Monday, April 13, 2020

বিশেষ নিবন্ধ: অতিমারী কিংবা সতীর শীতল শব কোলে... সরোজ দরবার







আসুন, ক-টা পাড়া আঁকি। দাসপাড়া, মণ্ডলপাড়া, বামুনপাড়া...। পাড়ার প্রান্ত থেকে প্রান্তে এঁকে দিই লালচে কি মেটে রঙের একটা নদী। আঁকাবাঁকা ক্ষীণ শরীরে সে ছুঁয়ে থাকুক প্রতিবেশী। কেউ কেউ তার নাম দেবে পথ। সে-পথ ধরেই পাড়া বেড়াতে বেরাবে বউ-ঝিরা; অথবা বেকার ছেলেটা; দুরন্ত কিশোর; আর বয়স্কা প্রতিবেশিনীর সামনে পড়ে কী তিরস্কৃতই না হবে। এমনি করে কত সূর্য উঠবে পূবের রাংচিতা গাছের ঝোপ থেকে। ডুবে যাবে পশ্চিমের বাঁশঝাড়ে। তারপর একদিন যখন ওই বামুন, মণ্ডল কি দাসপাড়ার বয়স্কা খিটখিটে মুখরা প্রতিবেশিনীর শ্বাস উঠবে- মরণ এসে দাঁড়িয়ে দোরগোড়ায় - তখন পাড়া ঝেঁটিয়ে লোকে এসে তাঁকে দেখে যাবে। সকলেরই মুখ মেঘলা; বলবে, বড্ড মুখরা ছিল, কিন্তু বড়ো ভালো ছিল গো মানুষটা; কখনও কারও ক্ষতি করেনি।

কত সহজে আমাদের রং-পেন্সিল কাগজের উপর সরে সরে যায়। কত অনায়াসে আমাদের স্মৃতি এই ছবি এঁকে ফেলতে পারে। এ-ছবির ভিতর যদিও আর আমরা বাস করি না।

আসুন, আর-একটা ছবি আঁকি। কোনও এক নিউল্যান্ড অ্যাসোসিয়েশন আর ওয়ান্ডারল্যান্ড সোসাইটি বসে আছে মুখোমুখি। একটা কালো রাস্তা ছুঁয়ে আছে তাদেরও। কিন্তু নিউল্যান্ড থেকে ওয়ান্ডারল্যান্ড বেড়াতে বেরিয়েছে এমন কাউকে আঁকতে পারছে না আমাদের পেন্সিল। এমন কাউকে সে চেনেই না বস্তুত; সূর্যটাও সেখানে কেবল মাঝখানে থাকে। পূব-পশ্চিম ঢেকে গেছে হাইরাইজে। কারো জন্য নেই কারো তিরস্কার; কারো জন্য নেই কারো সমবেদনাও। তবু ঢাউস কমিউনিটি হল আছে। পুজো হোক বা দোল, শৌখিন ‘গলে লাগ যা’ আছে; খানা-পিনাও আছে। শুধু পাড়া নেই। আনাগোনা নেই। নেই পাড়া ঝেঁটিয়ে বেরিয়ে পড়ার গল্প; কারুর জন্য চুকুচুক, দুঃখ পাওয়া। অথচ আশ্চর্য এই যে, এই ছবিটার ভিতরই এখন অসংখ্য কালো কালো মাথা। আমরাও এখানেই থাকি।

তাহলে কি সেইসব পাড়ারা আর নেই? আছে এখনও; খানিকটা বদল নিয়ে। আর সেই পাড়ার ভিতর থেকে সার সার পরিযায়ী একদিন পোঁটলা-পুঁটলি নিয়ে এই ওয়ান্ডার কি নিউল্যান্ডের ভিতর ঢুকে পড়েছে। পুরনো পাড়ায় তাদের শিকড়ের মাটি আলগা হয়েছে, বহুদিন হল; আর নতুন ল্যান্ডের কংক্রিট ফাটিয়ে শিকড় আর জমে ওঠেনি; একদল উদ্বাস্তু তাই ঘোরেফেরে প্রতিবেশীর ছদ্মবেশে।

এইবার, এই দুটো ছবিতেই আসুন, খানিকটা সংকট রেখে আসি। দুটো ছবির ওপর দিয়ে আলতো করে বুলিয়ে দিতে থাকি মৃত্যু। দেখা যাবে, সাদা কাগজে ফুটে উঠছে ভয়, আতঙ্ক। দুটো ছবিই ব্যাপক বদলে যাচ্ছে; তবে, এর ভিতরেও কোথাও ফুটে উঠছে সমবেদনা, সহানুভূতি; মৃদু রেখায়। সেটা ঠিক কোন ছবিতে, তা আপনারাই ভালো বিচার করতে পারবেন।

এই দুটো ছবি পকেটে নিয়েই আমরা এগোচ্ছিলাম। আমাদের এগোনো ছাড়া আর কোনও রাস্তা ছিল না। কিন্তু সংকটটা যে ছিলই, তা আমরা ভুলেই থেকেছি। আমরা কখনও ধৃতরাষ্ট্র; দেখেও না-দেখার দোষে দুষ্ট। কখনও আবার পাণ্ডু; সাক্ষৎ মৃত্যু জেনেও সংবরণ করতে যে পারেনি সম্ভোগকে। এই দুই চরিত্র সমকালে সম্ভব হয়ে উঠলে একটা যুদ্ধ আসন্ন হয়ে পড়ে; কুরুক্ষেত্র ঠেকানো যায়নি। আমাদের এগোনোর ভিতরে এত যে মৃত্যুর ওঁৎ, জেনেও আমরা প্রতিহত করিনি সে-সব। প্রকৃতি-পরিবেশ মাড়িয়ে এগোতে-এগোতে, উৎকট বস্তুগত ভোগের পৃথিবীর দিকে ক্রমাগত ঝুঁকতে-ঝুঁকতে, যন্ত্রকে ঈশ্বর করে তুলতে-তুলতে, ক্ষমতাকে আনুগত্য দেখাতে-দেখাতে, যেদিন আমরা টের পেলাম অতিমারীর মুখে পড়ে গেছি, সেদিন আমাদের কোথাও আর দু-দণ্ড বসার অবসর নেই। নেই এমন কোনও মত ও আদর্শ, যার সামনে গিয়ে আশ্রয় চাওয়া যায়। এখন অসংখ্য পরিযায়ী কেবল হেঁটে চলেছে, জীবন থেকে জীবনহীনতার দিকে; প্রাণ থেকে অপ্রাণের দিকে; তাদের কেউ কিছুমাত্র সাহায্য করছে না তেমন। অথচ তাদের নিয়ে আলোচনা হচ্ছে বিস্তর। এ-এক আশ্চর্য নৃশংসতা। সেই আদিম অরণ্যে পশুকে ঘিরে ধরে শিকারের মতোই। শুধু তফাৎ এই যে, এখানে দুই পক্ষই মানুষ; আধুনিক মানুষ;

এই আধুনিক মানুষের কায়া-ছায়াকে নিরীক্ষণ ও বিশ্লেষণ করেছিলেন মার্টিন বুবের। প্রথমেই তাঁর মনে হয়েছিল, এই যে পুরনো সংস্থানগুলো ভেঙে গেল, তার ধারণাগুলো আমাদের চেতনা থেকে অপসৃত হতে থাকল ক্রমশ, তার মূল্য আমাদের চোকাতে হয় বা হবে একটা বুর্জোয়া সমাজে প্রতিনিয়ত বসবাসের মধ্য দিয়ে। পরিবার, গ্রামসমাজ, পাড়া ইত্যাদির সংযুক্তি, আত্মিকতার বদলে আধুনিক মানুষের হাতে এল যে ধরনের সংস্থান- অর্থাৎ, ক্লাব বা শ্রমিক ইউনিয়ন বা পার্টি ইত্যাদি – তা কিছুতেই মানুষকে তার পুরনো আত্মীয়তায় পৌঁছে দিতে পারল না। মাথার উপর শামিয়ানা টাঙানো হল না; অনেকসময় পুরনো সংস্থানগুলো রয়ে গেল ঠিকই; বহিরঙ্গে আগের মতোই; কিন্তু ভিতর ভিতর সে বদলে গেল আমূল। ফলে, মানুষ হারিয়ে ফেলল তার নিরাপত্তা, আত্মিকতা, আধ্যাত্মিকতাও; এবং ঘন হয়ে তার বুকে জমাট বাঁধল প্রগাঢ় নিঃসঙ্গতা। ক্রমাগত আত্মিক অবনতির মুখে পড়তে থাকল মানুষ। তার কারণ আছে অনেকানেক। বুবের বলছেন, শুধু প্রযুক্তির কথাই যদি ধরা যায়, দেখা যাবে, যে-প্রযুক্তি মানুষকে সাহায্য করবে বলে জন্ম নিল, একদিন সেই প্রায় তার প্রভু হয়ে বসল প্রায়। মানুষকে পেড়ে ফেলল; আজকের সোশ্যালমিডিয়া যখন বিদ্বেষচাষের ভিত্তিভূমি হয়ে মানবসভ্যতাকে এমনকি দাঙ্গার মতো কুৎসিত ধ্বংস-উন্মাদনার দিকে ঠেলে দেয়, তখন আমরা এ-কথার সত্যতা অক্ষরে অক্ষরে বুঝতে পারি। ক্রমে দেখা গেল, জনসংখ্যা বৃদ্ধি আর সেই সঙ্গে উৎপাদন আর বণ্টনের অসাম্য এমন বাড়তে থাকল যে, একদিন তা-ও মানুষের নিয়ন্ত্রণের অতীত হল। রাজনৈতিকভাবেও দেখে গেল, (প্রথম)বিশ্বযুদ্ধের মতো ঘটনা মানুকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, ক্ষমতার কাছে সে কী তীব্রভাবে অসহায়। দর্শনগত দিক থেকেও এই ধরনের মানুষ, অর্থাৎ তথাকথিত আধুনিক মানুষ আশ্রয়হীনতায় ভোগে। ফলে একদিন সে স্পষ্ট বুঝতে পারে- ‘Man faced the terrible fact that he was the father of demons whose master he could not become.’

ঠিক এইখানে পৌঁছে, আমরা সমসময়ের দিকে তাকিয়ে মিলিয়ে নিতে পারি যে, দার্শনিক বুবের কতখানি অভ্রান্ত ছিলেন তাঁর নির্ণয়ে। মানুষের ধারণা থেকে মানুষ নিজেই যে অনেকাংশে হারিয়ে গিয়েছে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। নইলে গোটা বিশ্বজুড়ে যখন মৃত্যুমিছিল, তখন কীসের ভালোলাগায় কেউ একজন ফুলঝুরি, তারাবাতি জ্বালান? মানুষের কাছে তো এখনও উল্লাসের প্রেক্ষা বদলে যায়নি। তাহলে? যে কারণে মানুষ উল্লসিত হন, আর যে কারণে শোকাতুর হন – সেগুলোর ধারণা বিপ্রতীপ হয়ে ওঠেনি। ফলে এই মানুষ যে উল্লাস করছেন, তা ঠিক বলা যায় না। কিন্তু এ-কথা নিশ্চিত করেই বলা যায় যে, তিনি শোকাতুর নন; যদিও শোকের জন্ম হওয়া স্বাভাবিক ছিল এই সময়। খেয়াল করলে দেখব, এই মানুষেরও কোনও পাড়া নেই, আত্মিক যোগাযোগ নেই; তার আর সেই মৃত্যুমুখে পতিত বৃদ্ধ-বৃদ্ধার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে ইচ্ছে করে না। চোখ ছলছল করে না; কারণ, বহুদিন আগেই সে আকাশটাকে খণ্ডিত করে ফেলেছে। যেখানে সূর্য শুধু মাঝখানে ওঠে। এমনকি, তার সামনে কোনও রাজনৈতিক আদর্শও নেই তেমন; ব্যক্তিলোপের কথা হয়তো তাকে বলেছিল যে ভাবধারা, তারই পুষ্টি নিয়ে সংসদীয় কাঠামোর ভিতর ঢুকে যখন সেই আদর্শের রাজনৈতিক অভিব্যক্তি মানুষকে যথাযথ গুরুত্ব দিতে অসমর্থ হল, তখন সেই ব্যক্তিমানুষের সামনে সমষ্টি এবং সমষ্টির চিন্তা একটা প্রগাঢ় ঠাট্টা হয়ে দেখা গেল; গোটা বিশ্বে উলটোদিক থেকে দক্ষিণপন্থী উত্থান এখন সেই ব্যক্তিমানুষের কাছে চেয়ে বসেছে প্রশ্নহীন আনুগত্য। যে তাই তারাবাতি জ্বালায়, চকোলেট বোম ফাটায় সে যে মানুষের মৃত্যুতে খুব আনন্দ করে ফাটায় তা নয়; সে ফাটায় কারণ, এক অচেনা ক্ষমতাকে সে তার আনুগত্য জানায়; তাতে তার কী লাভ হবে?এ-প্রশ্ন করতেও সে ভুলে গেছে; কারণ সে জানে এই ক্ষমতা চাইলে জনপদের পর জনপদ ধ্বংস করে দিতে পারে স্রেফ একটা বোম ফেলে। কোনও মানবিক চিন্তাই মানুষকে এই ক্ষমতার বিধ্বংসী থাবা থেকে রক্ষা করতে পারে না তখন। ব্যক্তির হাতে এমন কিছু নেই, যা এই আগ্রাসনকে প্রতিহত করতে পারে। ফলত সে একা, এবং চূড়ান্ত একা- বলা ভালো তীব্র নিঃসঙ্গতার মধ্যে ঢুকে পড়ে। এই বিচ্ছিন্নতা, সামাজিক বিচ্ছিন্নতার বহুতর অনুশীলন যখন সারা, তখন একটা অতিমারীর মুখে পড়ে আমরা দেখলাম, এক চূড়ান্ত বিভ্রান্ত মানবসভ্যতা উন্মাদের মতো হেঁটে যাচ্ছে; সে সর্বার্থেই পরিযায়ী; তাকে নিয়ে আলোচনা করছে সবাই; কিন্তু তার মুখে কেউ কিছু তুলে দিচ্ছে না। কেউ তার পাশে দাঁড়াচ্ছে না। বরং তৃতীয়বার বিশ্বযুদ্ধ যে লেগে গিয়েছে, এই ব্যাপারটিতেই সে নিশ্চিত হতে চাইছে। দুটি যুদ্ধের ইতিহাস নিয়েও কেউ সে যুদ্ধ রোখার চেষ্টা করছে না। এত প্রগতি, এত উন্নয়নের ধারণা কিছুই আজ তাকে আদিম স্বার্থপর হওয়া থেকে রক্ষা করছে না। অদ্ভুত বুনো নৃশংশতা। এর শিকার মানুষ আজ নিজেই।

চিন্তকরা বলছেন, এই অতিমারী পেরিয়ে, এই নৃশংশতার ছায়া পেরিয়ে সভ্যতা যদি বেঁচে যায়, তবে সে আর আগের মতো থাকবে না। কীভাবে বদলে যাবে? তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারেন না। পারা সম্ভবও নয়; তবে, অনেকের ভাবনা যে, বাজার-সন্ত্রাস থেকে মানুষ এবার মুখ ফেরাবে। বাজারের সামনে নিজেকে আর মেলে ধরবে না। অর্থাৎ, মৃত্যু মাথায় নিয়েও পাণ্ডুর ভোগ ও সম্ভোগের মুদ্রাদোষ থেকে সে হয়তো কিছুটা পিছুয়ে আসবে; কারণ, সে দেখেছে, এই বস্তুগত পৃথিবী তাকে একটা ভাইরাসের হাত থেকেও বাঁচাতে পারেনি। যদি এই মোহত্যাগ সম্ভব হয় তাহলে পুঁজির তথাকথিত উদারতার ছদ্মবেশে দস্যুবৃত্তির প্রবণতাও কমতে বাধ্য। সেক্ষেত্রে সভ্যতার উৎপাদন ও বন্টন ব্যবস্থায় একটা পুনর্বিন্যাস হলেও হতে পারে। আর, সবথেকে বড়ো কথা, এই একটা আঘাত মানুষকে যেভাবে ধনে-প্রাণে দেউলিয়া করে দিল, এখান থেকেই সে বাইরের দিকের চলা কমিয়ে ভিতরপানে মুখ ফেরাবে। হয়তো আসবে কোনও দার্শনিক প্রজ্ঞা; আশ্রয়; যা আগামী দশকে মানুষকে মানবের অভিমুখী করে তুলবে।

কিন্তু এ-সবই কল্পনা। উমার প্রেমের গল্প। সেখানে পৌঁছতে গেলে সতীর শীতল শব কোলে বহুদিন বসে থাকা ছাড়া আমাদের গত্যন্তর নেই।

No comments:

Post a Comment

একনজরে

সম্পাদকীয়

একটি বিষয়ে আমাদের সকলের একমত হতেই হবে ভিন্ন মতের ও ভিন্ন রুচির বহুস্তরকে সম্মান জানিয়েও, যে, আমরা এই মুহূর্তে প্রায়শ্চিত্ত করছি। মানুষ...

বেশিবার পড়া হয়েছে যেগুলি