঁড়িয়ে প’ড়ে বন্ধুকে বললেন,‘কি সাবলীল ভঙ্গিতে মাছগুলি সাঁতরে বেড়াচ্ছে দেখুন! একেই বলে মাছের অনাবিল আনন্দ।’

   ‘আপনি তো আর মাছ নন’, বললেন হুই ৎসে, ‘মাছের আনন্দের বিষয়ে আপনি কী ক’রে জানলেন?   

   প্রত্যুত্তরে শান্ত কণ্ঠে একটি প্রতিপ্রশ্ন করলেন চুয়াং ৎসে, ‘আপনি তো আর আমি নন। আপনি কী ক’রে জানলেন মাছের আনন্দের বিষয়ে আমি সম্পূর্ণ অজ্ঞ?’

   ‘অবশ্যই। আমি নিশ্চিত জানি না, কারণ আমি আপনি নই। কিন্তু, এটা অতীব পরিষ্কার যে, যেহেতু আপনি মাছ নন, সেহেতু মাছের আনন্দের বিষয়ে আপনি কিছুই জানেন না!’, বেশ আত্মতৃপ্ত ভঙ্গিতে চুয়াং ৎসেকে জানালেন হুই ৎসে।

   কিছুক্ষণ নীরবে পাশাপাশি হাঁটলেন দুই বন্ধু । তারপর, চুয়াং ৎসে সেই একইরকম নিরুত্তাপ কণ্ঠে বললেন,‘প্রসঙ্গটি নিয়ে তলিয়ে ভাবা যাক: যখন আপনি আমায় প্রশ্ন করেছিলেন, মাছের আনন্দ-বিষয়ে আমি কী ক’রে জানলাম, তখন আমার অবগতির কথা আপনি জানতেন, না হলে, ওই প্রশ্নটি আপনি আমায় করতেনই না । নয় কি ? অর্থাৎ, আসলে আপনার প্রশ্নটি ছিল সামান্য অন্যরকম,“মাছের আনন্দের বিষয়ে আমি জানলাম কোন্‌ উপায়ে?” সেই পুনর্বিন্যস্ত প্রশ্নের উত্তর এবার নিবেদন করি, জলের ধার দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে আমি মাছের আনন্দের বিষয়ে জেনেছি ।’

*



তরবারি-বিষয়ক *

*এটি একটি প্রক্ষিপ্ত রচনা



বহুকাল আগে, চাও প্রদেশে এক প্রবীণ ও অকর্মণ্য শাসক ছিলেন, নাম ওয়েং ওয়াং, যাঁর একমাত্র বিনোদন ছিল তলোয়ার-খেলা । তাঁর সভায় অসিযোদ্ধাদের ভিড় লেগেই থাকত, যে-কোনও সময়ে, দেখা যেত হাজার তিনেক সুদক্ষ সৈনিক ও খেলোয়াড় ভাগ্যোন্নতির আশায় সেখানে ঘোরাঘুরি করছেন। দিনরাত তলোয়ার-খেলা চলছে, ভরা সভায়, অলিন্দে, প্রমোদকাননে,  এমন কি রাজপ্রাসাদের প্রশস্ত সিঁড়িতেও, সর্বত্র ; সারা বছর জুড়ে, কত যে রক্ত ঝরত, মৃত্যু হত অবিরাম, তার কোনও হিসেব নেই। তবু প্রভু ওয়েং ওয়াং অতৃপ্ত।

      তিন বছর এইভাবে কাটল; ন্যায়বিচার নেই, প্রশাসন ভেঙে পড়েছে, এই অবস্থায় ওয়েং ওয়াং-এর প্রতিপক্ষ ও উচ্চাভিলাষীরা গোপনে মসনদ ওলটাবার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলেন। কথাটা সুযোগ্য রাজকুমারের কানে পৌঁছল। তিনি বিশস্ত রাজকর্মচারীদের সঙ্গে কর্মপন্থা বিষয়ে পরামর্শ করলেন এবং প্রভু ওয়েং ওয়াং-কে যিনি দুর্মতিমুক্ত করতে পারবেন তাঁর জন্য এক সহস্র ভরির রৌপ্যমদ্রার পুরস্কার ঘোষণা করলেন। রাজকর্মচারীরা সকলে একযোগে রাজকুমারকে জানালেন যে একজনই আছেন যিনি এই দুঃসাধ্য কাজ সম্পন্ন করতে পারবেন, চুয়াং ৎসে । এক হাজার ভরি রুপোর মুদ্রা নিয়ে রাজদূত ঘোড়া ছুটিয়ে চুয়াং ৎসে-র কুটিরে উপস্থিত হল । চুয়াং ৎসে একটি মুদ্রাও গ্রহণ না করলেও, নিজেই রাজকুমারের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। দূত তাঁকে তার ঘোড়ায় তুলে নিয়ে দ্রুত ফিরে চলল রাজপ্রাসাদের দিকে।

      চুয়াং ৎসে-কে মর্যাদাসহ রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরে নিয়ে যাওয়া হল, কিন্তু লোকলস্কর, আড়ম্বরকে কিছুমাত্র গুরুত্ব না দিয়ে, তিনি সরাসরি রাজকুমারকে প্রশ্ন করলেন,‘আমাকে আপনার কী এমন প্রয়োজন হল রাজকুমার, যে আমার হাতে এক হাজার মুদ্রা তুলে দিতে চাইলেন?’

      রাজকুমার সঙ্কোচের সঙ্গে বললেন, ‘আমি শুনেছি আপনি একজন ঋষি। আপনার জন্য ওই অর্থ আমি পাঠাই নি, পাঠিয়েছিলাম আপনার ভৃত্যদের জন্য। ওটি সামান্য এক আনুষ্ঠানিক কৃত্য মাত্র। আপনি অর্থ ফিরিয়ে দিয়েছেন । আমি এ-বিষয়ে আপনাকে আর কী বলি?’

      চুয়াং ৎসে বললেন, ‘আপনি চান যে, আমার হাতে ওয়েং ওয়াং-র এই অদ্ভুত ব্যাধির নিরাময় হোক, তা আমি জানি। এবার, ধরুন আমি বিফল হলাম। তখন, আপনি আমাকে নিশ্চিত ভাবে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করবেন। তখন, ওই মুদ্রা আমার কোন্‌ কাজে লাগবে? আবার ধরুন, আমি যদি সফল হই, তা হলে এই রাজ্যের যে-কোনও সম্পদ, আমি যা চাইব, আপনি নির্দ্বিধায় আমার হাতে তুলে দেবেন। সে ক্ষেত্রেও ওই পুরষ্কার আমার কোনও কাজে লাগবে না।’

      রাজকুমার অনুমান করলেন চুয়াং ৎসে-র সহায়তা মিলবে, তাঁকে সতর্ক করার জন্য তিনি বললেন, ‘আপনি হয়তো জানেন, অন্য কারুর সঙ্গে নয়, আমার পিতা কেবল অসিযোদ্ধাদের সঙ্গেই দেখা করেন।’

     ‘চিন্তা করবেন না, তলোয়ার চালনায় আমি পারদর্শী’,গুরু চুয়াং রাজকুমারকে জানালেন।

     ‘এ-ছাড়াও, আপনাকে জানাবার একটা বিষয় আছে’, চুয়াং ৎসে-কে আরও সতর্ক ক’রে দিতে চাইলেন রাজকুমার। ‘পিতা যে-সমস্ত অসিযোদ্ধা দেখতে অভ্যস্ত, তাদের পোশাকপরিচ্ছদ অশোভন, প্রত্যেকেরই মাথার চুল ঝাঁকড়া, অবিন্যস্ত, এবং এতই লম্বা যে টুপির নিচ দিয়ে গোছায়-গোছায় বেরিয়ে এসেছে। টুপির আকারও বিচিত্র, টেরছা ভঙ্গিতে মাথা থেকে ঝুলে রয়েছে, টুপির কানা থেকে বিনুনি-করা রুক্ষ সুতোর ট্যাসেলের গুচ্ছ দুলছে, প্রত্যেকের পরনে খাটো মাপের টেলকোট। তাদের চাহনি আর মুখের ভাষা হিংস্র, তাদের আলোচনার একমাত্র বিষয় তলোয়ার-খেলা। পিতা এইরকমই পছন্দ করেন। আপনি যদি এক শিক্ষিত সজ্জনের পরিধানে তাঁর সম্মুখে উপস্থিত হন, ফল বিপজ্জনক হবে।’

     ‘আমি উপযুক্ত পোশাকেই যাব’, রাজকুমারকে এই আশ্বাস  দেবার পর, চুয়াং ৎসে শরীরচর্চা ও অসিচালনার অনুশীলনে মন দিলেন। তিনদিন পর, নিজেকে সম্পূর্ণ প্রস্তুত ক’রে, তিনি ওয়েং ওয়াং-র সম্মুখে হাজির হলেন, সঙ্গে রাজকুমার। সভাগৃহে চুয়াং ৎসে প্রবেশ করা-মাত্র ওয়েং ওয়াং খাপ থেকে নিজের ধারালো তলোয়ারখানা মুক্ত ক’রে তাঁর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন । চুয়াং ৎসে দ্রুত এগিয়ে গেলেন না, ওয়েং ওয়াং-কে কোনওরকম সম্মানজ্ঞাপনও করলেন না ।

     ‘তুমি যে রাজকুমারের সুপারিশ নিয়ে এখানে এসেছ, তা বুঝতে পারছি,’ হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন ওয়েং ওয়াং, ‘বলো, কী বলবার আছে!’

      চুয়াং ৎসে খুব নম্র ভাবে বললেন,‘আমি শুনেছি, হুজু্র তলোয়ার-খেলা খুব উপভোগ  করেন। আমি সেই আকর্ষণে এখানে খেলা দেখাতে এসেছি।’ কর্মপ্রার্থীকে পরিমাপ করবার জন্য ওয়েং ওয়াং তাঁর প্রশিক্ষণ বিষয়ে জানতে চাইলেন ।

      উত্তরে চুয়াং ৎসে বললেন, ‘দশ পায়ের দূরত্বে আমি যদি একের–পর-এক প্রতিপক্ষের সম্মুখীন হই, তা হলে তাদের একে-একে পরাস্ত করতে-করতে আমি তিন শো মাইলেরও বেশি এগিয়ে যেতে পারার শক্তি ধরি।’

      ‘শাবাশ!’ জানালেন ওয়েং ওয়াং, ‘এ-রাজ্যে তোমার জুড়ি মেলা ভার হবে ব’লে মনে হচ্ছে।’

      চুয়াং ৎসে অবিরাম নিজের বড়াই ক’রে চললেন, ‘আমি যখন লড়াই করি, গোড়ার দিকে মনে হতে পারে আমি দুর্বল । সেইখান থেকে ধাপে-ধাপে আমার আক্রমণ আমি গ’ড়ে তুলি । শুরু করি সবার পরে, শেষ করি সবার আগে! হুজুরের কাছে অনুরোধ, খেলা দেখাবার একটা সুযোগ আমায় দিন!’

      ওয়েং ওয়াং উত্তর করলেন, ‘র’সো, র’সো, তোমার সুযোগ আসবে। আমার নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করো।’

      যে যোদ্ধারা আগে এসেছিলেন, তাদের মধ্যে সাত দিন ব্যাপী প্রতিযোগিতা  শুরু হল। প্রায় ষাট জন প্রতিযোগী হতাহত হবার পর, ওয়েং ওয়াং পাঁচ-ছয়জন প্রতিযোগী বেছে নিয়ে, তাদের পাশের ঘরে অপেক্ষা করার নির্দেশ দিলেন। এইবার, চুয়াং ৎসে-র ডাক পড়ল, ওয়েং ওয়াং হাঁক দিলেন, ‘এইবার তোমার পরীক্ষা শুরু!’

      চুয়াং ৎসে  এগিয়ে এসে দাঁড়াতেই ওয়েং ওয়াং তাঁকে প্রশ্ন করলেন,‘একটা কথা, অস্ত্রের দৈর্ঘ্যে সম্পর্কে তোমার কি কোনও পছন্দ-অপছন্দ আছে?’

      ‘কিছুমাত্র না’, জানালেন চুয়াং ৎসে। ‘তবে, জানিয়ে রাখি, আমার তরবারির সংখ্যা তিন। তাদের  মধ্যে একটি বেছে নেওয়ার জন্য হুজুরকে আমি অনুরোধ করব, সেই তরবারি দিয়ে শুরু হবে আমার পরীক্ষা!’

      ‘তাই নাকি? বাহ্‌ বেশ তো! বিস্তারিত বলো দেখি! কোন্‌ তিনরকম তলোয়ারের খেলা তুমি জান?’,ওয়েং ওয়াং কৌতূহলী হয়ে উঠলেন ব’লে মনে হল। 

      চুয়াং ৎসে বললেন, ‘সর্বাগ্রে স্বর্গপুত্রের তরবারি, তারপর রাজন্যবর্গের তরবারি, সবার শেষে সাধারণের তরবারি ।’

      ‘স্বর্গপুত্রের তরবারি কী বস্তু ?’

      ‘ওই তরবারির অগ্রভাগের তীক্ষ্ণ বিন্দুতে, ইয়েন উপত্যকা অধিষ্ঠিত । দুই ফলার এক দিকে, চীন-এর সুমহান প্রাচীর, অন্যদিকে চী ও তাই পর্বতমালা । তাঁর পৃষ্ঠদেশ, চিন এবং ওয়ে । ওই তরবারির বাঁট, চাউ এবং সুঙ । ওঁর খাপের একদিক, হান এবং অন্যদিক উই । বর্বর উপজাতিরা চারপাশে তাঁকে ঘিরে রয়েছে, তাঁকে বেষ্টন ক’রে রেখেছে চারঋতু। পো সাগরের উত্তাল তরঙ্গ সদাসর্বদা তাঁকে রক্ষা করে, তাঁর কটিবন্ধ চাঙ পর্বত। ওই তরবারি পঞ্চভূতের  নির্দেশ মান্য করেন, তাঁদেরই ইচ্ছানুসারে তরবারি হতে কখনও করুণা ঝ’রে পড়ে, আবার অন্য কখনও, দণ্ডাদেশ। পুরুষ ও প্রকৃতির লীলা হতে এই তরবারির কর্মকুশলতা আহরিত । গ্রীষ্মকাল ও বসন্তে তিনি যুগপৎ সজাগ ও নিশ্চল অবস্থায় থাকেন, শরতে ও শীতে তিনি সচল । তাঁকে সম্মুখে চালনা করুন, সামনে এসে দাঁড়াবার স্পর্ধা করবে না কেউ । ঊর্ধ্বে তুলে ধরুন তাঁকে, তিনি অবস্থান করবেন সবার শীর্ষে । নিন্মে নামিয়ে ধরুন, তিনি স্পর্শ করবেন অতল । তাঁকে চক্রাকারে ঘোরান, সে-ঘূর্ণির বাইরে কোনও ঘূর্ণি সৃষ্টি করা অসম্ভব! তাঁকে ঊর্ধ্বে চালনা করুন, তিনি ভাসমান মেঘ দ্বিখণ্ডিত ক’রে ফেলবেন। নিন্মে চালনা করুন তাঁকে, তিনি ধরিত্রীর শিরা-উপশিরা ছেদ করতে পারঙ্গম। তাঁর ফলা একবার ঝল্‌সে উঠলেই পৃথিবীর নৃপতিরা তাঁর সম্মুখে নতজানু হন । তিনি স্বর্গপুত্রের তরবারি!’

         চুয়াং ৎসে অবশেষে থামলেন। আত্মবিস্মৃত ওয়েং ওয়াং নিথর অবস্থায় তাঁর  সিংহাসনে ব’সে রইলেন। কিছুক্ষণ পরে তাঁর সম্বিৎ ফিরল, তিনি মৃদুস্বরে চুয়াং ৎসে-কে জিজ্ঞাসা করলেন,‘আর, রাজন্যবর্গের তরবারি?’

         চুয়াং ৎসে-এর প্রবল ভাবাবেগও ততক্ষণে কিছুটা প্রশমিত হয়েছে, তিনি আবার শান্ত কণ্ঠে বলতে শুরু করলেন, ‘ওই তরবারির অগ্রভাগের তীক্ষ্ণ বিন্দুতে বিচক্ষণ ও নির্ভীক ব্যক্তিগণ অবস্থান করেন। দুই ফলার এক দিকে, নীতিপরায়ণ এবং অন্যদিকে আন্তরিক মানুষ উপবিষ্ট। তাঁর পৃষ্ঠদেশে অবস্থান করেন গুণী ও বিত্তবান। বিশ্বাসভাজন ও প্রাজ্ঞ মানুষ  রয়েছেন ওই তরবারির বাঁটে; অসমসাহসী যে ব্যক্তিগণ জয় করেছেন মৃত্যুভয়, তাঁরা ওই তরবারির খাপে অবস্থান করছেন। অসিচালনার সময়ে স্বর্গপুত্রের তরবারির মতোই তাঁর আচরণ, তাঁকে সম্মুখে চালনা করুন, সামনে এসে দাঁড়াবার স্পর্ধা করবে না কেউ। ঊর্ধ্বে তুলে ধরুন তাঁকে, তিনি অবস্থান করবেন সবার শীর্ষে। নিন্মে নামিয়ে ধরুন, তিনি স্পর্শ করবেন অতল। তাঁকে চক্রাকারে ঘোরান, সে-ঘূর্ণির বাইরে কোনও ঘূর্ণি সৃষ্টি করা অসম্ভব! ঊর্ধ্বলোক হতে তিনি মার্গদর্শন লাভ করেন, চন্দ্রসূর্য ও আকাশভরা তারা তাঁকে পথ দেখায়। পৃথিবীর এই স্থাবর চতুষ্কোণ হতে তিনি শক্তিসঞ্চয় করেন, ঋতুচক্রের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা ক’রে চলেন। মধ্যবর্তী স্তরে মানুষের সদিচ্ছা অনুসারে তিনি নিজেকে সুবিন্যস্ত ক’রে নেন, যাতে চতুর্দিশায় এক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তাঁকে একবার চালনা করলে বজ্রনির্ঘোষের অভিঘাত সৃষ্টি হয়। দেশের চারপ্রান্তের অভ্যন্তরে এমন কেউ নেই, যিনি তাঁর প্রতি অনুগত নন। তিনি রাজন্যবর্গের তরবারি।’       

        কথা শেষ হলে ওয়েং ওয়াং আবার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘সাধারণের তরবারি কী?’

        ‘সাধারণের তরবারি যারা ব্যবহার করে তাদের পোশাকপরিচ্ছদ অশোভন, প্রত্যেকেরই মাথার চুল ঝাঁকড়া,অবিন্যস্ত, এবং এতই লম্বা যে টুপির নিচ দিয়ে গোছায়-গোছায় বেরিয়ে এসেছে। টুপির আকারও বিচিত্র, টেরছা ভঙ্গিতে মাথা থেকে ঝুলে রয়েছে, টুপির কানা থেকে বিনুনি-করা রুক্ষ সুতোর ট্যাসেলের গুচ্ছ দুলছে, প্রত্যেকের পরনে খাটো মাপের টেলকোট। তাদের চাহনি আর মুখের ভাষা হিংস্র, তাদের আলোচনার একমাত্র বিষয় তলোয়ার-খেলা। সংঘাতের সময়ে সাধারণের তরবারি ঊর্ধ্বে চালনা করলে প্রতিপক্ষের গলামাথা, এবং নিম্নে চালনা করলে প্রতিপক্ষের যকৃৎ কেটে দ্বিখণ্ডিত হয়। এই হল সাধারণের তরবারি। সাধারণের তরবারি যারা ব্যবহার করে তাদের দশা অনেকটা শিকারী মোরগের লড়াইয়ের মতো, যে কোনওদিন যবনিকা পতন হতে পারে। তারা রাজার কোনও কাজে লাগে না।’ এরপরেও ওয়েং ওয়াং-এর উদ্দেশে আরও ক’টি কথা বললেন চুয়াং ৎসে, ‘আপনি রাজা, বিপুল ক্ষমতা আপনার, স্বর্গপুত্রের তরবারি ধারণ করা আপনাকেই সাজে, অথচ দেখুন, সাধারণের তরবারি ধারণ করার অযোগ্য কাজ আপনি ক’রে চলেছেন। আমার আক্ষেপ আমি প্রকাশ করলাম।’

        প্রতিযোগিতার শেষে ভোজসভার আয়োজন করা হয়েছিল। অসিযুদ্ধের কোনও প্রতিযোগিতা না হলেও, ওয়েং ওয়াং-র নির্দেশে ভোজসভা শুরু হল। তিনি নিজে্র হাতে চুয়াং ৎসে-কে খাদ্যপরিবেষণ করলেন। চুয়াং ৎসে-র থালা খালি হবার আগেই তিনি বারংবার নিজের আসন ত্যাগ ক’রে অতিথি সৎকারের উদ্যোগ নিলেন। চুয়াং ৎসে তাঁকে বললেন, ‘আপনার আসন গ্রহণ করুন, মহারাজ, শান্ত হোন । তরবারির বিষয়ে আমার আর কিছু বলবার নেই।

        ভোজসভার শেষে চুয়াং ৎসে রাজপ্রাসাদ  থেকে বিদায় নিলেন। ওয়েং ওয়াং নিজের মহলে ফিরে গেলেন। পরের দিন আবার রাজসভা বসল কিন্তু সকলে এই লক্ষ ক’রে বিস্মিত হলেন যে, ওয়েং ওয়াং-র আসন শূন্য । কেবল ওইদিন নয়, তিন মাস তাঁকে সভার ত্রিসীমানায় দেখা গেল না। অসিযোদ্ধারা আগের মতোই প্রত্যহ রাজসভায় আসতেন এবং নিজেদের মধ্যে অনুশীলন করতেন, ক্রমে তাঁরাও বুঝতে পারলেন যে তাঁদের সুদিন ফুরিয়েছে। সভাসদদের মধ্যে কেউ-কেউ বলেন, ওয়েং ওয়াং-র পরিবর্তনে হতাশ হয়ে তাঁরা যে-যার গ্রামে ফিরে গেলেন। কেউ-কেউ বলেন, ওই রাজপুরীতে্‌ তাঁরা সকলেই একে অপরের হাতে, প্রাণ হারান।         

*

                   



[ঋণস্বীকার: ‘চাইনিজ় উইজ়ডম্’, সম্পাদনা: জেরাল্ড বেনেডিক্ট এবং ‘চুয়াং ৎসে:মিস্টিক, মরালিস্ট অ্যান্ড সোশাল  রিফর্মার’ সম্পাদনা: হরবর্ট এ. গাইলস । লেখকের পরিচিতি নিয়ে বিস্তর কলহবিবাদ থাকলেও ধ’রে নেওয়া হয়, চুয়াং ৎসে-র(মতান্তরে ঝুয়াংঝি), খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে হোনান অথবা অনহুই জেলার অন্তর্গত মেং নগরে জন্মেছিলেন। তাঁর আসল নাম চুয়াং চাউ, ‘ৎসে’ একটি সাম্মানিক উপাধি,‘চুয়াং ৎসে’-র অর্থ ‘গুরু চুয়াং’।তাও/ডাও ধর্মের তিন স্থপতির মধ্যে তিনি একজন, অন্যরা হলেন যথাক্রমে লাও ৎসে ও লিয়েহ ৎসে। প্রসঙ্গত, চুয়াং ৎসে-র বন্ধু, এবং এক দিক থেকে বিচার করতে গেলে প্রতিপক্ষ, হুই ৎসু-কে হেয়জ্ঞান করা সমীচীন হবে না। তিনিও একজন ‘ৎসে’।]

                                         পুনর্লিখন : গৌতম বসু




লিয়েহ ৎসে : দু’টি টুকরো



 স্বর্গ ও মর্ত্য বিষয়ে চুয়াং ৎসে ও লিয়েহ ৎসে



চী প্রদেশের এক ব্যক্তি আহারনিদ্রা ত্যাগ করলেন; তাঁর একটাই দুর্ভাবনা, যে-কোনও মুহূর্তে আকাশ ভেঙে পড়তে পারে পৃথিবীর ওপর, এবং স্বভাবতই, তখন পৃথিবীও চুরমার হয়ে আরও নিচে তলিয়ে যাবে। এই ভয়ানক অবস্থায়, ভদ্রলোকের প্রশ্ন, তাঁর শোয়াবসার জায়গার কী বন্দোবস্ত হবে? অনেকে অনেক ভাবে প্রবোধ দেবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু কারুর যুক্তিতেই তেমন জোর না থাকায়, সকলকেই সহজে হারিয়ে, ভদ্রলোক আরও মন খারাপ ক’রে ব’সে রইলেন,   তাঁকে কোনওভাবেই অবসাদমুক্ত করা গেল না। অবশেষে, এক তরুণের কথায় তিনি যেন সামান্য ন’ড়ে চ’ড়ে বসলেন, সে তাঁকে বোঝাল, ‘দেখুন, স্বর্গ জায়গাটা জমাট বায়ুস্তর বই অন্য কিছু নয়, এমন কোনও জায়গা সেখানে নেই, যেখানে বায়ু অনুপস্থিত। ভেবে দেখুন, আপনি তো সেইরকম একটা বায়ুমণ্ডলে আছেন, দিব্যি হাঁটাচলা করছেন, শরীর বেঁকাচ্ছেন এদিক থেকে ওদিক, লম্বা শ্বাস নিচ্ছেন, ছাড়ছেন। আপনি স্বর্গেই আছেন, বলা যায়! আপনার চারপাশের বায়ুমণ্ডল কি ভেঙে পড়ছে? কেন অযথা চিন্তাভাবনা করছেন?’

     কিছুক্ষণ চুপ ক’রে রইলেন চী প্রদেশের সেই ভদ্রলোক, ভাবলেন, ‘সত্যিই তো, আমি এখন যেখানে আছি, কই সেটা তো ভেঙে পড়ছে না!’ পরক্ষণেই নতুন প্রশ্নের উদয় হল তাঁর মনে, যুবককে তিনি জানালেন,‘বেশ, বায়ুস্তর ভেঙে পড়ছে না, এটা না হয় দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু, স্বর্গ যে কেবলই জমাট বায়ুস্তর, এটা কোনওমতেই মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। যদি তাই হতো, একা স্বর্গলোক এতগুলো তারা, এবং চন্দ্রসূর্য একসঙ্গে ধ’রে রাখতে পারত না, সেগুলো টুপ্‌ টুপ্‌ ক’রে খ’সে পড়তই।’

     যুবকও কম তৎপর নয়, তৎক্ষণাৎ সে ব’লে উঠল, ‘ওগুলো তো আলো! বাতাসেরই মতো বলতে পারেন!ওরা প’ড়ে গেলেও কারুর কোনও শারীরিক ক্ষতি হবে না।’

     ‘আর পৃথিবীর ধ্বসে পড়ার ব্যাপারটা?’

     যুবক বলল,‘পৃথিবী জমাট মাটি; উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম―চার প্রান্তে ছড়িয়ে রয়েছ মাটি, কোথাও এতটুকু ফাঁক নেই। আপনি সেই মাটির ওপর হাঁটছেন, দাঁড়িয়ে পড়ছেন, পা দিয়ে ধুপধাপ শব্দ করছেন। মাটি ধ্বসে পড়ার কথা উঠছে কোথা থেকে?’

     অবশেষে ভদ্রলোক শান্ত হলেন এবং বলা বাহুল্য, তাঁর পরিবারের লোকজন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। যুবকের বিবেচনাবুদ্ধির সুনাম শহরে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল।

     এক সময়ে এই বৃত্তান্ত স্বয়ং চুয়াং ৎসে-র কানে পৌঁছল। তিনি মৃদু হেসে বললেন,‘রামধনু, মেঘমালা এবং কুয়াশা, ঝড় এবং বাতাস, ঋতুচক্র ― এগুলি সবই স্বর্গলোকের পুঞ্জীভূত বায়ুর বিভিন্ন আকার। পাহাড় ও পর্বত,নদী ও সাগর, ধাতু ও  পাথরখণ্ড, আগুন ও কাঠ, এগুলি সবই ভূখণ্ড থেকে উৎপন্ন। এরা প্রত্যেকে অন্তরীক্ষ ও ধরণীর বিভিন্ন অংশের খণ্ড, এই সত্য জেনেও, কীভাবে বলি যে, তা ধ্বংস হবে না? অস্তিত্বের বিচারে সর্ববৃহৎ, ওই মহাশূন্য ; স্বর্গ ও মর্ত্যলোক তার ক্ষুদ্রাংশ মাত্র। সন্দেহ নেই, সুদীর্ঘ সময় অতিবাহিত হবার পর, উভয়েরই অবসান হবে, এবং এ-ব্যাপারেও সন্দেহ নেই যে, কবে তা ঘটতে চলেছে তা এখনই নিরূপণ করা সহজ নয়। তাদের বিনাশ নিয়ে এখনই আতঙ্কিত হওয়া অপ্রাসঙ্গিক, কিন্তু একই সঙ্গে, কেউ যদি মনে করেন সৃষ্টি অক্ষয়,তা হলে, আমাদের আপত্তির কথা আমাদের জানিয়ে রাখতে হবেই। স্বর্গ ও মর্ত্যের বিনাশ যেহেতু সন্দেহাতীত, সেহেতু এমন একটা দিন আসবেই যেদিন তারা উভয়ই বিলুপ্ত হবে। সেই সময়ে আমরা যদি এখানে উপস্থিত থাকি, তা হলে আমাদের দুর্ভাবনা কি খুব অমূলক?’

       ঘটনাচক্রে, লিয়েহ ৎসে-ও ওই একই ঘটনার বিষয়ে জানতে পারলেন, এবং তিনিও মৃদু হাসলেন, বললেন, ‘স্বর্গ ও মর্ত্য একদিন ধ্বংস হবেই, এবং অপরদিকে, তারা কোনওদিনই ধ্বংস হবে না ― উক্তি দু’টিই নির্বুদ্ধিতার ফল। তারা ধ্বংস হবে, না চিরকাল অক্ষয় থাকবে, তা আমরা সঠিক ভাবে কোনওদিনই জানতে পারব না। একদিক থেকে যদি একরকম অভিমত পাওয়া যায়, অপরদিকে পাওয়া যাবে ঠিক এর বিপরীতমুখী অভিমত। যেমন, এটা তো আর  অস্বীকার করা যায় না যে, যাঁরা  জীবিত তাঁরা মৃতাবস্থা সম্পর্কে অবহিত নন, আবার, যাঁরা  মৃত, জীবিত থাকার বিষয়ে তাঁদের কোনও ধারণাই নেই। আমরা যখন কোথাও প্রবেশ করি, তখন আমরা জানি না, পূর্বেই কারা–কারা সেখানে ঘুরে গেছেন, আবার, সেখান থেকে আমরা যখন প্রস্থান করি, তখন আগামী দিনে সেখানে কারা আসবেন, তা আমাদের অজানাই রয়ে যায় । সৃষ্টি অক্ষয়, না ভঙ্গুর, এ-নিয়ে আমরা কেন ভাবব?’                                                                 



*

কাঠুরিয়ার স্বপ্নদর্শন



চেং প্রদেশের এক কাঠুরিয়া, নিজের কুটিরের জন্য জ্বালানী কাঠের সন্ধানে জঙ্গলে ঘুরছিল, হঠাৎ তার সামনে ভয়ানক ভীত এক হরিণ এসে উপস্থিত। অসহায় হরিণটিকে সে তৎক্ষণাৎ তীরবিদ্ধ ক’রে বধ করল বটে, কিন্তু মৃত জীবটিকে নিয়ে কী করবে বুঝতে পারল না, কারণ তার আশু প্রয়োজন খাদ্যের নয়, কাঠের। অগত্যা জঙ্গলের মধ্যেই খানাখন্দ খুঁজতে-খুঁজতে, একটা পছন্দসই জায়গা পাওয়া গেল। সেইখানে গাছের ভাঙা ডাল, শুকনো পাতা দিয়ে সযত্নে হরিণটিকে ঢেকে রেখে, সংগৃহীত কাঠের গোছা মাথায় নিয়ে সে বাড়ির পথ ধরল, ভাবখানা এই যে, আমার হরিণ কেউ চুরি করতে পারবে না, বাকিটা কাল দেখা যাবে। কাঠুরিয়া অন্যমনস্ক প্রকৃতির মানুষ, বাড়ি ফিরতে-ফিরতে ঘটনাটি সে সম্পূর্ণ ভুলে গেল। পরের দিন অলস মনে স্মৃতি রোমন্থন করতে-করতে হঠাৎ তার মনে প’ড়ে গেল শিকারের কথা। অল্প কথায় বৌকে গতকালের ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়েই সে দৌড়ল জঙ্গলের দিকে।

     কাঠুরিয়া জঙ্গলের ভিতরে পায়ে-চলা পথ ধ’রে হাঁটছে আর বিড়–বিড় ক’রে নিজের মনে ব’লে চলেছে,‘তারপর ডান দিকে ঘুরে ঢালু জায়গাটায় এলাম, রাশি-রাশি শুকনো ফুল পড়েছিল, আরও এগিয়ে গেলাম, এবার বাঁদিকে বেঁকলাম, বাঁদিকে না ডানদিকে? তারপর, তারপর ...’। সবকিছু আরও অস্পষ্ট, আরও ধোঁয়াটে হতে লাগল। অবশেষে, কাঠুরিয়া ক্লান্ত হয়ে খালি হাতে বাড়ি ফিরে এল, নিজেকে বোঝাল, পুরোটাই স্বপ্ন ছিল বোধহয়, ঐ জঙ্গল, ভয়ে কাঠ হয়ে-যাওয়া ঐ হরিণ! হরিণ হারাবার কোনও দুঃখই অবশিষ্ট রইল না কাঠুরিয়ার মনে, কারণ সমস্তই তো স্বপ্ন।

     ওদিকে একটা চোরও ঘুরছিল জঙ্গলে, সে লুকিয়ে-লুকিয়ে কাঠুরিয়ার পিছু-পিছু যেতে- যেতে তার সব বিড়বিড়ানি শুনতে পেল। কাঠুরিয়া জঙ্গল থেকে বেরিয়ে যাওয়া-মাত্র সে ফিরে গেল সেখানে, কাঠুরিয়ার বিবরণ পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসরণ ক’রে লুকনো হরিণের ঢিবিতে সটান পৌঁছে গেল! কাঁধের দু–দিকে হরিণটাকে ঝুলিয়ে মহানন্দে নিজের বাড়ি ফিরল সে, বৌকে বোঝাল, ‘কাঠুরিয়া স্বপ্ন দেখেছিল যে সে একটা হরিণ শিকার করেছে, কিন্তু হরিণটাকে কোথায় রেখেছে,  কিছুতেই তার আর সে-কথা মনে পড়ল না। আমি খুঁজে পেলাম সেই হরিণ! এর থেকে স্পষ্ট প্রমাণ মিলছে যে, কাঠুরিয়ার স্বপ্ন সত্যি।’

     তার বৌ খুব বুদ্ধিমতী, সে বলল, ‘তা কেন হবে গো, স্বপ্নটা তুমিই দেখেছিলে। স্বপ্নে তুমি এক কাঠুরিয়াকে দেখেছিলে যে একটা হরিণ শিকার করেছে। কাঠুরিয়াকে এখন দেখা যাচ্ছে না বটে, কিন্তু হরিণটা  তো আছে ! তার মানে, স্বপ্নটা তোমার এবং সেটা সত্যি।’

     চোর সহজসরল মানুষ, এত জটিলতা তার মোটেও পছন্দ নয়। সে জানাল, ‘একটা হরিণ পাওয়া গেছে, সেটাই বড় কথা । স্বপ্ন কাঠুরিয়ার না আমার, জেনে আমার কী লাভ?’

     সেই রাতে কাঠুরিয়া একটা দীর্ঘ স্বপ্ন দেখল। কোথায় সে শিকার লুকিয়ে রেখেছিল, তারপর কী–কী হল, কে এল, মাটি থেকে কী খুঁড়ে বার করল, কোথায় নিয়ে গেল তার শিকার, সব যেন পর-পর এক জাদুলণ্ঠনে ভেসে উঠতে লাগল! সেই অদ্ভুত স্বপ্নের পিছু-পিছু ছুটে কাঠুরিয়া পৌঁছে গেল চোরের কুটিরে। কাঠুরিয়া তার শিকার ফিরিয়ে দেবার দাবি জানাল,  বিস্তর ঝগড়াঝাঁটিতে মুখর হল পাড়া, কিন্তু কোনও ফল ফলল না। অবশেষে রাগে, দুঃখে কাঠুরিয়া আদালতের দ্বারস্থ হল।

     প্রধান বিচারপতি দু-পক্ষের জবানবন্দি মনোযোগ সহকারে শুনলেন, তারপর কাঠুরিয়াকে বললেন, ‘প্রথম কথা, আপনি হরিণ বধ করলেন কিন্তু ভুল ক’রে ভেবে বসলেন ওটা একটা স্বপ্ন । দ্বিতীয় কথা, স্বপ্নের মধ্যে হরিণটাকে আপনি খুঁজে পেলেন বটে কিন্তু, এবার ভুল ক’রে ভেবে বসলেন ওটা বাস্তব। অন্য ব্যক্তি আপনার হরিণ নিয়ে চম্পট দিলেন, এবং, এখন, আপনার মালিকানাই তিনি অস্বীকার করছেন। তাঁর গৃহিণী বলছেন, মানুষ এবং হরিণ, উভয়ের অস্তিত্ব কেবল স্বপ্নে, প্রকৃতপক্ষে শিকারের ঘটনাটিরই কোনও বাস্তব অস্তিত্ব নেই। একটিই বাস্তব এখন আমার সামনে, এই হরিণ। আমার মনে হয়, যিনি হরিণ শিকার করেছিলেন, এবং, জঙ্গল থেকে হরিণটাকে যিনি উদ্ধার করেছিলেন, তাঁরা হরিণটাকে সমান-সমান ভাগ ক’রে নিলে সব দিক থেকে ভাল হয়।

     চেং প্রদেশের ভূস্বামীর সভায় বিচারপতির রায়ের খবর পৌঁছল।ভূস্বামী কৌতূহলভরে তাঁর                                                                                       

প্রিয় সভাসদের দিকে ঝুঁকে প’ড়ে, নিচু স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন,‘পুরোটাই বিচারপতির স্বপ্নদর্শন নয় তো?’

     ঘটনার বিবরণ এবং বিচারপতির সুচিন্তিত রায়ের সংবাদ চেং প্রদেশের বাইরে ছড়িয়ে প’ড়ে, অবশেষে দেশের রাজধানীতে প্রবেশ করল। মন্ত্রীসভার পক্ষ থেকে বাদী ও বিবাদী পক্ষের সমস্ত জবানবন্দি এবং বিচারপতির রায় স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর বিবেচনার জন্য নিবেদন করা হল। মহামান্য প্রধানমন্ত্রী অভিমত প্রকাশ করলেন, ‘কোন্‌টা স্বপ্ন আর কোন্‌টা স্বপ্ন নয়, এ-ক্ষেত্রে তা নির্ধারণ করা  আমার সাধ্যাতীত। আমি যতদূর বুঝি, ঘুম এবং জাগরণ পৃথক করতে পারতেন কেবল পীতবর্ণ সম্রাট এবং মহাজ্ঞানী কনফিউসিয়াস, কিন্তু, আমাদের দুর্ভাগ্য তাঁরা কেউই আর ইহজগতে নেই। আপাতত, আমি সম্মানীয় বিচারপতির রায়ের সঙ্গে সহমত প্রকাশ করলাম।’             

*



[ঋণস্বীকার: ‘দ্য বুক অফ্‌ লিয়েহ ৎসে’, সম্পাদনা : এ. সি. গ্রেহ্যাম। লিয়েহ ৎসে সম্পর্কে প্রাপ্ত তথ্য অপ্রতুল, এমনই যে, অনেকে ধ’রে নিয়েছেন বাস্তব জগতে তাঁর কোনও অস্তিত্বই ছিল না, তিনি চুয়াং ৎসে-র সৃষ্ট এক কাল্পনিক চরিত্র মাত্র। লিয়েহ ৎসে-র লেখায় কখনও বাস্তব প্রবেশ ক’রে স্বপ্নের জগতে, আবার কখনও স্বপ্ন হয়ে ওঠে কঠিন বাস্তব। তাঁর লিখনভঙ্গিমাই লেখকপরিচয়ে এই বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে কি না, কে  বলতে পারেন!  একটি বিকল্প হিসেবে ভেবে নেওয়া যেতে পারে, তিনিও খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে হোনান জেলার অন্তর্গত ঝেং প্রদেশে জন্মেছিলেন এবং মধ্যবয়স পর্যন্ত প্রতিবেশীদের বাইরে তাঁকে কেউই চিনতেন না, যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষপীড়িত দেশে তাঁকে  এ-জেলায় ও-জেলায় ঘুরে বেড়াতে হয়েছে। আজ সে পরিস্থিতি নেই, তাও/ডাও ধর্মের তিন স্থপতির মধ্যে তাঁর স্থান সংশয়াতীত, অন্যরা হলেন যথাক্রমে লাও ৎসে ও চুয়াং ৎসে। মানুষের বিশ্বাস, লিয়েহ ৎসে বাতাসের পিঠে চ’ড়ে বেড়াতেন। ]

                                              পুনর্লিখন : গৌতম বসু        

Monday, April 13, 2020

মণিশংকর বিশ্বাস-এর কবিতাগুচ্ছ




যৌথ

কবিতায় বারবার আমি আমি ‘প্রেম’ লিখতে গিয়ে
‘ভালোবাসা’ লিখে ফেলি।
কেন-না আমিও থাকতে চেয়েছি ওই হাতে আজীবন—
যেভাবে হরিরলুটের বাতাসা ও নকুলদানা
পাশাপাশি থাকে
ঝরে পড়ে ধূলায়
পথবালকের হর্ষে, বেদনায়।



ছায়া

আজ বিকেলে
তোমাকে দেখতে চেয়ে
স্টেশনে বড়-ঘড়ির নীচে দাঁড়িয়ে ছিলাম
তুমি আসোনি

বৃষ্টি এসেছিল…

অতঃপর তুমি এলে
চরাচর জুড়ে




আয়ু

কসাই—মাংস বিক্রি করে
পশু-মাংস, শ্বেত চর্বি, অভিন্নহৃদয় ছালরক্তহাড়।
ভক্ত যে, তারও মাংসের দোকান
নিজের মাংস সে উৎসর্গ করে প্রতিদিন
তার দেবতাকে।






জোনাকি

গভীর রাতের দিকে ট্রেন থেকে নেমে বুঝি—
যদি চলে যেতে চাই,
যদি আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করি,
আরও দূরে, আরও প্রান্তিক কোনো স্টেশানের
দিকে চলে যেতে পারি—
পরের ট্রেন বা তারও পরের কোনো ট্রেনে করে।

শুধু শহরের দিকে ফেরবার আর কোনো ট্রেন নেই।

মনে পড়ে,
আসা ও যাওয়ার পথ এক নয় আমাদের—

ওই পথে অনেক মিথ্যা ও মহামায়া
প্রায়ান্ধকার স্টেশানের কাছে
বুড়ো দেবদারু গাছটির মতো রয়ে গেছে।













পিছনের গল্প

অরফ্যান হোমের গাড়িতে একটা লাল রঙের জেলি
ভয়ে ক্রমে আবছা সবুজ হয়ে আসে
‘পৃথিবীতে সব আলোর উৎস হল সূর্য’—
একথা জেনেও, বিখ্যাত হতে চাওয়া
একটি তারা, খসে পড়ে পরিচালকের
সাজানো বাগান বাড়ির ছাদে।
ওষুধ দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে, এরকম কোনো ফুল
কাল রাত থেকে নীল হয়ে গেছে…

এইসব রক্তপাত অথবা রক্তের ধারাবিবরণী
ঘাম নিঃসঙ্গতা অথবা চোখের জল—
এদের সবার পিছনেই কোনও না কোনো গল্প আছে।
এ’সব কোথায় পাব আমি ?
যার সামনে দুনিয়াশুদ্ধু মানুষ
ঝুঁকে পড়ে দেখে নেবে
যার যার নিজস্ব কালশিটে লিঙ্গপ্রহার ফলিডল…


পূর্বা মুখোপাধ্যায়-এর কবিতা




রসিয়া
      
আলতো, খুব আলতো ওই আলো
বেসেছিলাম ভালো

আলতো, এত আলতো ওই হাসি
এখনও ভালোবাসি

অন্ধ আমি,আলতো ছুঁতে আড়াল লাগেনা
অন্ধ করে বাঁচিয়েছ ভাগ্যিস !

তুমি আমায় আলতো ভাষা শেখাও
আলতো যবের শিষ


আঙুল জানেনা,
মন কীভাবে লিখিত হল পায়ে
তুমি পা রেখেছ আনমনে লুকোনো কাঁটায়
"ওই অকথিত আনন্দের ছাপে
আমার পাপড়িগুলি ঝরে যাক" বলে
পথ এত রাঙালাম, কুসুমে চরণচিহ্ন দিও।

গোলাপ জানেনা, কেন ফুটেছিল কাল।
আমি জানি। 
লুকোনো কাঁটার দোষে রাতুল চরণে আমি 
মধু ঢালি, শ্রীচরণকমলেষু, আবিরগুলাল...

অংশুমান কর-এর কবিতা




মরণ

সকালে উঠে খুলে দিই জানালা
নবীন সন্ন্যাসীর মতো রোদ এসে পড়ে বিছানায়।
ভাল লাগে।
বেলা একটু বাড়লেই
সামনের পলাশ গাছে এসে বসে টিয়াপাখির ঝাঁক
ভাল লাগে।
বিকেলের দিকে মাঝে মাঝে এসে দাঁড়াই বারান্দায়
দেখি পাতা খসে পড়ার মতো নিঃশব্দে
সন্ধে নামছে।
ভাল লাগে।

মারা গেছে কত মানুষ।
কত মানুষের চাকরি নেই। কত কত মানুষ
বাড়ি ফিরবে বলে হাঁটছে তো হাঁটছেই...
আর আমার ভাল লাগছে রোদ্দুর,
ভাল লাগছে টিয়া, ভাল লাগছে সন্ধে।।

ওগো আমার সৌন্দর্যের প্রতি লালসা,
তোমার মরণ কবে হবে?

বিশেষ নিবন্ধ অশান্ত সমুদ্রে ভাসছে আমাদের জলযান বিশ্বদীপ চক্রবর্তী





এক একটি পরিবার আজ হঠাতই এক একখানা প্রস্তুতিহীন আস্ত জাহাজ। সমুদ্রে পাল তুলে চলেছে নিজের নিজের জীবন তরণীর।   
কি গো যাত্রীরা গন্তব্যের কিছু জানা আছে নাকি?
ও নাবিক কোথায় নিয়ে চলেছো? জানো কিছু তার? কোন অক্ষারেখা কোন দ্রাঘিমারেখায় পৌঁছালে তবে এই যাত্রার ক্ষান্তি?
ভোঁ দিতেই বাধ্য নাবিকের মত দড়িদড়া খুলে ভেসে পড়েছি সবাই। এখন মাস্তুল ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছি। ভাসার আগে যে যা পেয়েছি রসদ তুলে ভাঁড়ার বোঝাই করেছি। কে জানে পারে ভিড়ানো যাবে না কত দিন, কত মাস।
থাকবে তো রসদ, ততদিন? উত্তরের অপেক্ষা না রেখেই যাত্রীরা একে অপরকে প্রশ্ন করে। 
চালিয়ে নিতে হবে। সমুদ্র যাত্রায় খুদকুড়োও ফেলনা নয় কিছু। অপচয় করা যাবে না। সাবধান করতে করতে চিফ মেট সব রসদ হিসেব করে তুলতে থাকে। 
কাপ্তান অভয় দেয় যাত্রীদের। হিসেব মত চলতে পারলেই একদিন ঠিকঠাক নিশ্চিন্ত ডাঙ্গায় পৌঁছে যাবো।
মাংকি আইল্যান্ডে উঠে জাহাজের বড় নাবিক চোখে দূরবীন ঠেকালেন। যতদূর চোখ যায় কোন জনপ্রানী নেই যে।
ওই যে? একটা কাঠবেড়ালি? ডেকের উপর লেজ তুলে সন্তর্পণে চলেছে। আঙ্গুল তুলে দেখাল সেকেন্ড মেট।
আর ওই যে পাখিটা মাস্তুলের উপর? আমাদের সঙ্গেই যেন চলেছে, সমুদ্র যাত্রায় পাখি সঙ্গে থাকা বড় পয়মন্ত। সারেং-এর চোখের জালিতে একমুঠো বিশ্বাস। 
মন্দ কি, একটু বৈচিত্র্য। দিনের পর দিন ভেসে বেড়াবার জীবনে এরাই হবে বেঁচে থাকার খোরাক।
তাই বলে আবার এদের খাওয়াতে ছুটো না যেন। স্টুয়ার্ট পইপই করে সাবধান বানী শোনায়।
শুনেই থার্ড মেটের চোখ ছলছল, ওদের তো আর নিজেদের ভাঁড়ার নেই। ওরা বাঁচবে কি করে?
আমাদের তাতে বয়ে গেছে, খুঁটে খাবে। মুখে কড়া কথা বললেও স্টুয়ার্টের নাকের ডগা দিয়ে যখন পাখির খাবার ছড়ানো হয়, দেখেও না-দেখা করে থাকেন। 
আর সব জাহাজ ছেড়েছিল তো?
রেডিও অফিসার খবর আদান প্রদান করেন অন্য জাহাজের সঙ্গে। ক্যাপ্টেনের এই প্রশ্নে চোখ তুলে তাকাল। জানা গেল বন্দর ছাড়ার আগেই এক জাহাজে অসুখ ঢুকে পড়েছিল। সে জাহাজ আর ছাড়ল না।
হে ভগবান, তাহলে ওদের কি হবে? থেকে যেতে হবে ডাঙ্গায়? সারেং আর্তনাদ করে উঠলেন।
না, নামতেও পারছে না। এখন তো ওরা কোয়ারেন্টাইন।
ক্যাপ্টেন নিজের জাহাজের খোঁজ খবর চান এবার, আমাদের জাহাজে সবাই দুরস্ত আছে তো?
দুই একজনের সী সিকনেস হচ্ছে, এছাড়া সব ঠিকঠাক।
তাহলে চলতে থাকো। কারো জন্য এখন থামার উপায় নেই। সবাইকে এখন ভেসে বেড়াতে হবে, এগোতে হবে নিজের পথে যতদিন না নোঙর ফেলার জন্য জুতমত একটা তীর পাওয়া। খুঁজে পেতে হবে এমন এক বন্দর যেখানে কোন অসুখ নেই, জরা নেই, মৃত্যু নেই, শোক নেই। বুঝেছ সবাই? দিগন্তে চোখ রেখে বসে থাকো, ওয়াচে আছো তো সবসময়ে? 
হট্টমালার দেশের খোঁজে এমনিভাবেই ভেসে চলে এই অলৌকিক জলযান। সমস্ত জাহাজের সব যাত্রীর মত তাদের মনেও বিশ্বাস এই জাহাজের মাথায় আছে আশীর্বানী। আশ্বাস দিয়েছে কাপ্তান। সব ভাল হবে, পৌঁছে যাবে একদিন নিশ্চিত ভরসার জায়গায়।
তবু একেকদিন আকাশ কালো হয়ে আসে। দেখা দেয় ভয়ানক দুর্যোগ। আকাশ ঠিক ভেঙ্গে পড়বেই এইবার। মাস্তুলের দড়িদড়া ছিঁড়ে যেন উতাল বাতাসে উড়ে যাবে এই জাহাজ। তুষার বৃষ্টিতে অন্ধকার আরও গভীর। পোর্ট হোল খুললেও কিছু দেখা যাচ্ছে না কোথাও। শব্দতরঙ্গে এদিক ওদিক জাহাজডুবির বার্তাও ভেসে আসে বুঝি।  রেডিও অফিসার, কে গেল? কাদের পালা ছিল এবার? এই যাত্রায় পেছনে তাকিয়ে দেখার দস্তুর নেই। বিগতরা দ্রুত সংখ্যা হয়ে যায়। সংখ্যারা জাহাজের মাথায় খলখল করে হাসতে হাসতে নেচে বেড়ায়। সবাই জড়ামুড়ি করে, আয় আমরা বেঁধে বেঁধে থাকি।
ক্যাপ্টেন আশ্বাস দিতে চায়। ভেবো না তোমরা। অচিরেই আয়ত্তে এসে যাবে এই ঝড় ঝঞ্ঝা। গলা ছেড়ে হাঁক দেয়। রেডিও অফিসার! কি খবর আসছে শব্দ তরঙ্গে? কেন তোমার মুখে কথা সরছে না এখন? জাহাজের নাবিক, সেকেন্ড মেট, থার্ড মেট এমন জবুথবু হয়ে গেলে কেন তোমরা সবাই?
কাপ্তানের এতো হাঁকডাকেও সাহস জাগাতে পারছে না যে। সবার চোখে ভয়ের ছায়া। শুধু সারেং-এর কোন হেলদোল নেই। বরং সে শোনায় আগের আগের ঝড়ের কথা, এটা তো তার প্রথম সমুদ্র যাত্রা নয়! যেদিন দক্ষিণ সমুদ্র এমনি উত্তাল ছিল আর তাদের পুরনো মাস্তুলভাঙ্গা জাহাজ কেমন খাবি খাচ্ছিল, কথকতা শোনানোর মত সুর করে শোনায় সারেং। সেই জাহাজের কাপ্তান কেমন মাথা ঠান্ডা করে সামলাচ্ছিল তাদের জাহাজ। ছিল বটে সে এক বাজখাঁই লোক। কম্পাস গেছিল ভেঙ্গে, দিকনির্দেশ ছিল না কোথাও। তবু তাকে হার মানানো সহজ ছিল না মোটে।  শেষে কেমন এক বিশালকায় পাখি উড়ে উড়ে তাদের পথ দেখিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল শান্ত সমুদ্রে। শুনতে শুনতে সবাই সারেংকে ঘন হয়ে ঘিরে আসে, তাদের শরীর আবার সাহসে ডগমগ করে ওঠে। 
চিফ মেট দৌড়ে মাংকি আইল্যান্ড উঠে আরও সবাইকে জানাতে চায়। শুনছো, কে কোথায় আছো! ভয় পেয়ো না কেউ। তোমরা কি জানো না এমন আগেও হয়েছে। এরকম উত্তাল সমুদ্রে প্রাণ হাতে করে জাহাজে পাড়ি জমিয়েছে আমাদের মত মানুষ। সব দুঃস্বপ্নের রাতের মত এই কাল রাতও একদিন শেষ হবে। ভয় পেয়ো না কেউ, শুধু সজাগ থাকো। সতর্ক থাকো। এই অশান্ত সমুদ্র এক সময় নিবিড় হবে, হবেই। আমাদের জীবন তরণী আবার তড়তড়িয়ে এগিয়ে যাবে। 
তেমনি আর এক সকালে আকাশ ঝকঝকিয়ে ওঠে। রেডিও তরঙ্গে অন্য জাহাজিদের বিপদমুক্ত হবার খবর আসে। জানা যায় কোয়ারেন্টাইন হওয়া জাহাজও ছেড়ে দিয়েছে আবার। আনন্দের উল্লাস ছড়িয়ে পড়ে জাহাজের কোনে কোনে। এও তো এক রকমের জয়। একজন জিতে অন্যদের আশ্বাস জোগায়। ডেকে আবার কাঠবেড়ালিটা আনন্দে নেচে ওঠে।  জাহাজে এখন ক্রুজ শিপের আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে। উতসব। লাস্যময়ী তরুণীরা নাচতে নাচতে নেবে আসছে ডেকে। তরবারি ঝনঝনিয়ে রাজকুমার আসছে রাজকন্যার সন্ধানে। জাহাজের যাত্রীরা উবু হয়ে বসে দেখছে। নাবিক তার ওয়াচ ডিউটি ভুলে গেছে, রান্না ছেড়ে স্টুয়ার্ড প্যাকেজ খুলে খাবার গরম করে বেড়ে দিয়েছে, সোনামুখ করে সেটাই খাচ্ছে সবাই। কাপ্তান উদ্গিগ্ন হয়ে তাকালে স্টুয়ার্ট আশ্বস্ত করে। যেন তার অন্নপূর্ণার ভান্ডার। আছে আছে, ভয় করোনা ক্যাপ্টেন। রসদ এখনো মজুদ।
জানে ক্যাপ্টেন, বোঝে না কি? যতদিন যাবে রসদ তো কমতেই থাকবে। খরচ করতে করতে রাজার আঁড়তও একদিন তলানিতে ঠেকে। বুকের ভিতর গুড়গুড় করে ওঠে তার। পারবে তো সবাইকে সামলিয়ে নিয়ে যেতে? কদিন বাদে সি সিকনেস দেখা দেবে, অস্থির হয়ে উঠবে সবাই ডাঙ্গায় নেবে রোজকার জীবনে পা রাখার জন্য। একটু একটু করে খাবার কমে আসবে, জল ফুরাতে থাকবে। মন দুর্বল হতে থাকবে। কাপ্তানের কথা শুনতে চাইবে না তখন কেউ আর। বেশি দেরী হলে ওদের বিশ্বাসে চিড় ধরবে।
কাপ্তান জানে ওটাই আসল শক্তি। বিশ্বাস, শুধু এক অপরের জন্য ভরসা অটুট রাখতে পারলেই ভেসে থাকা যাবে। চলতে চলতে ইঞ্জিন দুর্বল হয়ে পড়বে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভেঙ্গে পড়তে পারে জাহাজ। তবু এই জলযানকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে, ভাসিয়ে রাখতে হবে। হাতে হাত ধরে থাকা চাই। মনে করিয়ে দেয় চিফ মেটকে। সারেং-এর চোখ থেকে ফিরে ফিরে খোঁজে আশ্বাস। 
সবাই আশায় বুকে বেঁধে ভাসতে থাকে নিরাপদ বন্দরে নোঙর নাবানোর প্রতীক্ষায়।       

চৈত্রের বাতাসে লেখা: অমর মিত্র






আমি ঢুকে যাব কি ভয়ের  কৃষ্ণগহ্বরে ?  সমস্ত সত্য, সমস্ত সুন্দর গ্রাস করে নেয় এই গহ্বর। টেনে নিয়ে নিঃশেষ করে দেয়। আমি টেলিভিশনে দেখলাম আলো মাখানো সংবাদ। লিখলাম,

প্রথম আক্রান্ত  সুস্থতার পথে। তার দ্বারা সংক্রমণ  হয়েছে  বলে জানা যায়নি। এক বৃদ্ধের হয়েছে,  তার স্ত্রী পুত্রের হয়নি। এসবই  আশার আলো।  এই যে এত মানুষ ঘরে ফিরবে বলে দিল্লির বাস টার্মিনালে জমা হয়েছেন, এদের  বিমান ভ্রমণের ইতিহাস  নেই।  এদের আছে মাইলর পর মাইল পায়ে হাঁটার  অভ্যাস। এদের কাছাকাছি বাবুরা যান না, এদের সংক্রমণ  হবে না। হে ভারতবর্ষ,  এরাই তোমার প্রাণ। এরাই শক্তি।  এদের কাজ গেছে। তাই পেটে ভাত নেই। এদের ভাত রুটি  চাই। এরা না হলে আমরা পরজীবী মানুষ  বাঁচব না।  মনে করুন চাযাবাদ নেই, গমের ক্ষেত শূন্য, মনে করুন  রেস্তোরাঁয় পরিচারক নেই, বারে ওয়েটার নেই, আমার জীবন চলবে?  চলবে কাগজ পৌঁছে  দেওয়ার  হকার না থাকলে, সব্জি ডিম বিক্রেতা  না থাকলে? কফি হাউসের বেয়ারা না থাকলে মজলিশ  হবে?  জন্মদিনের  পার্টি  হবে এদের ছাড়া। মুড়ি, চিড়ে না ভাজলে খাব কী? এদের জন্য আগে ভাবতে হবে। সরকার এই মানুষের  পাশে দাঁড়ান। তিন মাস ই এম আই দিতে হবে না ঋণের। এদের জন্য কী প্যাকেজ?  আছে। তা যেন ও পি এল, বাবু  বি পি এল সেজে খেয়ে না নেয়। ত্রাণ এলে স্থানীয় বাবুরা ফুলেফেঁপে  যান। তা যেন না হয়।  ঐ যে সন্তান কাঁধে  নিয়ে  হেঁটে  চলেছেন ভারত জননী, ওঁকে গ্রামে পৌঁছে  দিন। উনি অভুক্ত।  ওঁর ঘরে খাদ্য দিন। যদি ভুল বলে থাকি মার্জনা করবেন।

আমার কেমন মনে হচ্ছিল এই জনতার কিছু হবে না। এরা সংক্রামিত হবে না। এদের দায়িত্ববোধ অনেক বেশি, এদের প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক বেশি। মন্বন্তরে মরিনি আমরা, মারি নিয়ে ঘর করি। কে ঘর করেন, কারা মারি নিয়ে ঘর করেন ? না, আমরা নই। আমরা সুখে থাকি। গাড়ি বাড়ি ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স নিয়েই সারা বছর ভাবিত থাকি। থাকি বহুতলে, থাকি ক্ষমতার পাহাড়চূড়ায় বসে, মারি  নিয়ে ঘর করেন তাঁরা যারা শত শত মাইল হেঁটে বাড়ি ফিরছেন। চেন্নাই থেকে ফিরেছিল যারা তাদের কাহিনি বলি। অনেক পথ পার করে তারা বরাভূম স্টেশনে নেমেছিল। তারপর হেঁটে গ্রামের পথে। বাড়িতে কি আলাদা ঘর আছে যে কোয়ারান্টিনে যাবে ? গাঁয়ের মানুষই তাদের জন্য ব্যবস্থা করে রেখেছিল। গাছের উপর খাটিয়া বেঁধে মশারী টাঙিয়ে দিয়ে তাদের বলল, ঐভাবে চোদ্দ দিন অশৌচ পালন কর। তারা তাইই থাকল। বুঝুন গ্রামের মানুষের সচেতনতা।  তারা জেনেছে  এই রোগ প্রথমে লুকিয়ে থাকে, বসন্ত রোগের মতো একটু একটু করে ফুটে উঠতে থাকে।  তখন ছোঁয়াছুঁয়ি হলে ছড়িয়ে যাবে। বলছি,  এঁরা অক্সফোরডে পড়েন না, এঁরা সুইৎজারল্যান্ড থাকেন না, এদের বাবারা ডাক্তার নন, ব্যবসায়ী নন, কিন্তু এঁরা জেনেছেন কী করতে হবে। একা হয়ে থাকতে হবে চোদ্দদিন। বাড়িতে মৃত্যু  মানে বাড়ি দূষিত হয়েছে, মৃত্যুর বীজানু রয়েছে ঘরবাড়ি, মৃতের বিছানা মাদুরে। সুতরাং বাড়ি বীজানু মুক্ত করতে হয়, মৃতের বিছানা পুড়িয়ে ফেলতে হয়, শ্মশান থেকে ফিরলে নিমপাতা।লোহা, আগুনে শুদ্ধ হতে হয়।  চোদ্দ দিন অশৌচ পালন মানে কোয়ারান্টিনেই থাকা। এসব আমাদের সামাজিক এবং ধর্মীয় আচার।  পক্স হলেও, অমনি বারো দিন পরে নিম পাতা হলুদ দিয়ে স্নান, এই আচার তো সেই কোয়ারান্টিন থেকে মুক্ত হওয়া। সেই শ্রমিকরা  বাড়ি না গিয়ে গাছে বাঁধা খাটিয়ার উপরে থেকে কোয়ারান্টিন  অশৌচ পালন করতে লাগলেন। হাটেও গেলেন না, বাজারেও না। বুক বাজিয়ে বললেন না, খড়্গপুর থেকে আসা হলো বটে। পুরুলিয়া জেলার খবর এই। কদিন বাদে বিডিও জানতে পেরে অঙ্গনওয়ারি কেন্দ্রে তাঁদের থাকার ব্যবস্থা করেন। মারি নিয়ে ঘর করেও এই ভাবে বেঁচে থাকে এই দেশের মানুষ। এই জনগোষ্ঠীর  অসামান্য সমাজবোধ। এই শিক্ষা আমাদের মধ্যে নেই। 

আমরা ভয় তাড়াতে সময় কাটাতে কত রকম প্রয়াস না চালাচ্ছি।  কেউ বিশ্ব ক্রিকেট একাদশ তৈরি করছেন। আমিও বললাম, আমার নামটা ঢুকিয়ে দাও প্লিজ। শ্যামসুন্দর মিত্র, কল্যাণ মিত্রর সঙ্গে অমর মিত্র...হা হা হা।

সন্ধ্যায় দাদা ফোন করেছিলেন। দৈবপাখি নাটকটি ২৮শে মার্চ মঞ্চস্থ হওয়ার কথা ছিল। হলো না। ৮১ পার হয়ে গেছেন। অনেকদিন পায়ের সমস্যায় ভুগেছেন। বেরোন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বছর দেড়।  তারপর এই নাটক নিয়ে ফিরে আসতে চেয়েছিলেন। নাটকের মানুষের নাটক ছাড়া আর ফেরা হবে কীভাবে ? নাটকটি অনেক পরিমার্জন করেছেন। আমি পড়েছি। সক্রেটিস এই নাটকের প্রধান চরিত্র।   আমার কাছে দুঃখ করছিলেন, রিহার্সাল খুব ভালো হয়েছিল, ২৮ তারিখের শো খুব ভালো হত, আবার সব নতুন করে গড়ে তুলতে হবে। কবে হবে তা আমার কাছে জানতে চাইলেন। যেন আমি সব জানি। আমি বললেই হয়ে যাবে। বয়স হলে নির্ভরতা দরকার হয়।  আমি খবরিয়া। কত খবর রাখি। আমাকে ফোন করে পরামর্শ নেন। খোঁজ নেন দেজ পাবলিশিঙের অপু কিংবা করুণা প্রকাশনীর বামাবাবু কেমন আছেন। সকলে ঘরে থাকছে তো?    খোঁজ নিলেন আমরা কেমন আছি।  চাল ডাল, আলু, ডিম ঘরে আছে  তো ?  আমি বললাম তুমি ইউ টিউবে পুরোন ছবি দেখতে পার। দাদা বললেন, ইন্টারনেট আছে, কিন্তু ওসব পারি না।  এই বয়সে তা আর সম্ভব নয়। ও বাড়িতে যাঁরা থাকেন সকলে বৃদ্ধ। কেউ ইন্টারনেটের ব্যবহার  জানেন না। দাদার হোয়াটস আপ করা অ্যানড্রয়েড ফোনটিও নষ্ট হয়ে গেছে এই সময়। আমি জানি রোদ ওঠার আগে এবং রোদ  পড়লে তিনি বসে থাকেন ব্যালকনিতে। সামনে একটি নিমগাছ।  একটি কেরল দেশীয় নারকেল গাছ। বাড়ির পিছনে হিমসাগর আমের গাছ। গাছে বৌল এসেছে। তার গন্ধ বাড়িটিকে ঘিরে আছে। এই সুগন্ধ কি ভাইরাস আটকাতে পারবে ? শুনতে পাচ্ছেন দূষণ নেই। আকাশ পরিস্কার হয়ে গেছে। বাতাসে ধূলিকণা কম। হৃদযন্ত্রে  একবার বাইপাস এবং স্টেইন বসেছে আর একবার। বাইপাস হয়েছিল ২০০৩ সালে। স্টেইন ২০০৯-১০ নাগাদ। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, শুনতে পাচ্ছি উত্তর মেরুর হিমবাহ গলন থেমে গেছে। 

হ্যাঁ, আমি হোয়াটস আপে পেলাম।

দাদা জিজ্ঞেস করলেন, শুনতে পাচ্ছি ভেনিসের ক্যানেলে হাঁসেরা ফিরে এসেছে ?

হুঁ, কে যেন বলল,  উটি থেকে কোয়েম্বাটোরের  রাস্তায় হরিণ বসে আছে, ফেসবুকে দেখা গেছে।

আমাকেও ফোন করে বলল একজন, আমার অ্যানড্রয়েড ফোনটা নেই, আমি হোয়াটস আপে এসব পেলাম না, আকাশ বাতাস দুশো বছর আগের মতো হয়ে যাচ্ছে ? 

হতে পারে।

তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এখন অনেক দূর দেখা যাবে ?

যাবে বলতে দাদা বললেন, আমার ব্যালকনি থেকে অনেকদূর দেখা যাচ্ছে মনে হয়, আগে যা দেখতে পেতাম না, তা...।

৮১ বছর পেরিয়ে ৮২-তে পা দেওয়া অভিনেতা, নাট্যকার, দার্শনিক বসে আছেন তাঁর ব্যালকনিতে। তিনি তাকিয়ে আছেন বহুদূরে। আকাশ বাতাস পরিষ্কার হয়ে গেছে। সীমান্তের অদৃশ্য দেওয়াল সরে গেছে।  তিনি দেখতে পাচ্ছেন সব।  ঐদিক পুব। তাঁর জন্মভূমি। ঐ দিক পুব, তাঁর ছেলেবেলা...সাতক্ষীরে, ধূলিহর, বেত্রবতী, কপোতাক্ষ, ময়মনসিংহ, কালিহাতি, ব্রহ্মপুত্র, নেত্রকোণা, গারোপাহাড়...সব ফিরে আসছে তার কাছে। আহা, এই জীবনে এমনও দেখা যায়। বাংলাদেশ মনে পড়তে লাগল। খুলনা, রূপসা, ১৯৪৭, লঞ্চঘাটে হারিয়ে গিয়েছিল রঙিন ছাতা। অকালে চলে যাওয়া সেই বোন, ডিলডিল...সকলে মুখ দেখাচ্ছে দূর থেকে।

হ্যাঁ বাংলাদেশের খবর এল, তরুণ লেখক মোজাফফর হোসেন লিখলেন ৩০ তারিখে। কবি এবং উপন্যাস লিখিয়ে ভাস্কর চৌধুরীর বোন করোনা কিংবা নিমোনিয়ায় মারা গেছেন চাঁপাই নবাবগঞ্জে। তিনদিন আগের ঘটনা। ভাস্করের বোনের মৃত্যু সংবাদ আমি দেখেছিলাম। ভাস্কর শেষ দেখা দেখতে যেতে পারেনি। আতঙ্ক। এবং উপায় ছিল না যাওয়ার। করোনা টেস্ট হয়নি। মোজাফফর ভাস্করের কবিতা নিবেদন করেছে ফেসবুকে। তার একটু অংশ...

আমার আত্মার কসম
আমি এ লাশ
ফেলতে পারবো না।
এ লাশ আমার বোন ছিলো
অনেক বছর
এ লাশ আমার ভাই ছিল
অনেক বছর
এ লাশ
আমার পড়শী ছিলো
আশি টা বছর
আমি এ লাশ ফেলতে পারবো না
আমি বসে আছি
গায়ে জ্বর
কেউ কেউ চলে গেছে
আমি আছি
আমিও লাশ হবো
এ লাশের সাথে যোগ হবো
এম্বুলেন্স আসলে যাবো
না এলেও যাবো
সকলেই গেল
এ শহর ফাঁকা করে
অন্য কোথাও দালান উঠবে
এখানে মরে গেলে
হাসপাতাল হবে
বাড়ির উঠোন ভরে
কচি ঘাস হবে
লাশের সারে বেড়ে যাবে দ্রুত
তখন হাসপাতালগুলো
প্যাথলজি করে
লিখে যাবে
সর্দি ছিলো
জ্বর ছিলো
কাশি ছিলো
হাঁপানি
চিনি রোগ ছিলো
হার্টের সমস্যা ছিলো
ওরা সব আদ জাতির মতো
গজবেই মরে গেছে।...।
------------
                                                                 দুই
খবর পেলাম দক্ষিণ কলকাতায়  রাতে শিয়াল, ভাম বেরিয়ে আসছে। দিনেও দেখা যাচ্ছে তাদের। রবীন্দ্র সরোবর এলাকায় শিয়াল আছে অনেক। শব্দের ভয়ে তারা বেরোয় না। এখন সব নিস্তব্ধ। তারা নিশ্চিন্তে ঘুরছে ফিরছে। বন দপ্তর লক্ষ্য রাখছে। আজ হোয়াটস আপে নিউইয়র্কের টাইমস স্ক্যোয়ারের ছবি দেখলাম। খা খা করছে জায়গাটি। ওখানেই ব্রডওয়েতে নিউইয়র্কের বিখ্যাত নাট্যমঞ্চগুলি। সব বন্ধ।
দুপুরে দেবাঞ্জন চক্রবর্তী ফোন করেছিল। একটি খবর দিল, আমাদের এই এলাকায় কৃষ্ণমল্লিক লেনে তার বন্ধুর দাদা কোভিড ১৯-এ মারা গেছেন। মৃত্যুর পর তাঁর লালারস পরীক্ষার রিপোর্ট আসে পজিটিভ। তাদের পুরো পরিবারকে পুলিশ তুলে নিয়ে রাজারহাটে কোয়ারেন্টাইনে  পাঠিয়েছে। দেবাঞ্জনের ভাই খবর দিয়েছে দাদাকে। সে এখানে দেবাঞ্জনদের পুরোন বাড়িতে থাকে। আমি ভাবছিলাম ঐদিকে ডায়মন্ড টি সেন্টারে যাব চা আনতে। দেবাঞ্জনের কথায় কুঁকড়ে গেলাম। এত কাছে এসে গেছে ?  দুপুরে আগাথা কৃষ্টির গল্প পড়তে পড়তে সব ভুলতে লাগলাম। মহামারির ভয় কাটাতে লাগলাম। গত দুদিন ধরে পড়েছি গ্যাব্রিয়েল গারসিয়া মার্কেজ প্রণীত ‘ক্রনিকল অফ আ ডেথ ফোরটোল্ড’। প্রেম ও মৃত্যুর অভাবিত এক বিবরণ, যার সমস্তটাই বলে দেওয়া আছে, কিন্তু সমস্তটাই ক্রমশ অচেনা হয়ে যাচ্ছে। সমস্ত দেশে করোনা  আক্রান্তের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। নিজামুদ্দিনের জমায়েত হোক, রাম নবমী হোক, সবেতেই জমায়েত হচ্ছে ভালো রকম। ধর্মে মাথা মুড়িয়ে দিয়েছে মানুষ। জমায়েত থেকে  কে কোথায় ভাইরাসে সংক্রামিত হয়ে লুকিয়ে পড়েছে তা খোঁজা হচ্ছে। কী দাঁড়াবে ভবিষ্যৎ অজানা। কতদিন গৃহবন্দী হয়ে থাকতে হবে, জানি না। দুপুরে সিডনির তপনজ্যোতি মিত্রকে ফোন করলাম।  আমার ২০-২২ বছর বয়সের বন্ধু তপনজ্যোতি বহুদিন ঐ দক্ষিণ গোলার্ধে। ছিল নিউজিল্যান্ডে বহুদিন। এখন অস্ট্রেলিয়ায়। আমাদের দুপুর তিনটেয় ওদের সিডনিতে রাত নটা। আগের দিন ২৪ ঘন্টা কাজ করেছে। ও ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ার, ব্যাঙ্কিং  সেকটরে কাজ করছে। সকাল দশটায় কাজ শেষ করে ঘুমিয়েছে। এখন ওদের কাজের চাপ বেশি। ইস্টার পরব সামনে। না, সিডনি খোলা নেই। সমস্ত পরব বন্ধ হয়ে গেছে সরকারি ফরমানে। দিন পনের আগে ও বলেছিল, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য ফুরিয়ে যাচ্ছে মানুষের আতঙ্কের কারণে। আজ বলল, সব কিছু শান্ত হয়ে মেনে নিয়েছে মানুষ।  প্রথম সকালে সিনিয়র সিটিজেনরা বেরবেন। তারপর অন্যরা। হ্যাঁ, ইস্টার পরব, ক্রিসমাস পরবে কেনাকাটা বেশি হয়। পরব বন্ধ হলেও অনলাইনে কেনাকাটা হচ্ছে। বেশ চাপ আছে। ঘরে থেকেই মানুষ উৎসব করবে। নানা কথা হতে লাগল। লকডাউনের সুফল ফলতে আরম্ভ করেছে। স্পেন, ইতালি, ব্রিটেনের মতো অবস্থা ভয়ানক হয়নি অস্ট্রেলিয়ায়। তাদের সিডনিতে। তপনজ্যোতি বলল, দেখ অমর, ভাইরাস, এই যমদূতের ঘুম ভাঙিয়েছি আমরা। এমন মহামারি কতবার হয়েছে পৃথিবীতে। আরো হবে। আরো। দূষণ, হিমবাহর গলন এসব শুনেছ তো, আমি আমার নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলি। তপনজ্যোতি হিমবাহর নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার কথা বলল আমাকে। নিউজিল্যান্ডে থাকার সময়  আওরাকির মাউন্ট কুক ন্যাশানাল পার্ক দেখতে  গিয়েছিল তারা।  আওরাকি নিউজিল্যান্ডের দক্ষিণের দ্বীপভূমি। নিকটেই একটি শহর আছে ট্যাইজেল। মাউন্ট কুক নিউজিল্যান্ডের  সবচেয়ে বড় পর্বতমালা। মাউন্ট কুক অঞ্চলেই  গিয়েছিল তপনজ্যোতিরা। তারপর তাসমান হিমবাহ, হুকার হিমবাহ, লেক পুকাকি, লেক টেকাপো দেখেছিল। সবই হিমবাহ গলে জন্ম নিয়েছে।  হেলিকপ্টার তাদের নামিয়ে দিয়েছিল হিমবাহর উপর।  সে এক অনন্ত তুষার  স্ম্রাজ্য। মাথায় অপূর্ব এক ঘননীল আকাশ। তার সঙ্গের গাইড বলেছিল,  ছোটবেলায় তার ঠাকুরদার কাছে শুনেছিল, লেক ছিল না একশো বছর আগে, ঠাকুরদার ঠাকুরদা তাঁকে তাঁর বাল্যকালে বলেছিলেন  তা। ছিল হিমবাহ, বরফের বিস্তার ছিল অসীমে।  সেই বরফ গলে লেকের জন্ম হয়েছে। তপনজ্যোতি  বলল, সেই প্রথম দেখার কুড়ি বছর বাদে আবার গিয়েছিল সেই লেক দেখতে। দেখেছিল লেকের বিস্তার বেড়েছে, আর সেই হিমবাহ দূরে সরে গেছে। কুড়ি বছরে অনেকটাই গলে গেছে তা। এই এক মাস, দেড় মাস, দু’ মাসের লকডাউন হয়ত কিছু দূষণ কমাবে। হিমবাহগুলির গলন কমাবে উষ্ণায়ন কমলে।  তার বন্ধু এক  জৈব বিজ্ঞানী তাকে বলেছে,  আন্টারটিকায় হিমবাহর নিচে লক্ষ লক্ষ বছর  যারা ঘুমিয়ে আছে, উষ্ণায়নে বরফ গলে গেলে, তাদের ঘুম ভাঙবে। সভ্যতার  বিপর্যয় ঘটে যাবে তখন।  তপনজ্যোতিকে ঘুমতে যেতে বললাম। ওদের ওখানে রাত অনেক।  ঐ গোলার্ধে এখন শীতকাল আসছে। 
কিছুই করার নেই। বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলছি ফোনে। বই পড়ছি। স্ত্রী পুত্রের সঙ্গে কথা বলছি। ভবিষতের কথা আন্দাজ করতে চাইছি।  নেট অনুসন্ধান  করছি। করতে করতে অনলাইন আনন্দবাজার  পত্রিকায় ১৮৯৮ সালের  মহামারির কথা পেয়ে গেছি। প্লেগ মহামারি হয়েছিল।  দলে দলে মানুষ পালিয়ে যাচ্ছিল কলকাতা থেকে, সেই বিবরণ রয়েছে ‘ অনুসন্ধান ‘ নামে এক পত্রিকায়। সেই বিবরণ না শুনিয়ে পারছি না। খবরটি বেরিয়েছিল ১৩০৫ সালের ২৫শে বৈশাখ। কবির জন্মদিনে। 
 “কলিকাতার লোকের আতঙ্ক ভয়ানক বৃদ্ধি পাইয়াছিল। সকলেই বৈভব দূরে ফেলিয়া পুত্রকন্যা সঙ্গে লহিয়া শহর ত্যাগ করিবার জন্য প্রস্তুত হইল। কী ধনী, কী নির্ধন, কী বৃদ্ধ, কী বালক, কী যুবক, কী যুবতী– সর্বসাধারণের সে আশঙ্কা, সে ভয়, সে ভাবনা সহজে বর্ণনা করা যায় না। কেহ রেলওয়ে স্টেশন অভিমুখে, কেহ স্টিমার ঘাটে, কেহ নৌকা সন্ধানে, কেহ গড়িতে, কেহ পদব্রজে- যে যেরূপে যেদিকে সুবিধা পাইল সে সেইরূপ সেইদিকে ছুটিতে লাগিল।...সহস্র সহস্র লোক ভাগীরথীর বক্ষে হাওড়া স্টেশন অভিমুখে ছুটতে লাগল। স্টেশনে দুই হাজার করিয়া লোক বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। টিকিট কিনিয়াও স্থান না পাইয়া সেদিন ৫০০ লোক ফিরিয়া আসিল। অবস্থা বুঝিয়া রেল কোম্পানি নিয়মিত ট্রেন ব্যাতীত অতিরিক্ত তিনখানি ট্রেনের বন্দোবস্ত করিলেন। সমস্ত ট্রেনই পরিপূর্ণ হইয়া গেল। শেষে মালগাড়িতে লোক লইতে বাধ্য হইলেন। স্টেশন হতে পোল পর্যন্ত লোকের ভিড়ে চলাফেরা বন্ধ হইয়াছিল। শেষে গাড়ি, পাল্কি, নৌকা মেলা ভার হইল। অনেক পুত্র-পরিবার লইয়া ব্যতিব্যস্ত হইয়া হাঁটিয়া পলাইতে আরম্ভ করিলেন’। তখন গুজব রটে যে কোয়ন্টাইন জারি হবে।”
না এখন কেউ প্রাণভয়ে পালাচ্ছে না। বরং গৃহে বন্দী হয়ে আছে। ঘর থেকে বেরলেই অদৃশ্য ঘাতকের ছায়া। চৈত্রের বাতাসের ঢেউ শুরু হয়ে গেছে। সেই বাতাসের গায়ে  পেনসিল, কলমে  এসব লেখা এমনিই ভেসে  যাবে।




বিশেষ নিবন্ধ: অতিমারী কিংবা সতীর শীতল শব কোলে... সরোজ দরবার







আসুন, ক-টা পাড়া আঁকি। দাসপাড়া, মণ্ডলপাড়া, বামুনপাড়া...। পাড়ার প্রান্ত থেকে প্রান্তে এঁকে দিই লালচে কি মেটে রঙের একটা নদী। আঁকাবাঁকা ক্ষীণ শরীরে সে ছুঁয়ে থাকুক প্রতিবেশী। কেউ কেউ তার নাম দেবে পথ। সে-পথ ধরেই পাড়া বেড়াতে বেরাবে বউ-ঝিরা; অথবা বেকার ছেলেটা; দুরন্ত কিশোর; আর বয়স্কা প্রতিবেশিনীর সামনে পড়ে কী তিরস্কৃতই না হবে। এমনি করে কত সূর্য উঠবে পূবের রাংচিতা গাছের ঝোপ থেকে। ডুবে যাবে পশ্চিমের বাঁশঝাড়ে। তারপর একদিন যখন ওই বামুন, মণ্ডল কি দাসপাড়ার বয়স্কা খিটখিটে মুখরা প্রতিবেশিনীর শ্বাস উঠবে- মরণ এসে দাঁড়িয়ে দোরগোড়ায় - তখন পাড়া ঝেঁটিয়ে লোকে এসে তাঁকে দেখে যাবে। সকলেরই মুখ মেঘলা; বলবে, বড্ড মুখরা ছিল, কিন্তু বড়ো ভালো ছিল গো মানুষটা; কখনও কারও ক্ষতি করেনি।

কত সহজে আমাদের রং-পেন্সিল কাগজের উপর সরে সরে যায়। কত অনায়াসে আমাদের স্মৃতি এই ছবি এঁকে ফেলতে পারে। এ-ছবির ভিতর যদিও আর আমরা বাস করি না।

আসুন, আর-একটা ছবি আঁকি। কোনও এক নিউল্যান্ড অ্যাসোসিয়েশন আর ওয়ান্ডারল্যান্ড সোসাইটি বসে আছে মুখোমুখি। একটা কালো রাস্তা ছুঁয়ে আছে তাদেরও। কিন্তু নিউল্যান্ড থেকে ওয়ান্ডারল্যান্ড বেড়াতে বেরিয়েছে এমন কাউকে আঁকতে পারছে না আমাদের পেন্সিল। এমন কাউকে সে চেনেই না বস্তুত; সূর্যটাও সেখানে কেবল মাঝখানে থাকে। পূব-পশ্চিম ঢেকে গেছে হাইরাইজে। কারো জন্য নেই কারো তিরস্কার; কারো জন্য নেই কারো সমবেদনাও। তবু ঢাউস কমিউনিটি হল আছে। পুজো হোক বা দোল, শৌখিন ‘গলে লাগ যা’ আছে; খানা-পিনাও আছে। শুধু পাড়া নেই। আনাগোনা নেই। নেই পাড়া ঝেঁটিয়ে বেরিয়ে পড়ার গল্প; কারুর জন্য চুকুচুক, দুঃখ পাওয়া। অথচ আশ্চর্য এই যে, এই ছবিটার ভিতরই এখন অসংখ্য কালো কালো মাথা। আমরাও এখানেই থাকি।

তাহলে কি সেইসব পাড়ারা আর নেই? আছে এখনও; খানিকটা বদল নিয়ে। আর সেই পাড়ার ভিতর থেকে সার সার পরিযায়ী একদিন পোঁটলা-পুঁটলি নিয়ে এই ওয়ান্ডার কি নিউল্যান্ডের ভিতর ঢুকে পড়েছে। পুরনো পাড়ায় তাদের শিকড়ের মাটি আলগা হয়েছে, বহুদিন হল; আর নতুন ল্যান্ডের কংক্রিট ফাটিয়ে শিকড় আর জমে ওঠেনি; একদল উদ্বাস্তু তাই ঘোরেফেরে প্রতিবেশীর ছদ্মবেশে।

এইবার, এই দুটো ছবিতেই আসুন, খানিকটা সংকট রেখে আসি। দুটো ছবির ওপর দিয়ে আলতো করে বুলিয়ে দিতে থাকি মৃত্যু। দেখা যাবে, সাদা কাগজে ফুটে উঠছে ভয়, আতঙ্ক। দুটো ছবিই ব্যাপক বদলে যাচ্ছে; তবে, এর ভিতরেও কোথাও ফুটে উঠছে সমবেদনা, সহানুভূতি; মৃদু রেখায়। সেটা ঠিক কোন ছবিতে, তা আপনারাই ভালো বিচার করতে পারবেন।

এই দুটো ছবি পকেটে নিয়েই আমরা এগোচ্ছিলাম। আমাদের এগোনো ছাড়া আর কোনও রাস্তা ছিল না। কিন্তু সংকটটা যে ছিলই, তা আমরা ভুলেই থেকেছি। আমরা কখনও ধৃতরাষ্ট্র; দেখেও না-দেখার দোষে দুষ্ট। কখনও আবার পাণ্ডু; সাক্ষৎ মৃত্যু জেনেও সংবরণ করতে যে পারেনি সম্ভোগকে। এই দুই চরিত্র সমকালে সম্ভব হয়ে উঠলে একটা যুদ্ধ আসন্ন হয়ে পড়ে; কুরুক্ষেত্র ঠেকানো যায়নি। আমাদের এগোনোর ভিতরে এত যে মৃত্যুর ওঁৎ, জেনেও আমরা প্রতিহত করিনি সে-সব। প্রকৃতি-পরিবেশ মাড়িয়ে এগোতে-এগোতে, উৎকট বস্তুগত ভোগের পৃথিবীর দিকে ক্রমাগত ঝুঁকতে-ঝুঁকতে, যন্ত্রকে ঈশ্বর করে তুলতে-তুলতে, ক্ষমতাকে আনুগত্য দেখাতে-দেখাতে, যেদিন আমরা টের পেলাম অতিমারীর মুখে পড়ে গেছি, সেদিন আমাদের কোথাও আর দু-দণ্ড বসার অবসর নেই। নেই এমন কোনও মত ও আদর্শ, যার সামনে গিয়ে আশ্রয় চাওয়া যায়। এখন অসংখ্য পরিযায়ী কেবল হেঁটে চলেছে, জীবন থেকে জীবনহীনতার দিকে; প্রাণ থেকে অপ্রাণের দিকে; তাদের কেউ কিছুমাত্র সাহায্য করছে না তেমন। অথচ তাদের নিয়ে আলোচনা হচ্ছে বিস্তর। এ-এক আশ্চর্য নৃশংসতা। সেই আদিম অরণ্যে পশুকে ঘিরে ধরে শিকারের মতোই। শুধু তফাৎ এই যে, এখানে দুই পক্ষই মানুষ; আধুনিক মানুষ;

এই আধুনিক মানুষের কায়া-ছায়াকে নিরীক্ষণ ও বিশ্লেষণ করেছিলেন মার্টিন বুবের। প্রথমেই তাঁর মনে হয়েছিল, এই যে পুরনো সংস্থানগুলো ভেঙে গেল, তার ধারণাগুলো আমাদের চেতনা থেকে অপসৃত হতে থাকল ক্রমশ, তার মূল্য আমাদের চোকাতে হয় বা হবে একটা বুর্জোয়া সমাজে প্রতিনিয়ত বসবাসের মধ্য দিয়ে। পরিবার, গ্রামসমাজ, পাড়া ইত্যাদির সংযুক্তি, আত্মিকতার বদলে আধুনিক মানুষের হাতে এল যে ধরনের সংস্থান- অর্থাৎ, ক্লাব বা শ্রমিক ইউনিয়ন বা পার্টি ইত্যাদি – তা কিছুতেই মানুষকে তার পুরনো আত্মীয়তায় পৌঁছে দিতে পারল না। মাথার উপর শামিয়ানা টাঙানো হল না; অনেকসময় পুরনো সংস্থানগুলো রয়ে গেল ঠিকই; বহিরঙ্গে আগের মতোই; কিন্তু ভিতর ভিতর সে বদলে গেল আমূল। ফলে, মানুষ হারিয়ে ফেলল তার নিরাপত্তা, আত্মিকতা, আধ্যাত্মিকতাও; এবং ঘন হয়ে তার বুকে জমাট বাঁধল প্রগাঢ় নিঃসঙ্গতা। ক্রমাগত আত্মিক অবনতির মুখে পড়তে থাকল মানুষ। তার কারণ আছে অনেকানেক। বুবের বলছেন, শুধু প্রযুক্তির কথাই যদি ধরা যায়, দেখা যাবে, যে-প্রযুক্তি মানুষকে সাহায্য করবে বলে জন্ম নিল, একদিন সেই প্রায় তার প্রভু হয়ে বসল প্রায়। মানুষকে পেড়ে ফেলল; আজকের সোশ্যালমিডিয়া যখন বিদ্বেষচাষের ভিত্তিভূমি হয়ে মানবসভ্যতাকে এমনকি দাঙ্গার মতো কুৎসিত ধ্বংস-উন্মাদনার দিকে ঠেলে দেয়, তখন আমরা এ-কথার সত্যতা অক্ষরে অক্ষরে বুঝতে পারি। ক্রমে দেখা গেল, জনসংখ্যা বৃদ্ধি আর সেই সঙ্গে উৎপাদন আর বণ্টনের অসাম্য এমন বাড়তে থাকল যে, একদিন তা-ও মানুষের নিয়ন্ত্রণের অতীত হল। রাজনৈতিকভাবেও দেখে গেল, (প্রথম)বিশ্বযুদ্ধের মতো ঘটনা মানুকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, ক্ষমতার কাছে সে কী তীব্রভাবে অসহায়। দর্শনগত দিক থেকেও এই ধরনের মানুষ, অর্থাৎ তথাকথিত আধুনিক মানুষ আশ্রয়হীনতায় ভোগে। ফলে একদিন সে স্পষ্ট বুঝতে পারে- ‘Man faced the terrible fact that he was the father of demons whose master he could not become.’

ঠিক এইখানে পৌঁছে, আমরা সমসময়ের দিকে তাকিয়ে মিলিয়ে নিতে পারি যে, দার্শনিক বুবের কতখানি অভ্রান্ত ছিলেন তাঁর নির্ণয়ে। মানুষের ধারণা থেকে মানুষ নিজেই যে অনেকাংশে হারিয়ে গিয়েছে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। নইলে গোটা বিশ্বজুড়ে যখন মৃত্যুমিছিল, তখন কীসের ভালোলাগায় কেউ একজন ফুলঝুরি, তারাবাতি জ্বালান? মানুষের কাছে তো এখনও উল্লাসের প্রেক্ষা বদলে যায়নি। তাহলে? যে কারণে মানুষ উল্লসিত হন, আর যে কারণে শোকাতুর হন – সেগুলোর ধারণা বিপ্রতীপ হয়ে ওঠেনি। ফলে এই মানুষ যে উল্লাস করছেন, তা ঠিক বলা যায় না। কিন্তু এ-কথা নিশ্চিত করেই বলা যায় যে, তিনি শোকাতুর নন; যদিও শোকের জন্ম হওয়া স্বাভাবিক ছিল এই সময়। খেয়াল করলে দেখব, এই মানুষেরও কোনও পাড়া নেই, আত্মিক যোগাযোগ নেই; তার আর সেই মৃত্যুমুখে পতিত বৃদ্ধ-বৃদ্ধার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে ইচ্ছে করে না। চোখ ছলছল করে না; কারণ, বহুদিন আগেই সে আকাশটাকে খণ্ডিত করে ফেলেছে। যেখানে সূর্য শুধু মাঝখানে ওঠে। এমনকি, তার সামনে কোনও রাজনৈতিক আদর্শও নেই তেমন; ব্যক্তিলোপের কথা হয়তো তাকে বলেছিল যে ভাবধারা, তারই পুষ্টি নিয়ে সংসদীয় কাঠামোর ভিতর ঢুকে যখন সেই আদর্শের রাজনৈতিক অভিব্যক্তি মানুষকে যথাযথ গুরুত্ব দিতে অসমর্থ হল, তখন সেই ব্যক্তিমানুষের সামনে সমষ্টি এবং সমষ্টির চিন্তা একটা প্রগাঢ় ঠাট্টা হয়ে দেখা গেল; গোটা বিশ্বে উলটোদিক থেকে দক্ষিণপন্থী উত্থান এখন সেই ব্যক্তিমানুষের কাছে চেয়ে বসেছে প্রশ্নহীন আনুগত্য। যে তাই তারাবাতি জ্বালায়, চকোলেট বোম ফাটায় সে যে মানুষের মৃত্যুতে খুব আনন্দ করে ফাটায় তা নয়; সে ফাটায় কারণ, এক অচেনা ক্ষমতাকে সে তার আনুগত্য জানায়; তাতে তার কী লাভ হবে?এ-প্রশ্ন করতেও সে ভুলে গেছে; কারণ সে জানে এই ক্ষমতা চাইলে জনপদের পর জনপদ ধ্বংস করে দিতে পারে স্রেফ একটা বোম ফেলে। কোনও মানবিক চিন্তাই মানুষকে এই ক্ষমতার বিধ্বংসী থাবা থেকে রক্ষা করতে পারে না তখন। ব্যক্তির হাতে এমন কিছু নেই, যা এই আগ্রাসনকে প্রতিহত করতে পারে। ফলত সে একা, এবং চূড়ান্ত একা- বলা ভালো তীব্র নিঃসঙ্গতার মধ্যে ঢুকে পড়ে। এই বিচ্ছিন্নতা, সামাজিক বিচ্ছিন্নতার বহুতর অনুশীলন যখন সারা, তখন একটা অতিমারীর মুখে পড়ে আমরা দেখলাম, এক চূড়ান্ত বিভ্রান্ত মানবসভ্যতা উন্মাদের মতো হেঁটে যাচ্ছে; সে সর্বার্থেই পরিযায়ী; তাকে নিয়ে আলোচনা করছে সবাই; কিন্তু তার মুখে কেউ কিছু তুলে দিচ্ছে না। কেউ তার পাশে দাঁড়াচ্ছে না। বরং তৃতীয়বার বিশ্বযুদ্ধ যে লেগে গিয়েছে, এই ব্যাপারটিতেই সে নিশ্চিত হতে চাইছে। দুটি যুদ্ধের ইতিহাস নিয়েও কেউ সে যুদ্ধ রোখার চেষ্টা করছে না। এত প্রগতি, এত উন্নয়নের ধারণা কিছুই আজ তাকে আদিম স্বার্থপর হওয়া থেকে রক্ষা করছে না। অদ্ভুত বুনো নৃশংশতা। এর শিকার মানুষ আজ নিজেই।

চিন্তকরা বলছেন, এই অতিমারী পেরিয়ে, এই নৃশংশতার ছায়া পেরিয়ে সভ্যতা যদি বেঁচে যায়, তবে সে আর আগের মতো থাকবে না। কীভাবে বদলে যাবে? তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারেন না। পারা সম্ভবও নয়; তবে, অনেকের ভাবনা যে, বাজার-সন্ত্রাস থেকে মানুষ এবার মুখ ফেরাবে। বাজারের সামনে নিজেকে আর মেলে ধরবে না। অর্থাৎ, মৃত্যু মাথায় নিয়েও পাণ্ডুর ভোগ ও সম্ভোগের মুদ্রাদোষ থেকে সে হয়তো কিছুটা পিছুয়ে আসবে; কারণ, সে দেখেছে, এই বস্তুগত পৃথিবী তাকে একটা ভাইরাসের হাত থেকেও বাঁচাতে পারেনি। যদি এই মোহত্যাগ সম্ভব হয় তাহলে পুঁজির তথাকথিত উদারতার ছদ্মবেশে দস্যুবৃত্তির প্রবণতাও কমতে বাধ্য। সেক্ষেত্রে সভ্যতার উৎপাদন ও বন্টন ব্যবস্থায় একটা পুনর্বিন্যাস হলেও হতে পারে। আর, সবথেকে বড়ো কথা, এই একটা আঘাত মানুষকে যেভাবে ধনে-প্রাণে দেউলিয়া করে দিল, এখান থেকেই সে বাইরের দিকের চলা কমিয়ে ভিতরপানে মুখ ফেরাবে। হয়তো আসবে কোনও দার্শনিক প্রজ্ঞা; আশ্রয়; যা আগামী দশকে মানুষকে মানবের অভিমুখী করে তুলবে।

কিন্তু এ-সবই কল্পনা। উমার প্রেমের গল্প। সেখানে পৌঁছতে গেলে সতীর শীতল শব কোলে বহুদিন বসে থাকা ছাড়া আমাদের গত্যন্তর নেই।

চৈতালী চট্টোপাধ্যায়-এর কবিতা




দেয়াল


ঘাসফুল দেখতে পেতাম।
তোমার ভোরের রান্নাঘরও।
টের পেতাম চায়ের চামচের শব্দ।
টাঙানো ছবিগুলোর রং।
যে বইটা পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে গেছ কাল,আজ দেখতে পেতাম।
প্রচুর গল্প শুয়ে থাকতো আনোয়ার শাহ্ রোড জুড়ে।
অনেক খিলখিল আর ফুলে-ওঠা হাসি দুশোচল্লিশ নম্বর বাসের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে যেত।
টিকিটের মতো উড়ে বেড়াতো হালকা দিনগুলো
চপকাটলেটের গন্ধ নিয়ে।
আমরা দুজনে দুজনকে লিখতে বসতাম তখন!

এখন চোখের সামনে কিছু নেই।
ভয় আছে।

যতন মণ্ডলের জীবন: সন্মাত্রানন্দ





হেমন্তের পাতাঝরা অপরাহ্ণ পেরিয়ে সন্ধ্যার কাঁসাই নদীর কূলে আমার সঙ্গে আবার দেখা হল যতন মণ্ডলের। এর আগে সেই দেখা হয়েছিল হৃষিকেশের এক আশ্রমে। তখন যতনদা বড়ো বড়ো চুলদাড়ি রেখেছিল। গৈরিক কাষায় পরনে। আর এখন চুলদাড়ি ছোটো, একটা সাদা পাজামা আর একটা খদ্দরের পাঞ্জাবি পরা। নদীর দিকে মুখ করে বসে অন্যমনস্ক হয়ে কী যেন ভাবছিল আকাশপাতাল যতনদা। আমাকে অতর্কিতে দেখে চমকে উঠল। তারপর  চিনতে পারল। হাসল। হাসিটা একই আছে। বলল, ‘কী ব্যাপার রে? তুই এখানে?’ 
কিন্তু হৃষিকেশের আশ্রমেই তো আর যতনদার সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ না। আমার জীবনের একটা গোটা পর্বের সঙ্গেই তো যতনদা জড়িয়ে আছে। আমি আর যতনদা সন্তোষপুরে একই মেসে থাকতাম। আমরা দুজনেই তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি। যতনদার ম্যাথামেটিক্স আর আমার স্ট্যাটিস্টিক্স। সায়েন্স কলেজের সময়টুকু বাদ দিয়ে বাকিটা সময় দুজনেই টিউশন করে মেসের আর পড়ার খরচ চালাতাম। একই সঙ্গে ট্রেন ধরা, সন্ধেবেলায় মেসের বাজার করা, খাওয়াদাওয়া, আড্ডা, তাস-পেটানো—সবই প্রায় একসঙ্গে। 
গড়পড়তা জীবনের মধ্যে বেঁচে থাকতে থাকতে তবু কখনও কখনও আমার মনে হত, যতনদার ভেতরে একটা অন্যরকমের মানুষ আছে। কথা বলতে বলতে আনমনা হয়ে পড়ত। কিছুক্ষণ পর বোধহয় বুঝতে পারত, অনেক দূরে কোথাও সে চলে গিয়েছিল মনে মনে। চলমান কথার স্রোতে ফিরে আসত লজ্জিত, অপ্রতিভ মুখে। বাজারে হাটে রাস্তায় ট্রেনে যেকোনো শ্রেণির মানুষের সঙ্গে মিশেও যেতে পারত অদ্ভুতভাবে। কী একটা অতল বিষণ্ণতা লেগে থাকত তার চোখে। কখনও কখনও মনে হত, সে শুধু চেয়ে আছে; কিন্তু দেখছে না।     
কোনো কোনো দিন সন্ধ্যা পেরিয়ে সুকান্ত সেতুর উপর দিয়ে বাসে করে আসতে আসতে জানালায় মুখ রেখে হঠাৎ-ই আবিষ্কার করেছি, ব্রিজের একধারে বড়ো আলোর নীচে জমে থাকা বিষণ্ণ হলুদ অন্ধকারের ভিতর যতনদা রেলিঙে ভর দিয়ে একা দাঁড়িয়ে আছে। তার চুলের ভিতর খেলা করছে দক্ষিণ কলকাতার বিষাদময় রাতের বাতাস। অনেক দূরে টিভি টাওয়ারের লাল আলো আর যাদবপুর স্টেশন থেকে ছেড়ে যাওয়া লোকাল ট্রেনের বিলীয়মান শব্দ...
সেই যতনদার সঙ্গে সন্তোষপুরের পর দেখা হল একেবারে হৃষিকেশে। আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘যতনদা! তুমি এখানে?’
—কেন? তুই বিবাগী হয়ে যেতে পারিস, আর আমি পারি না?
আমি বললাম, ‘না, না, তা কেন? কিন্তু...’
—তুই মেস ছেড়ে চলে গেলি কাউকে কিচ্ছু না বলে। খোঁজখবর লাগালাম। কিছুদিন পর জানলাম, ঘর ছেড়ে বিবাগী হয়ে গেছিস। লাপাত্তা। আমারও কয়েক বছর আরও কাটল সন্তোষপুরে। ডাব্লুবিসিএস-এ পেলাম। পরীক্ষার রেজাল্টফেজাল্ট বেরোলো। বাড়ি গেলাম। সবার খুব উল্লাস। সেই উল্লাসের মধ্যে কেন জানি হঠাৎ তোর কথা মনে পড়ল। কোথায় আছিস, কী খাচ্ছিস, কেন গেলি...এইসব। তারপর কী যে হল, মনে হল, আমিও চলে যাই। কী হবে চাকরিবাকরি করে? দেখি না, কী আছে জীবনে। একটাই তো জীবন। অন্যরকম করে বেঁচে দেখি না কেমন লাগে, কী পাই। সেই থেকেই... তুই কোথায় এখন? 
—আমি মঠে আছি। এসেছিলাম এমনিই এদিকে। তুমি দেখছি, গেরুয়া পরে আছ। সন্ন্যাস নিলে কবে? কোথা থেকে?
—বছর দুই হল। কৈলাস আশ্রম থেকে। মঠমড়িতে পোষায় না...অত নিয়মকানুন... তার থেকে এই ভালো। একা একা নিজের মতো ঘুরে বেড়াই। এই আশ্রমে আছি দিন পনেরো হল। এবার চলে যাব। বদরিকাশ্রম যাওয়ার ইচ্ছে আছে। দেখি কী হয়... রাহাখরচ যদি মেলে...যাবি নাকি তুই আমার সাথে? চল, একসঙ্গে ঘুরে আসি।
—না গো, আমি ভাবছি, নামব। বৃন্দাবন যাব। 
—আরে উঠলি কোথায় যে নামবি? এই তো সবে হৃষিকেশ! হা হা হা!
—ভালো বলেছ। আমার ওঠা আর নামা! শালগ্রাম চিত করে বসালেও সোজা, কাত করে শোয়ালেও সোজা। যাই, বৃন্দাবন থেকে ঘুরে আসি। বদরিকাশ্রম না হয় পরে হবে। বৃন্দাবন থেকে আগ্রা যাব। 
—হ্যাঁ, আগ্রা গিয়ে একটা নাগরা কিনবি। তারপর হবে পায়ে ফোস্কা। বৃন্দাবন কী গরম এখন জানিস? আর যা বাঁদরের উৎপাত। সাবধান না হলে বাঁদরে তোর চশমা কেড়ে নেবে।
এইসব হাবিজাবি কথা খানিক হয়েছিল। বিকেলে চলে এসেছিলাম। ভিতরের কথা কিছুই হল না। দুয়েকবার সেইদিকে কথার সলতে উস্কে দিয়েও বিশেষ লাভ হয়নি। কেন সে ঘর ছাড়ল, ছেড়ে কী পেল, কী খুঁজছে—এসব জানা হল না কিছুই। এমনিতেই সাধুরা ভিতরের কথা ভিতরেই রাখতে ভালোবাসে। আর যতনদার তো আছে সেই অন্যমনস্ক হয়ে যাওয়ার রোগ।   
ভাবলাম, আমারই বা কী দরকার? আমি নিজে কী পেলাম, কী খুঁজছি—তা কি বোঝাতে পারব সহজ লোকের ভাষায়? কিছুই হয়ত নয়, আবার হয়ত অনেক কিছুই। নিজেই যখন বলতে পারি না বুঝিয়ে, তখন যতনদাই বা কী বলবে? বললেও সে হবে উপরের কথা, ভিতরের কথা তো নয়! দুধ যদি এতদিনে খেয়েও থাকে বোবা, কেমন করে বোঝাবে সে দুধের স্বাদ? আর যদি বোবা না-ও হয়, তবুও কি বোঝানো যাবে ভাষা দিয়ে দুধ খেতে কেমন? যদি বা বোঝানোও যেত, তাহলেও যাকে বলবে, সে হচ্ছে কালা। বক্তা বোবা, শ্রোতা কালা, জমেছে বেশ দরদের জ্বালা! দরদী কই? দরদী কেউ নেই! 
সেই যতনদা! আজ এতবছর পর কাঁসাই নদীর ধারে। পাজামা-পাঞ্জাবি পরা, মাথার চুল উসকোখুসকো। বড়ো বড়ো ফিকে রঙের ঘাসবনের ভিতর উদাস হয়ে বসে আছে। আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, ‘বোস। দাঁড়িয়ে রইলি কেন?’
—তুমি ফিরে এলে?
—না।
—ফেরোনি?
—না।
—তাহলে এমন যে?
—এমনই। ওদিকটা দেখলাম, আবার এদিকটা দেখছি।
—বাড়িতে আছ? 
—না রে! এখানে এক বন্ধুর বাড়ি। চলে যাব পরশু। গাইঘাটা যাব। যাত্রা আছে। অনেকদিন যাত্রা দেখিনি।
—কোথায় কেদারবদ্রী করে ঘুরে বেড়িয়েছ, এখন গাইঘাটার যাত্রা? পোষাবে? 
—কেন নয়? কেদার যেমন সত্যি, গাইঘাটাও তেমনই সত্যি। গাইঘাটার যাত্রা যে অর্থে মিথ্যা, কেদারও সেই অর্থে মিথ্যা। নয় কি?   
মাথা নীচু করে ভাবছিলাম। কাঁসাইয়ের চরের উপর খয়েরি ডানার কী পাখি থুপথুপ থুপথুপ করে লাফাচ্ছিল। নদীর বুক থেকে বালির চর মাথা উঁচু করে রেখেছিল। সন্ধ্যার অন্ধকার মিশে যাচ্ছিল নদীর জলে। কতোদিন আগের সেই যতনদা। যতন মণ্ডল। সন্তোষপুরের সেই মেস। তারপর হৃষিকেশে দেখা। তারপর এই কাঁসাইয়ের ধারে। জীবনটাই একটা গল্প-ভাঙার গল্প। গল্প হয়ত নয়। হয়ত একটা উপন্যাস। গণনাতীত অধ্যায়। একই সঙ্গে রয়েছে। একটা অধ্যায়ে যতন মণ্ডল সুকান্ত সেতুর উপর উদাসীন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আরেকটা অধ্যায়ে গেরুয়া জোব্বা পরে বসে আছে হৃষিকেশের আশ্রমে। আরেকটায় সাদা কাপড়ে কাঁসাইয়ের চরে বসে অন্যমনস্ক হয়ে তাকিয়ে আছে জলের দিকে। 
নীরবতা ভেঙে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তবে কি তুমি ঘরেও নেই, পারেও নেই?’
—নাহ্‌। কোথাও নেই তো!
—তাহলে তো খুব কষ্ট গো!
—হ্যাঁ রে, কষ্ট। খুব কষ্ট। আবার খুব আনন্দও। কোথাও বাঁধা না-পড়ার আনন্দ।
—বাঁধা পড়ারও তো একপ্রকার সুখ আছে, যতনদা। আছে না?
—আছে। তবে সেটা চলে যায়।
—আচ্ছা, কোনোভাবে ধরে রাখা যায় না?   
—যায় বোধহয়। যে বাঁধা পড়েছে আর  যে বেঁধেছে, যদি তারা দুজনেই একথা জানে যে, এই বাঁধন একটা ছল— যেকোনো মুহূর্তেই এ বাঁধন ছেড়ে তারা চলে যেতে পারে, তাহলেই একমাত্র ধরে রাখা যায় বোধহয়।
— ‘বোধহয়’ বলছ কেন? এমন কাউকে পাওনি?
—কই আর পেলাম? তুই কি পেলি? কী পেলি? 
সহসা কাঁসাইয়ের রেলব্রিজের উপর দিয়ে ঝমঝম ঝমঝম ধাতব শব্দ তুলে সন্ধ্যার লোকাল ট্রেন এসে পড়ল। তার প্রচণ্ড আওয়াজের ভিতর, সন্ধ্যার অন্ধকারের ভিতর আমাদের কথা—যতনদা আর আমার প্রশ্ন, আমার আর যতনদার উত্তর, আমি আর যতনদা ক্রমশ একাকার হয়ে ডুবে যেতে লাগলাম।     

 
 

 

একনজরে

সম্পাদকীয়

একটি বিষয়ে আমাদের সকলের একমত হতেই হবে ভিন্ন মতের ও ভিন্ন রুচির বহুস্তরকে সম্মান জানিয়েও, যে, আমরা এই মুহূর্তে প্রায়শ্চিত্ত করছি। মানুষ...

বেশিবার পড়া হয়েছে যেগুলি