Monday, April 13, 2020

সুতপা বসু-র গল্প




জানাজা

“আশ্লিষ্য বা পাদরতাং পিনষ্টু মা-
মদর্শনাম্মর্মহতাং করোতু বা।
যথা তথা বা বিদধাতু লম্পটো
মৎপ্রাণনাথস্তু স এব নাপরঃ ।।“
“তোমার আবার এইসব কঠিন কঠিন কথা, আমি কিছুই বুঝে পাইনা ছাই।“ আফিফা কোলের ওপর রেকাব ভরা সজনেফুল বাছছিল। তার থেকে খান দুই কপট রাগে ছুঁড়ে দিল চারুবেদের দিকে। সেই ফুলদুটি চারুবেদের চন্দনচর্চিত গৌরাঙ্গ ছুঁয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। চারুবেদ আত্মপক্ষ সমর্থনে বললো, “অভিমানীনি, তোমার মনের কথাই তো বললাম...“
“কি আমার মনের কথা? ভারী বোঝো তুমি...”
"বুঝি বৈকি, শ্রীকৃষ্ণ সম্পর্কে রাধিকে বলছেন,
'আলিঙ্গনে রাখুন, নিষ্পেষিত
পদতলে করুন, দুঃখ দিন
অদর্শনে, লম্পটের মতো
ঘুরে বেড়ান, তবু প্রিয়, তিনি আমার প্রিয়।'
এবার বলো দেখি বুঝি কিনা। এ তো আমার সম্পর্কে তোমারও মনের কথা। কতবার নানা ছলে আমায় এ কথা বলেছো।"
আফিফার মুখ লাজে আনত। ঠোঁটের কোণে মৃদু লাজুক হাসি।
চারুবেদ আফিফার চিবুক ধরে তার আনত মুখমন্ডল নিজের দিকে ফেরালো। এক নিবিড় দৃষ্টি নিয়ে তাকালো আফিফার চোখের দিকে। আফিফা একবার নয়ন মেলে সে দৃষ্টি দেখে ব্রীড়াবনত হয়ে চোখ বুজলো। চারুবেদ আরও ঘণিষ্ঠ হলে পর এক বিশ্বাসঘাতক ফাল্গুনী বাতাসে কপাটের একখানি পাল্লা বিষম শব্দ তুলে বন্ধ হলো। আজ সকাল থেকেই কেমন ঝোড়ো হাওয়া বইছে। কপাট পতনের শব্দের আকস্মিকতায় অসাবধানবশতঃ আফিফার কোল থেকে রেখাব ছিটকে পড়লো উঠোনে। ঝরা পলাশে ছেয়ে থাকা উঠোনে মুক্তোর দানার মতো ছড়িয়ে গেল সজনে ফুল।
“দেখো, সব পড়ে গেল। এবার কি রাঁধি আমি......”
চারুবেদ অপ্রস্তুত অপরাধীর মতো ফুল কুড়োতে উদ্যত হলো।
“করো কি করো কি... রাখো ওসব। ও ফুলে আর কাজ নেই।“
“তবে কি করি! বড় খারাপ হলো। তোমার এতখানি পরিশ্রম, এ হে... কয়েকখান শাপলা তুলে এনে দিই?”
“তুমি থামো দিকিনি, হুঃ ভারী তো পরিশ্রম। সে আমি অন্য কোনও জোগাড় দেখবখন। তা তুমি যে বড় সকালখানা এখানে বসে কাটালে, তোমার মাধুকরীর কি হবে?”
“আজ তার দরকার নেই। আখড়ায় ফিরব না। সন্ধ্যে নাগাদ যাব বড়গোঁসাইজির আখড়ায়। তার সাথে আমার দেখা করা প্রয়োজন। এখন সেদিকপানেই রওনা দেবো।"
আফিফা চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো, "এখানকার সব খবর কি উনি জানেন?"
"সম্ভবত এতদিনে অনেকটাই জেনেছেন। দেখি গিয়ে। তাছাড়া, আমি বুঝতে পারছি আফিফা, এ আখড়ায় আমার আর বেশীদিন থাকা হবেনা। দেখি বড়গোঁসাইজি যদি কোনো ব্যবস্থা করেন।“
আফিফা উদবিগ্ন কন্ঠে বললো, “সে ব্যবস্থা হলে তো হবে সেই নদীর ওপারে। তুমি চলে যাবে এখান থেকে?"
“অতদুর যাবার ইচ্ছে আমার নেই। যদি এদিককার অন্য কোনও আখড়ায় ব্যবস্থা হয়... দেখি কি করা যায়।"
"মনের কথা যদি বাদও দিই, তুমি এ গাঁয়ে আছো, সেই ভরসাতেই তো চারপাশের এত দাঁত, নখ বাঁচিয়ে টিকে আছি।"
"যদি কখনো সত্যি সত্যি তোমার ওপর তেমন কোনো বড় বিপদ আসে, কিই বা করতে পারবো, কতটুকুই বা করতে পারবো আমি? সবার আড়ালে এ সম্পর্ক রাখতে হয়। তাই, সেসব ভেবে শঙ্কিত হই।"
আফিফা চুপ করে উঠোনের দিকে চেয়ে বসে থাকে। চারুবেদের কথায় হয়তো খানিক অবাক হয়, হয়তো বা হয়না। সমাজের গন্ডি পেরিয়ে ওদের দুজনের এক হওয়া কল্পনাতীত। এ আর অজানা কি।
চারুবেদ রওনা দেবে বলে উঠে পড়ে।
"এবার আমি উঠি। তুমি ঘরকন্নার কাজ সারো।“
“খানিক রোসো। আমি এখুনি আসছি।” আফিফা ব্যস্ত হয়ে কুটিরমধ্যে প্রবেশ করলো।
নিমেষেই প্রস্তর পাত্রে দুধ, পাক দেওয়া ছানা, ফল, খই নিয়ে এসে দাওয়ায় সে সব রেখে, আসন পেতে দিয়ে চারুবেদকে ডাকলো, “এই সামান্যকিছু মুখে দিয়ে নাও। এতটা পথ যাবে।“
চারুবেদ বেড়ার ওপারের তালসারি ঘেরা পুকুরের দিকে চেয়ে একমনে কি যেন ভাবছিল। চমক ভেঙে এসব আয়োজন দেখে ব্যস্ত হয়ে বললো, "করেছো কি? এই এতসব খাওয়ার সময় নেই। সঙ্গে ফলমূল রয়েছে। পথে যেতে যেতে ওই দিয়েই দিব্যি হয়ে যাবে।“
“না হবে না। যা বলছি, তাই শোনো। চট করে খেয়ে নাও। আমি উঠোনের দোর আগলাচ্ছি।“
“এই ভয়টাই যে বড় অপমানের আফিফা। কবে যে এসব থেকে মুক্তি পাবো।“ দীর্ঘশ্বাস ফেললো চারুবেদ।
আফিফা চারুবেদের পিঠে হাত রাখলো।
"এ হিঁদুর ভিটে আর আমি হিঁদুর মেয়ে হলেই কি আর কোনো ভয় থাকতো না? ক্ষণিকে হিঁদুকে মুসলমান আর মুসলমানকে হিঁদু হতে দেখেছি। আল্লাহ তো শুধু মানুষ করেই ক্ষান্ত দেন। বাকিটাতো আমাদের হাতে। লোক, সমাজ তাইই দেখে যা আমরা দেখাই, হিঁদুকে হিঁদু, মুসলমানকে মুসলমান। আর তাই নিয়েই তাদের কত বিদ্যের জাহির, কত নিয়ম, কত পরোয়ানা। হুঃ.."
কথাগুলো বলতে বলতে আফিফা ঘড়ায় করে হাত মুখ ধোওয়ার জল, আর গামছা এগিয়ে দিল চারুবেদকে।
মাঝে মাঝে বিস্মিত হয়ে আফিফার কথা শোনে চারুবেদ। যেমন এখন শুনছিল। নিরক্ষর গ্রাম্য এক মেয়ের কাছ থেকে মাঝে মাঝেই এমন সব কঠিন দর্শনের কথা শোনা বড় সাধারণ ব্যপার নয়। সেই তো কোন কাল থেকে মহাপ্রভু ও আরও কত সাধু সন্ত পীর পয়গম্বর এসব বুঝিয়ে আসছেন। তবু অধিকাংশ মানুষ তা বোঝে কই? বুঝলেও জীবনযাপনে তার প্রকাশ কই? চারুবেদ খাওয়া দাওয়া সেরে, আফিফাকে আলিঙ্গনপূর্বক আদর করে রওনা দিল।


চারুবেদের অপসৃয়মান পথের দিকে চেয়ে রইলো আফিফা। কোন বালিকাবেলায় নিকাহ হয়েছিল তার আর একটি বালকের সাথে। বাপ ছিল না আফিফার। জাতি দাঙ্গায় মা আর বড় দিদি দুজনেই মারা পড়লো। দিদি তবু মরে বেঁচেছিল। আফিফার ইজ্জত নিয়ে বাঁচার একটাই উপায় ছিল। কারো বিবি বনে যাওয়া। আবছা মনে পড়ে গাঁয়ের প্রতিবেশী ও মাজারের পীরসাহেব মিলে এক এতিম বালকের সঙ্গে ওর বিয়ে দিয়েছিল। সে বালকের মুখ মনেও পড়েনা ভালো করে। সবে মা ও দিদির মৃত্যু ঘটেছে। পৃথিবীতে আফিফা একা। ভয়, ভাবনা তখন ওর মন জুড়ে। অথচ, বয়সও তেমন নয় যে বিশেষ কিছু ভেবে উঠতে পারবে। নিকাহ শেষ হওয়ার দেরীটুকুও মঞ্জুর ছিলনা আল্লাহর। দাঙ্গাবাজের দল গ্রাম আক্রমণ করলো। যে যার প্রাণ নিয়ে পালালো।
কেমন করে জানি পালাতে পালাতে আফিফা চলে এসেছিল এই গাঁয়ে। সেই হুড়োহুড়িতে এতিম বালকটিও কোথায় পালিয়ে যায়। হারিয়ে যায়। যে হতে পারতো আফিফার স্বামী। বা হয়তো সত্যিই সে ওর স্বামী। বিয়ের আচার কি হয়েছিল, কতখানি হয়েছিল, কিছুই তো মনে নেই আফিফার। সেই থেকে এর ওর তার বাড়িতে থেকে, ফাইফরমাশ খেটে, দিনমজুরি করে এই রূপপুর গাঁয়েই ক্রমে বেড়ে উঠলো আফিফা। এই সবে উনিশ বৎসরে পা দিয়েছে সে। গাঁয়ের মোড়লের বাল্যবিধবা পিসিমা বড় ভালোবাসত আসিফাকে। সেইই তার নিজের সম্পত্তির অংশ থেকে গ্রামের একেবারে নির্জন প্রান্তে একটি পুকুরপাড়ে দুখানি ঘরের একটি মাটির বাড়ি দিয়ে যায় আফিফাকে। এখন এইই তার বসতভিটে, সম্পত্তি, আশ্রয়। শাস্ত্রে বাধা নেই, অনেকেই বলেছে, তবু আফিফা পুনর্বার নিকাহ করতে রাজী হয়নি কখনো। ওর মন জুড়ে আছে চারুবেদ। নাহয় এ জন্মে তার সাথে সংসার করা হলো না। কিন্তু, এই যে মাঝে মাঝে সে সকলের চোখ এড়িয়ে আসে। ওরা দুজনে কিছুক্ষণের ত্বরেও যেন এই পর্ণাচ্ছাদিত মৃৎ কুটিরে স্বামী, স্ত্রীর মতো সংসার সংসার খেলে, এইই বা কম কি?
এসব ভাবনায় কতক্ষণ অতিবাহিত হয়েছে, আফিফার খেয়াল নেই। বেলা হয়ে আসছে। ঘরকন্নার কাজ সব পড়ে রয়েছে। সম্বিৎ হতেই সে কুটিরে প্রবেশ করে কিছু কাপড় চোপড় নিয়ে পুকুর পাড়ের দিকে রওনা হলো। এদিকটা একেবারে নির্জন। এটাই গ্রামের সীমানা আর পুকুরটা শেষ হলেই বিশাল ধূ ধূ মাঠ। আফিফার বাসা ছাড়া আশেপাশে আর কোনো কুটির নেই। এই পুকুরেও তাই বিশেষ কেউ আসেনা। আফিফা পুকুর পাড়ে উবু হয়ে কাপড় কাচতে বসলো। হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন তার মুখ চেপে ধরলো। কেউ একজন চোখ বেঁধে দিল। সাথে সাথেই মুখের ওপরেও পড়লো কাপড়ের বাঁধন। তার হাত বেঁধে তাকে পাঁজাকোলা করে তুলে বসিয়ে দেওয়া হলো একটি পালকিতে। বেহারার দল পালকি নিয়ে দৌড় দিল মাঠের দিকে।


অন্যদিকে তখন প্রায় সাত ক্রোশ আলপথ পেরিয়ে বড় গাঙ পেরিয়ে, কেজুলির বন পেরিয়ে এক দীর্ঘকায় উজ্জ্বলবর্ণের পুরুষ হেঁটে চলেছে নদীর ধার দিয়ে পীরহাটের গ্রাম্য পথ বেয়ে। তার মুন্ডিত মস্তক। তার দেহ, চোখ, নাক, মুখ বড় যত্নে গড়েছেন বিধাতা। সেই সুদর্শন পুরুষের গলায় তুলসীর মালা, পরণে শ্বেতশুভ্র ধুতি ও চাদর। তার সুঠাম নির্মেদ দেহ জড়িয়ে আছে স্বেত উপবীত। জ্যোৎস্না গায়ে মেখে তিনি যেন কোনও মানুষ নন, যেন এক স্বর্গ থেকে বহিষ্কৃত শাপভ্রষ্ট কিন্নর। সেই সুদর্শন, চারুবেদ, নদীর পাড় আলো করে হেঁটে চলেছে বড়গোঁসাইজির আখড়ার দিকে৷ তার মাথার ওপর তারকাখচিত আকাশ। মাঝে মাঝে মেঘের ধীরগতিতে ভেসে যাওয়া দেখতে দেখতে চারুবেদ ভাবে, হয়তো এমনই নভতলে যক্ষগণ তাদের কুসুমালংকৃতা সুন্দরী স্ত্রীদের সাথে রতিফলনামক মদ্য পান করেছিলেন। চারুবেদ মৃদুকন্ঠে সুর করে বলতে বলতে চলেছে,
'যস্যাং যক্ষাঃ সিতমণিময়ান্যেত্য হর্ম্যস্থলানি
জ্যোতিশ্চায়াকুসুমরচিতান্যুত্তমস্ত্রীসহায়াঃ।
আসেবন্তে মধু রতিফলং কল্পবৃক্ষপ্রসূতং
ত্বদগম্ভীরধ্বনিষু শনকৈঃ পুষ্করেষ্বাহতেষু।'
নদীর পাড় জুড়ে বিস্তৃত অন্ধকারের মাঝে দূরে দেখা যাচ্ছে পীরহাট আখড়ার আলো। একটু এগিয়ে, সোজা পথ ছেড়ে চারুবেদ ডানদিকে বাঁক নিল। ক্রমে নদীর চর পেরিয়ে গ্রামের বসতির মধ্যে প্রবেশ করলো সে।


পালকিতে কিছুটা পথ এসে তিন দুর্বৃত্ত আফিফাকে নিয়ে নৌকোয় করে পীরহাটে এসে পৌঁছেছে অনেকক্ষণ। পীরহাটে নদীর পাড়ে নোঙর করতে হয়েছে তাদের। এখানেই তাদের কার্যের পারিশ্রমিক মিলবে। সেসব নিয়ে, খানিক বিশ্রাম করে, তারা রওনা দেবে রম্ভার পথে। আত্মরক্ষার উপর্যুপরি চেষ্টায় ব্যর্থ ও ক্লান্ত হয়ে আফিফা ঝিমিয়ে পড়েছে। তাকে সুরার মতো কি এক পানীয় খাওয়ানো হয়েছে। সে প্রায় নিস্তেজ হয়ে নৌকোর ছইয়ের ভেতর পড়ে রয়েছে। তার মুখ বাঁধা, পা বাঁধা, দুই হাত পিছমোড়া করে বাঁধা। দু জন দুর্বৃত্ত তাকে পাহারা দিচ্ছে। তৃতীয়টি কোনো কাজে গেছে।
সেই ফাগুন সন্ধ্যায় বসন্তের ফুরফুরে হাওয়ায় চারুবেদ ঘন বসতির দিক এড়িয়ে একটি কুটিরের সামনে উপস্থিত হলো। একটু আগেই এই কুটির থেকে বেরিয়ে গেছে আর একটি পুরুষ। বেরিয়ে সে নদীর দিকে গেছে। সেখানে নৌকো বাঁধা আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই নৌকো রওনা দেবে কলিঙ্গয়, রম্ভার দিকে। কুটিরের দরজায় মৃদু আঘাত করলো চারুবেদ। বার দুই আঘাতের পর দরজা খুলে গেলো। এক পুষ্পালংকারে সজ্জিতা যুবতী রমণী দরজা খুললো। চারুবেদকে দেখে একাধারে অপ্রস্তুত ও আনন্দিতা হয়ে তাকে গৃহমধ্যে আমন্ত্রণ করলো। ত্বরায় গৃহের কপাট বন্ধ করলো।
রমণী কৌতুক করে বললো, "তাই বলি আজ এমন মধুর বাতাস বইছে কেন? এ তো সেই পোড়া বাঁশির টান। এতকালেও সে সুর চিনলামনা গো ঠাকুর।"
নিকোনো মেঝের ওপর চাটাই পাতা ছিল। চারুবেদ তাতে বসতে উদ্যত হলে, রমণী বলে ওঠলো, "ও কি করো ঠাকুর, চাটাইয়ে বসবে নাকি? একখানা আসন পেতে দিই রোসো।"
চারুবেদ সে কথার তোয়াক্কা না করে চাটাইয়ের ওপর বসে পড়ে বললো, "আগে একটু জিরোই। এক ঘটি জল দাও দিকি।"
রমণীটি একটি রেকাবে খান দুই মন্ডা ও এক ঘটি জল এনে দিল। "এটুক মুখে দিয়ে জল খাও। আমার হাতে তৈরি। "
চারুবেদ প্রায় আধ ঘটি জল গলায় ঢেলে, রমণীটির থুতনি ধরে একটু আদুরে নাড়া দিয়ে বললো, "মিঠাই মিঠে হয়েছে, তোমার মতোই।" রমণীটি চারুবেদের আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে লজ্জার ভাণ করে বললো, "সত্যি বলছো? তোমার ছলনা বোঝা দায়।"
চারুবেদ রমণীর দেহবল্লরীর ওপর দু চোখ বোলাতে লাগলো। অনাবৃত ডান কাঁধ ও পৃষ্টদেশ।বক্ষে কোনো কাঁচুলি নেই। আকারে পুষ্ট ও ভারে সামান্য অবনত স্তনযুগলের ওপর একপালটা বস্ত্রের আবরণ। বাকি আঁচল খসে পড়েছে চাটাইয়ের ওপর। হাঁটুর পর থেকেই অনাবৃত পা দুখানি একদিকে মুড়ে সামান্য কাত হয়ে রমণী বসেছে চারুবেদের গা ঘেঁষে। আলক্তরঞ্জিত পদযুগল রূপোর নয়, ফুলের তৈরি মল দিয়ে সজ্জিত। হাতে, গলায়, কবরীতে ফুলের গয়না। কালিদাসের নায়িকার মতো মুখশ্রী না হলেও রমণী নিঃসন্দেহে লাস্যময়ী।
চারুবেদ বড়ই অসহিষ্ণু হয়ে পড়লো। রমণীকে জড়িয়ে ধরে তার পরিধেয় বস্ত্র টেনে সরিয়ে দিল। রমণীর দেহের উপরিভাগ নিরাবরন হলো। চারুবেদের ক্ষিপ্র দৃষ্টি যেন রমণীর স্তনদ্বয় পুড়িয়ে দিতে লাগলো। চারুবেদ ও রমণী রমণে লিপ্ত হলো।

বড়গোঁসাইজি এ গাঁয়ে আখড়া তৈরি করেন বছর আটেক আগে। পীরহাট গ্রামটি বঙ্গ আর কলিঙ্গর সীমানার কাছেই। পীরহাট গ্রামে আসার পূর্বে রূপপুরের বড় আখড়া ও বৈষ্ণব সমাজের সঙ্গে গোঁসাইজির মতানৈক্য চরমে পৌঁছোয়। তিনি তখন সেখানেই থাকতেন। গোঁসাইজি রূপপুর আখড়ার কিছু বয়ঃজ্যেষ্ঠ গোঁসাইদের রীতিনীতি, আচারের তীব্র সমালোচনা ও বিরোধিতা করেন। বঙ্গদেশের সাথে কলিঙ্গেরও কিছু হিন্দু পুরোহিত তখন প্রায়ই এসে জুটতেন রূপপুর আখড়ায়। তারা প্রচুর উপঢৌকন নিয়ে আসতেন ও আখড়ায় অর্থসাহায্যও করতেন। তখন এসবের কারণ বুঝতে না পারলেও, আদর্শচ্যুতিহেতু বৈষ্ণবসমাজ ও সাধারণ নিরীহ গ্রাম্যমানুষগুলোর যে প্রভূত ক্ষতিসাধন হচ্ছিল, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ ছিলনা গোঁসাইজির। তাদের সঙ্গে বৈরিতা করে, রূপপুরের আখড়ায় থাকা ক্রমে দুর্বিষহ হয়ে ওঠেছিল গোঁসাইজির। ফলতঃ কুটনৈতিকভাবে তার ওপর নানা অত্যাচার করে তৎকালীন রূপপুরের আখড়ার ক্ষমতাবান বৈষ্ণবগণ তাকে অর্ধচন্দ্র দিয়ে আখড়া থেকে বহিষ্কার করেন।


আখড়া থেকে বেরিয়ে বিষন্নমন, হতোদ্যম গোঁসাইজি অপমানের জ্বালায় জ্বলতে জ্বলতে যেদিকে দুচোখ যায় হাঁটতে থাকেন। পথশ্রমে ক্লান্ত গোঁসাইজি রাত্রি গভীর হলে বিশ্রাম নেন এই পীরহাট গ্রামেই এক পরিত্যক্ত ভগ্নপ্রায় প্রাচীন অট্টালিকার ধ্বংসাবশেষের মধ্যে। এককালের শাসক রাজার বাড়ি ছিল এটি। নিঃসন্তান ছোটরাজার দেহাবসানের পর তার সব সম্পত্তি চলে যায় সুলতানের হাতে। সেই থেকে কোনো পরিচর্যা না হওয়ায় ভিটের এই হাল হয়। কেবল একদিকটায় একটি মসজিদ বানানো হয়েছিল, সম্ভবত সুলতানের রাজপ্রাসাদ অধিগ্রহণের পর। মসজিদ সংলগ্ন কয়েকখানি ঘর। শুধু সেদিকটার এখনো পরিচর্যা হয়। সেখানেই কোনোক্রমে রাত্রি অতিবাহিত করেন গোঁসাইজি। ভোরের আলো ফোটার পূর্বেই ফযর নামাজের প্রার্থনা কানে আসে তার। ঘুম ভেঙে যায়। গোঁসাইজি নদীর দিকে যান। স্নান সেরে উঠে আসতে গিয়ে দেখেন নদীর ধার বরাবর কয়েকখানি হোগলার ছাউনি দেওয়া ঘর। তারই একটির মধ্যে থেকে কীর্তনের সুর ভেসে আসছে। গোঁসাইজি সেই যে এই গাঁয়ের কয়েকঘর বৈষ্ণবের সঙ্গে বসবাস শুরু করলেন, সেই থেকে আজোবধি তা অব্যাহত। নিজে যে শুধু আশ্রয় পেলেন তা নয়, শুরু করলেন দরিদ্র জনসেবা। ধর্মাধর্ম জাতবিচারহীন নিঃসার্থ জনসেবা। তারপর ধীরে ধীরে আরও মানুষ সংযুক্ত হলেন তার কর্মকান্ডে। এমনকি পরবর্তীকালে রূপপুরের আখড়া থেকেও কিছু বৈষ্ণব আসেন গোঁসাইজির আশ্রয়ে। সবাই তাকে ডাকতে লাগলো বড়গোঁসাইজি বলে। ক্রমে আখড়ার বিন্যাসের জন্য মাটি ও কাঠের কয়েকখানি পাকা ঘর বানানো হয়। মন্দির তৈরি হয়। বাঁধানো চাতালে নিত্য বসতে লাগলো কীর্ত্তন, ধর্মালোচনা সভা। আশপাশের গাঁয়ের সাধারণ মানুষ ও গোঁসাইজিরা আসতেন। ক্রমে ক্রমে পীরহাটের বড়গোঁসাইজি ও তার আখড়ার নাম ছড়িয়ে পড়লো, শুধু বঙ্গে নয়, কলিঙ্গেও। কেবল রূপপুরের আখড়ার সঙ্গে চিরকালীন শত্রুতা বজায় রইলো পীরহাট আখড়ার বড়গোঁসাইজির। কিন্তু, রূপপুরের অনেক মানুষ তাকে মনে রাখলো। এমনকি পরবর্তী প্রজন্মের কিশোর ও তরুণ বৈষ্ণবরা, যারা, রূপপুর আখড়ার ক্ষমতাবান বৈষ্ণবদের দ্বারা প্রতি নিয়ত লাঞ্চিত, অত্যাচারিত, তারাও আড়ালে যোগাযোগ রেখে চললো পীরহাটের বড়গোঁসাইজির সাথে। এমনই একজন চারুবেদ।


প্রহর তিনেক পর, বেশ রাতে, রমণীর গৃহ ছেড়ে চারুবেদ বড়গোঁসাইয়ের আখড়ায় পৌঁছালো। আর রমণীটি তড়িঘড়ি কাপড় পরে নিয়ে গৃহের কপাট বন্ধ করে আঁধারে গা ঢাকা দিয়ে পৌঁছলো ছোটরাজবাড়ির মসজিদে। পীরসাহেব তখন উত্তরদিকের একটি কক্ষে কুপি জ্বেলে কিছু অধ্যয়নরত। রমণী ব্যস্ত পদে তার কক্ষের দ্বারসমুখে গিয়ে দাঁড়ালো। পায়ের শব্দ শুনে পীরসাহেব দরজার দিকে তাকিয়ে রমণীকে দেখে উদবিগ্ন হয়ে জানতে চাইলেন তার আগমনের হেতু।
"আবার আর একটা মেয়ে ধরে এনেছে ওরা। শুনলাম, এবার নাকি রূপপুর থেকে নিয়ে এসেছে। একটু জিরিয়ে নিয়ে ওরা আজ রাতেই রম্ভার দিকে যাত্রা করবে তাকে নিয়ে।"
সংবাদ শুনে পীরসাহেব বড় চঞ্চল হয়ে উঠলেন।
"কে খবর দিল তোমায়?"
“যারা এনেছে, তাদের একজন। আমি অনেক আগে এসে খবর দিতে চাইছিলাম, কিন্ত, এক অতিথি এসে যাওয়ায়....“
"মেয়েটি কি তোমাদের ওখানে আছে?"
"না। মেয়েটি মুসলমান, তাই অন্যত্র কোথাও রেখেছে। এদিকে কোনো মেয়ে রাখছেনা, সব রম্ভায় নিয়ে তুলছে। এখানে নতুন নতুন মেয়ে না দিতে পারলে আমার চলে কি করে বলুনতো?"
"তোমার কি সেটাই অসুবিধে? তোমাদের মাসহারার ব্যবস্থা তো আমি করেছি।"
"ঠিক তা বলতে চাইনি। কিন্তু, আমার এখানে না এলেও তো মেয়েগুলো বাঁচছে না। বিপদে আপদে আপনারই তো দয়া পাই পীরসাহেব। আখড়ার কেউ তো আমাদের দিকে একটি মুদ্রাও ছোঁড়ে না।"
"বেশ, তুমি সাবধানে গৃহে ফিরে যাও। আমি দেখছি।"
রমণীটি আবার সন্তর্পণে আঁধারে গা ঢেকে মসজিদ থেকে বেরিয়ে গেল। পীরসাহেবও তৎপর হয়ে মসজিদ থেকে বেরিয়ে চললেন কামার পাড়ার দিকে।
পীরহাট মসজিদের পূর্বতন প্রধান পীরসাহেবের অকস্মাৎ সর্পদংশনে মৃত্যুর পর কানাঘুষো শোনা যেতে শুরু করেছিল যে বাকি বয়স্ক পীরেদের অনেকেই সুলতানের লোকেদের প্ররোচনায় হিন্দু বিদ্বেষী হয়ে উঠেছে। তাদের মধ্যে কেউ পরবর্তী প্রধান হলে গাঁয়ের মানুষের মধ্যের সম্প্রীতি চরম বিঘ্নিত হবে। গোঁসাইজিও মনে মনে চাইছিলেন পরলোকগত পীরসাহেবের দত্তক পুত্র, আহিল, মসজিদের প্রধান পীর হোন। ছেলেটির বয়স অল্প, তবে মেধাবী, সাহসী ও মুক্তচিন্তার অধিকারী। সবচেয়ে বড় কথা ছেলেটি সরল ও নির্লোভ। নানা ধর্ম নিয়ে তার প্রভূত কৌতুহল। পীরসাহেব তাকে মুসলমান ধর্মের পাঠ দিয়েছেন। গোঁসাইজির কাছে সে প্রায়ই আসতো হিন্দুধর্মের পাঠ নিতে। কিছু মতবিরোধের সঙ্গে তর্কযুদ্ধে জয়লাভ করে শেষে আহিলই হয়েছিল এই মাজারের প্রধান পীরসাহেব। সে যুবাপুরুষ, শান্ত, স্থিতধী ও চিন্তায় পরিণত। সেই থেকে আহিলই সামলাচ্ছে পীরহাটের মসজিদের প্রধান পীরসাহেবের সব দায়িত্ব।


সেই রমণীর গৃহ থেকে নিষ্ক্রমণের পর চারুবেদ আখড়ায় পৌঁছে গোঁসাইজিকে প্রণাম করে জানতে চাইলো,
"সব কুশল তো ?"
"হ্যাঁ। তুমি কেমন আছো?"
"ভালো। তবে আখড়ায় থাকা নিয়ে কিঞ্চিৎ সমস্যা হচ্ছে।"
"কেন?"
"আখড়া ক্রমশ মুসলমানদের দখলে চলে যাচ্ছে।"
"এমন মনে হওয়ার হেতু? মুসলমানরা আখড়ায় কি করছে?"
"তারা আখড়ার অনুষ্ঠানে বার বার নানাবিধ বিঘ্ন সৃষ্টি করছে। লোকজনদের হিন্দু আচার বিচারের বিরুদ্ধে বোঝাচ্ছে।"
বড়গোঁসাইজি কেমন ব্যঙ্গের হাসি হাসলেন। তারপর বললেন, "রূপপুরের আখড়ার এতকালের এত দাপট, সহসা কি করে এত ম্রিয়মান হলো?"
চারুবেদ উত্তর দিল, "ঘুনপোকা তো অনেকদিন লেগেছে। আপনি তো সবই জানেন।"
"তা, তুমি এতদিন তিষ্ঠলে কি করে?"
"আমি মাধবের সেবা করেছি মাত্র। আচার বিচার নিয়ে আমার মনে কোনও সংস্কার নেই, সে তো আপনি জানেন। মহাপ্রভুর স্মরণ নিয়েছি। সুন্দরকে ভালোবেসেছি। মাধবপ্রেম....."
চারুবেদের কথার মাঝেই বাধা দিয়ে গোঁসাইজি বললেন, "মাধবপ্রেম ভুলে রমণী প্রেমে মজেছি, তাই তো?" ক্রোধে গোঁসাইজির চক্ষু বিস্ফারিত, চোয়াল শক্ত।
চুরি করে ধরা পড়লে যেমতি হয়, চারুবেদের অবস্থা তেমন। সে এখন বিশ বৎসরের যুবা। সেই কোন বাল্যকাল থেকে দেখে আসছে নিজের কন্ঠিধারী, টিকিধারী, মুন্ডিতমস্তক বৈষ্ণব রূপ। সারাদিন আচার, বিচার, পূজা আর শ্রম। কত নীতিজ্ঞান শুনেছে সে। ধ্যানে বসেছে। তবু যখন রিপুর তাড়সে দেহ জর্জর হয়েছে, কেউ তো বলেনি তার উপশম। এত বিদ্যা, ধ্যান, তাকে রিপু রহিত করেনি, সে কি তার দোষ? সেই তাড়নায় সে ভেসে যায় মাঝেমাঝেই। তাতে কি এমন ক্ষতি? মনে মনে মাথা নিচু করে, কুন্ঠিত হয়ে দাঁড়িয়েও এই সকল যুক্তি মনে মনে আওড়াচ্ছিল চারুবেদ।
গোঁসাইজি তীব্র ভর্ৎসনার সুরে বললেন, "আমার কাছে সব খবরই আসে। আমি এও জানতাম যে তুমি আজ এখানে আসবে। তোমার এত দেরী দেখে সন্দেহ হওয়ায় আমি তোমার অনুসন্ধানে লোক পাঠাই। তারাই আমায় এসে জানায় তুমি কোথায় ছিলে। পীরহাটে তুমি আর এসোনা। আমি এই মুহুর্ত থেকে তোমার সাথে সব সংশ্রব ত্যাগ করলাম।"
চারুবেদ মাথা নিচু করে আঝোর নয়নে কাঁদতে লাগলো। তবু একটি কথাও বললো না। গোঁসাইজি কক্ষ পরিত্যাগ করে চলে যাচ্ছিলেন, সহসা থেমে পিছন ফিরে চারুবেদের দিকে তাকিয়ে বললেন, "তুমি এখনি এই আখড়া থেকে বেরিয়ে, বাকি রাতটুকু অন্য কোথাও কাটিয়ে, ফিরে যেও।"


পীরহাটের আখড়া থেকে বিতাড়িত হয়ে নদীর পাড় ধরে হাঁটছে চারুবেদ। পথিমধ্যে দেখতে পেল একটি নোঙরকরা নৌকোয় একটি স্ত্রীলোকের উপর অত্যাচারের ঘটনা। সে দেখে কাতর ও স্তম্ভিত হয়ে গেল যে ওই স্ত্রীলোকটি তার আফিফা। সেই আফিফা, যে আফিফা চারুবেদের রিপুর তাড়সের উর্ধ্বে সর্বদা থাকে তার হৃদয় জুড়ে। চারুবেদ পাগলের মতো ছুটে গেল আফিফাকে বাঁচাতে। এক দুর্বৃত্ত চারুবেদের মাথায় কুঠারের আঘাত করলো। সে নদীর চরে লুটিয়ে পড়লো। রক্তের ধারা চরের বালি আরক্ত করে মিশছে নদীতে। আধমড়া, প্রায় অচৈতন্য চারুবেদ দেখলো এক মুসলমান পীর ও কয়েকজন কামার, জেলে সেখানে এসে পড়েছে। তাদের সাথে দুর্বৃত্তদের ধস্তাধস্তি, মারামারি হচ্ছে। ক্রমে চারুবেদের চোখ বুজে এলো। সে যেন এক আকাশ মেঘের ভিতর চিরনিদ্রায় ডুবে গেলো। মারামারিতে একটি দুর্বৃত্ত মারা গেল। বাকি দুজন ডুবসাঁতার দিয়ে পালিয়ে বাঁচলো।


আহিল অনেক্ষণ ধরে নদীতে স্নান করে, শুভ্র বস্ত্রে ফেজ পরে নামাজে বসেছে। রাকাতের শুরুতে হাঁটুতে হাত রেখে ভর দিয়ে পিঠ ঝুঁকিয়ে অবনত হয়ে রুকু করছে। আহিলের বার বার মন বিক্ষিপ্ত হচ্ছে। তবুও প্রাণপণে নিবিষ্ট মনে সিজদার পর দোয়ায় বসলো। পরওয়ারদিগরের অজানা নয় কিছুই। তবু এত হিংসা কেন? হতাশা আর অভিমানে দু’চোখ বেয়ে অজোরে জল ঝরছে আহিলের। চোখের ওপর ভাসছে যুবকটির মুখ। বড় সুন্দর মায়াবী মুখ, ফরিস্তার মতো। যুবাটি ওর চেয়ে দুই এক বৎসরের ছোটই হবে। দুদিকে সালাম ফিরিয়ে, প্রার্থনা শেষ করলো আহিল। এখনো সূর্যের আলো ভালো করে ফোটেনি, তবু হলুদ পলাশের গাছটা কেমন উজ্জ্বল। মসজিদের এই ঘরের লাগোয়া ছাদের যেদিকে হলুদ পলাশ গাছটি পুষ্পভারে নুয়ে আছে, তার পেছনেই আরক্ত আভায় আকাশ রাঙিয়ে দিনমণি উদয় হচ্ছেন। আহিল সেই দিকে চেয়ে আছে। চারিপাশে কত ফুল ফুটেছে। নদীর দিক থেকে বয়ে আসা শীতল সমীরে তাদের সুঘ্রাণ মাতিয়ে রেখেছে চারিদিক। আহিলের খেয়াল হলো একবার স্ত্রীলোকটির খবর নেওয়া প্রয়োজন। ঠিক তখনই, বিবস্ত্রা, সামান্য অপ্রকৃতিস্থ সেই স্ত্রীলোক, আহিলের কাছে এসে জানতে চাইলো, “তুমি এসেছো? আমায় বাঁচাও।" তার চোখে মুখে ত্রাস।
আহিল শিউরে উঠে চোখ বুজে নিল। স্ত্রীলোকটির হাতে ধরা কাপড়টি দিয়ে তাড়াতাড়ি ঢেকে দিল তার অঙ্গ। রাতের অন্ধকারে দুর্বৃত্তদের হাত থেকে বাঁচানোর সময় ওই সুপুরুষ বৈষ্ণব যুবকটির রক্তাক্ত, অচৈতন্য দেহ দেখেই স্ত্রীলোকটি আর্তনাদ করে ওঠেছিল। তারপর জ্ঞান হারায়। আহিল তাকে এনে আশ্রয় দেয় মসজিদের একটি ঘরে। স্নান, নামাজ সেরে এই সবে তার খোঁজ নেওয়ার কথা ভাবছিল আহিল।


"পীরসাহেব, ওরা জনাজা নিয়ে অপেক্ষা করছে। আপনি একবার নীচে যাবেন না?” একটি ভৃত্য এসে ডাক দিল। আহিল টের পেল ফুলের নরম গন্ধ ছাপিয়ে ধূপের উগ্র গন্ধে ভরে গেছে বাতাস। সে অবাক হয়ে ভৃত্যকে জিজ্ঞেস করলো, কার জানাজা?" ভৃত্য মাথা নিচু করে রইলো। আহিল বুঝতে পারলো। যে দুর্বৃত্তটি নিহত হয়েছে, সে মুসলমান। লড়াইয়ের শেষে আহিলই বলেছিল মৃতদেহ দুটির যথাযথ সৎকারের কথা। আহিল কাপড় জড়িয়ে দেবার পর স্ত্রীলোকটি ঘরের কোণায় জবু থবু হয়ে বসে এক শুন্য দৃষ্টি নিয়ে মসজিদের ছাদের দিকে চেয়ে আছে। আর একটি কথাও বলেনি। তার দিকে চেয়ে বুকের ভেতর বড় যন্ত্রণা হলো আহিলের। এসব হিংসা সে মনেপ্রাণে ঘৃণা করে। তবু যে কেন? সে নিচে নেমে এলো ধীর পায়ে। মৃতদেহের সামনে কিছুক্ষণ চোখ বুজে দাঁড়ালো। হয়তো প্রার্থনা করলো। তারপর হাতের ইশারায় শবদেহ দাফনের জন্য নিয়ে যেতে বলল। সবাই বিদায় নিতে উদ্যত হলে, আহিল দেখলো যে গোঁসাইজি মসজিদের দিকে আসছেন। আহিল এগিয়ে গেল তার দিকে। গোঁসাইজি আহিলকে একটু দূরে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললেন, "আরেকটি জানাজা হবে। তোমার লোকেদের বলো, তার বন্দোবস্ত করতে।"
আহিল অবাক হলো, "কার জানাজা?"
যে বৈষ্ণব যুবকটিকে তুমি কাল রাতে হত্যা করেছো, তার জানাজা।"
"যুবকটিকে আমি হত্যা করিনি গোঁসাইজি। দুর্বৃত্তদের সাথে ধস্তাধস্তিতে তাদের আঘাতেই সে নিহত হয়েছে। যদিও সে বৈষ্ণব তবুও সে দুর্বৃত্তদের সহকারী ছিল বলেই আমার মনে হয়েছিল। কিন্তু, আমরা পৌঁছেই দেখলাম দুর্বৃত্তরা ওকে হত্যা করলো। তার আগে ওদের মধ্যে কি বিতন্ডা হয়েছিল, জানিনা। তাছাড়া সে তো বৈষ্ণব, তার সৎকারের অন্য ব্যবস্থা হওয়া উচিত।"
গোঁসাইজি আহিলের কাঁধে হাত রাখলো।
"তুমি এ গাঁয়ের পীরসাহেব। আশপাশের দশ বারোটা গাঁয়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় মসজিদের পীরসাহেব। কিন্তু, আমার কাছে তুমি আমার সন্তানতুল্য। এমনই স্নেহের ছিল চারুবেদ, যে কাল নিহত হয়েছে। তোমায় আমি সতর্ক করতে চাই আহিল। এ গোল এত সহজে মিটবেনা। রূপপুর আখড়ার বৈষ্ণব ছিল চারুবেদ। সবাই বলাবলি করছে তুমিই তাকে হত্যা করেছো। তারা আরও বলছে যে যারা তোমার স্ত্রীকে তুলে আনছিল, তারা আসলে দুর্বৃত্ত নয়, তোমারই লোক।
"আমার স্ত্রী?" আহিলের বিস্ময়ের সীমা নেই।
"তোমার মনে আছে কিনা জানিনা। তুমি তখন নিতান্তই বালক। তোমার পিতা তোমায় দত্তক নেওয়ার পূর্বে, জাতিদাঙ্গার সময়, তোমার সাথে একটি মেয়ের নিকাহ হয়েছিল। যে স্ত্রীলোকটিকে কাল রাতে উদ্ধার করে তুমি আশ্রয় দিয়েছো, সেইই তোমার স্ত্রী আফিফা।"
আহিল হতবাক হয়ে শোনে গোঁসাইজির কথা। মাথার মধ্যে কেমন সব ধোঁয়ার মতো, বুঝতে পারেনা এ স্বপ্ন না বাস্তব। পাশেই একটি থাম আর রোয়াক ছিল। সেখানে বসে পড়ে আহিল।
গোঁসাইজি বলে চলে, "কারা যেন সব বলাবলি শুরু করেছে, তোমার নির্দেশেই তোমার লোকেরা আফিফাকে তুলে এনেছিল। চারুবেদ জানতে পেরে বাধা দেয়। তাই তুমি তাকে হত্যা করেছো।"
কিছুক্ষণ ধীর হয়ে বসে থাকে আহিল। গোঁসাইজি তার পাশে গিয়ে বসে।
"চারুবেদের সাথে আফিফার সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও, তা হয়তো সামলানো যাবে, কারণ আমি জানি আর আমার সাথে রূপপুর আখড়ার আরও অনেকেই জানে চারুবেদ এক মুসলমান দম্পতির সন্তান। দাঙ্গায় ওর পরিবারের সকলে মারা যায়। তখন আমি ছিলাম রূপপুর আখড়ায়। মহাপ্রভুর স্মরণে আমিই ওকে নিয়ে এসে বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষা দিই।"
"ওর তো ধর্মান্তর ঘটেছে। তাহলে আর জানাজার কথা বলছেন কেন?", আহিল অন্যমনস্ক হয়েই প্রশ্ন করলো।
"বলছি স্ত্রীলোকটির কথা ভেবে৷ চারুবেদ তো তার প্রাপ্য সকল শাস্তির উর্ধ্বে চলে গেছে। কিন্তু, মেয়েটিকে তো বাঁচতে হবে। তবু মুসলমান মেয়ের মুসলমানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল জানলে হয়তো...."
আহিল বিস্মিত হয়ে তাকালো গোঁসাইজির দিকে। কেমন অচেনা ঠেকছে মানুষটাকে। তার বিস্ময়ভাবকে উদ্দেশ্য করে গোঁসাইজি বললেন, "তুমি হয়তো ভাবছো, যে লোকে তো এও জানবে যে তুমি কেবল তোমার স্ত্রীকে কাছে আনার ব্যবস্থা করেছো। কিন্তু, তা করতে গিয়ে তো তুমি এক হিন্দুকে হত্যা করতে পারোনা।"
আহিল হতাশ হয়ে বলে, "কিন্তু, আমি তো কিছুই জানতাম না, আমি হত্যাও করিনি..."
"আমি বুঝতে পারছি, কিন্তু, লোকে যা বলছে....যাক সে কথা। তুমি তাড়াতাড়ি জানাজা তৈরীর হুকুম দাও।"


কিছু মাস অতিবাহিত হলে পর, আহিলের আশ্রয়ে আফিফা ক্রমে সুস্থ হতে থাকে। তবে এখনও সে সম্পূর্ণ প্রকৃতিস্থ নয়। এদিকে পীরহাটের বাতাসে টের পাওয়া যাচ্ছে যে সকল সম্প্রদায়ের এক প্রেমময় সহাবস্থানকে ক্রমে বিষিয়ে দেবার ষড়যন্ত্র চলছে কোথাও। সহজ, সরল, সাধারণ মানুষদের নানা প্ররোচনায় ধর্মযুদ্ধে লিপ্ত করে, হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে ঘোরতর বিবাদ ও দ্বন্দ্ব বাঁধানোর প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে।


তবু এরই মাঝে মানুষের দৈনন্দিনতা ও ষড়রিপুর গতানুগতিক অবস্থান। গ্রামের অনেক মানুষ যায় সেই রমণীটির কাছে। যার কাছে কয়েকবার গিয়েছিল চারুবেদও। সেই রমণী আজ আবার আঁধার গায়ে মেখে সন্তর্পণে লোকচক্ষুর আড়ালে চলেছে তার গন্তব্যে। নাঃ, এবার মসজিদে পীরসাহেবের কাছে নয়। সে পৌঁছলো পীরহাটের আখড়ায়, বড়গোঁসাইজির কাছে। বড়গোঁসাইজির কক্ষের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে প্রণাম জানালো। কিছু খবরাখবর দিল। গোঁসাইজি বললো, "তোমাদের মাসহারা ঠিকঠাক পাচ্ছো তো?"
"তা পাচ্ছি। পীরসাহেব যা দেন, তার চেয়ে অনেক বেশী।"
গোঁসাইজি বললো, "তা বেশ। এবার কাজের কথা শোনো। একটা খবর খুব শীঘ্র গ্রামে ছড়িয়ে দেওয়া চাই। পীরসাহেব বা আহিল আসলে জন্মগত হিন্দু। পূর্বতন পীরসাহেবের দত্তকপুত্র হয়ে তবেই সে মুসলমান হয়েছিল। কলিঙ্গর এক অনাথালয় থেকে এখন সে খবর জানা গেছে।"
রমণী সবটা শুনে মাথা নাড়লো।
"আরও বলবে, যে চারুবেদ কিন্তু আসলে হিন্দু ছিল না। সে জন্মগত মুসলমান। তার পিতা মাতার মৃত্যুর পর আমিই তাকে উদ্ধার করে রূপপুরের বৈষ্ণব আখড়ায় আশ্রয় দিই। পীরসাহেব হয়ে একটি নারীর লোভে আহিল চারুবেদকে হত্যা করলো!! এক ঝুটো মুসলমান এক জন্ম সাচ্চা মুসলমানকে মেরে ফেললো!! তার উপর এখনো নারীটিকে অধিকার করে রেখেছে সে নিজের কাছে।"
গোঁসাইজি রমণীটিকে কিছু উপঢৌকন দিয়ে বিদায় দিলেন। গোঁসাইজির কক্ষের ভিতর তখন আরও চারজন অতিথি। সেই পলাতক দুর্বৃত্তদের দুইজন, পাশের গাঁয়ের মসজিদের পীরসাহেব আর রূপপুর আখড়ার এক বৈষ্ণব। পাশের গাঁয়ের এই পীরসাহেবের অনেকদিনের ইচ্ছা তিনি পীরহাটের বড় মসজিদের প্রধান পীর হবেন। সে ব্যবস্থা করে দেবেন কথা দিয়েছেন গোঁসাইজি। বিনিময়ে পাবেন পাশের গ্রামের প্রচুর জমিজমা ও সব সম্প্রদায়ের মানুষের আনুগত্য। রূপপুরের আখড়ার বৈষ্ণবের উদ্দেশ্যে বড়গোঁসাইজি বললেন, "তোমাদের প্রতিবাদ আরও তীব্র করো। চারুবেদের রমণী আসক্তি জেনেও কেন চুপ থাকতেন রূপপুর আখড়ার বড়গোঁসাইরা? এক ঝুটো হিন্দু এক জন্ম সাচ্চা নিরীহ মুসলমান মেয়েকে দিনের পর দিন ভোগ করেছে। হলোই বা সে পুরুষ জন্মগত মুসলমান, ধর্মান্তর করে বৈষ্ণব হয়েছিল তো। রূপপুরের এইসব অকর্মণ্য বড়গোঁসাইদের বশ্যতা তোমরা মেনে নেবে? সকলকে বোঝাও, আমি আছি। বলো পীরহাটের আখড়া আছে সবার জন্য।" সব শেষে দুর্বৃত্তদের দিকে তাকিয়ে বললেন, "শুনলে তো সব। বাকিদের সবার কাজ ঠিক ঠিক হলে, ভালো করে আগুন জ্বললে, সেই সুযোগে মেয়েটিকে মসজিদ থেকে তুলে নেবে।"

No comments:

Post a Comment

একনজরে

সম্পাদকীয়

একটি বিষয়ে আমাদের সকলের একমত হতেই হবে ভিন্ন মতের ও ভিন্ন রুচির বহুস্তরকে সম্মান জানিয়েও, যে, আমরা এই মুহূর্তে প্রায়শ্চিত্ত করছি। মানুষ...

বেশিবার পড়া হয়েছে যেগুলি