Monday, April 13, 2020

অর্পিতা দাস-এর ছোটগল্প





অন্দর

এক অদ্ভূত নিজস্বতা আছে এই মুহূর্তটার মধ্যে। চারপাশের আওয়াজগুলো কানে ঢুকছে না। ভেতরের প্রতিধ্বনি ফিরে আসছে বারে বারে...'ভেতরে...আরও ভেতরে' ...কি গভীর ভাবনা না?

না, কোন প্রেক্ষাপট ছাড়া কাউকে বললে, সে বলবে বুঝি নব্য বিবাহিত যুবক, নিজের কাম-প্রবাহে আসক্ত হয়ে এইসব প্রলাপ বকছে। প্রেম পুর্বক নতুন বিবাহিত যুবক, নতুন সংসার হলে, মাঝে মাঝে এরম কাব্যিক প্রলাপ বকে, এটাকে বয়োজ্জেষ্ঠ্যরা হেসে উড়িয়ে দেয়, আর সমবয়সী বা বন্ধুরা ইয়ার্কি হিসেবে নেয়

'ভো ভো' করে দু বার হর্ন বেজে মটর দাঁড়ালো...বাড়ির সামনে। পাশে হ্যারি বসে। সে বলে উঠল 'নাও রাস্তায় কিছুই তো খেতে দিলে না। এখন কিন্তু আর দেরী করবে না। সোজা চান সেরে চলে এসো আধ ঘন্টার মধ্যে...জমিয়ে খিদে পেয়েছে।'

হ্যারি সকালে চান সেরে বেরিয়েছিল... রবার্ট নিজের ঘরে ঢুকে পরল। নাওমি নেই। ও আবার ওইসব জায়গায় গেছে বোধহয়। ওর জন্যই যত ঝ্যামেলা। নাহলে ভালোই তো ছিল... নিজের অ্যারোগেন্স নিয়ে, নিজের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে...' না এবার একটু খোলসা করে বলা দরকার। রবার্ট-এর জীবনে এই ভীতর-বাহির অন্তর্দ্বন্দ, পুরো ছবিটা একটু পরিষ্কার হওয়া দরকার।

ইংল্যান্ড এর ডারহাম শহরের ছেলে রবার্ট। বাবা, দুই কাকা, কাকিমা, খুড়তুতো ভাই বোন নিয়ে একান্নবর্তী পরিবার। বাবা ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন, রাস্তা বানাতেন...বাকি কাকারাও সরকারি চাকরি করতেন। ওয়্যার নদী যেখানে শেষ হয়, সেখানে ওদের ঘর ছিল... বাবা সরকারের খুব উচ্চ পদস্থ না হলেও সম্মানীয় কর্মী ছিলেন। সারা শহরের রাস্তা বানালেও নিজের ঘরের ভেতরের যে রাস্তাটা, যেটা স্ত্রী ও পূত্রের মন অবধি যায়, সেটা উনি বানাতে পারেননি কোনদিনও। নিজের কাজ নিয়ে থাকতেন, বাকি সময় রেগে থাকতেন। মা প্রয়োজন ছাড়া বাবার কাছে যেতেন না যতটা ও দেখেছিল।

এমনিতে ভাবুক প্রকৃতির ছেলে রবার্ট। শান্ত, সাম্য। ছবি আঁকতে খুব ভালবাসত। কবিতার ডায়েরি নিয়ে ওয়্যার নদীর ধারে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকত। ছোট থেকে চার্চে গিয়ে একটা জিনিসই চাইত। চার্চের গায়ে যে আঁকাগুলো আছে, বড় হয়ে আঁকবে কোন একদিন। স্কুল এর গন্ডী পেরিয়ে কলেজে ভালোই কাটছিল। ওর প্রিয় এক আর্টস্‌ এর টিচারের সাথে বসে বসে ইউরোপিয়ান পেন্টারদের জীবন নিয়ে আলোচনা করত, দারুণ লাগত। কিন্তু আস্তে আস্তে বাবা কাকারা বলাবলি করতে লাগল যে এভাবে তো হয় না, এরপর রবার্টকে কোন এক সাহেবের সুপারিশে সরকারী চাকরিতে ঢুকিয়ে দেওয়াই ভাল। কিন্তু সরকারী চাকরি মানে যে একেবারে ইন্ডিয়ায় ট্রান্সফার, সেটা কে জানত! কাকারা উচ্ছসিত, ইন্ডিয়ার ব্যাপারে তখন সবার খুব কৌতুহল। মা বিশেষ করে খুব উৎসাহ দেখাল, কারণ খুব ভাল কাজের লোক পাওয়া যায় যে! বাধ্য, দক্ষ। রাজার মত যত্ন করে ইত্যাদি। মাত্র তো কয়েক বছরের ব্যাপার... এই ক'বছর ভাল করে কাজ শিখে নিতে পারলে, বড় লাটের অধীনে থেকে, ওর সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। রবার্ট ভীষণ কষ্ট পেল, কিন্তু কাকাদের মুখের ওপর কথা বলতে ও কোনদিনই পারেনি। আর অভিমানে চুপ করে ও বোধহয় পরিবারের থেকে দুরেই চলে যেতে চাইল - নাওমির সাথে, ওর বান্ধবির সাথে। ডারহাম শহরেই বাজারে ওদের বাড়ি ছিল। ওর বাবার ছোট এক বেকারির দোকান ছিল। ওদের দোকানের পাশ দিয়ে গেলে কি সুন্দর গোলাপি, খয়েরী মিষ্টি গন্ধ বেরোত...রবার্ট বুঁদ হয়ে থাকত। যখন কলেজে পড়ত, ও তখন হাত খরচের পয়সা জমিয়ে কেক কিনতে যেত। নাওমির সাথে এটা সেটা কথা বলত। কখন যে নাওমির সাথে দেখা করাটা অভ্যেসে পালটে গেছিল ও বুঝতে পারেনি। নাওমিটা পুঁচকে মেয়ের মত দেখতে...বেঁটে... চোখ পিট পিট করে তাকায়। আর সারা গায়ে কেকের গন্ধ। আশ্চর্য । রবার্টের বাড়ির লোকের খুব একটা পছন্দ ছিল না। কাকারা গম্ভীর গলায় বলেছিল, 'মেয়েটির বাবাকে আমি চিনি, সজ্জন লোক...থাক্‌ ওরা যখন চাইছে'। দুঃখের সময়েও নাওমির সাথে সংসারের স্বপ্ন রবার্টকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। শুরু হল তোড়-জোড়। বাবা নির্লিপ্ত ছিলেন... বিবাহিত জীবন ওনাকে কোনদিনই উত্তেজিত করতে পারেনি খুব একটা। রবার্ট বিয়ে করে চলে এল ইন্ডিয়া, কলকাতায়।

হ্যারি এখন রবার্ট-এর মুখোমুখি। যেন এই বন্ধুকে ও চেনে না। রবার্ট ও তো কোন পরিষ্কার ব্যাখ্যা  দিতে পারেনি ওর পরিবারকে, বন্ধুদের। এ কি বোঝানো সম্ভব? চেতনা?

এই অবস্থা অতচ আসতই না যদি না ওই জটাধারী সাধুটা ...কি যেন নাম... শঙকরাচার্জ বাবার ওখানে নাওমি ওকে জোর করে না নিয়ে যেত। আসলে রবার্ট অফিসে বেরিয়ে গেলে নাওমির বিশেষ কিছু করার থাকত না। ওখানে থাকত বেকারি নিয়ে, আর এখানে সম্পূর্ন বেকার। মেড্‌স রাও যা আছে, ম্যাডাম বলতে অজ্ঞান। নাওমি কে ভাঙা ভাঙা বাংলা শিখিয়েছে, বড় মিষ্টি ভাষা এটা। একদিন রবার্ট ফিরে এসে দেখে ওরা নাওমিকে বড়সড় একটা খোঁপা বেঁধে দিয়েছে...তাই দেখে তো সে প্রায় হেসে খুন। 'হেড বিহাইন্ড ইওর হেড' - রবার্ট ওকে বলেছিল। এইসব নতুন ধরনের জীবন নিয়ে ওরা মেতেই ছিল। একদিন তাদের মধ্যেই একটা মেয়ে আছে, যার নাম শ্যামা, তার নামের মানে জানতে জানতে বেরিয়ে পড়ল কালিভক্ত কোন এক বাবার কথা। রবার্ট প্রথমে বেশ রাগ করেছিল। 'মানুষে বিশ্বাস করো, আপত্তি নেই... ধার্মিক জিনিষ নিয়ে পড়তে যেওনা'। নাওমির সহজ উত্তর, 'জানলেই কি বিশ্বাস করতে হবে নাকি?' অফিসেও অবশ্য জিজ্ঞেস করে দেখেছিল। কয়েকটা বাঙালি বাবু আছেন ওখানে, ওরা বলেছিল এই কালি দেবী নাকি বেশ প্রাচীন এক কনসেপ্ট। সুদুর রোম-এও এনার পুজো হত। খুব জাগ্রত মানা হত... পুজো হত রাতের অন্ধকারে... গুহার ভেতরে গোপন ভাবে পুজো করত সমাজের অ্যারিস্ট্রোক্যাট-রা শক্তির আরাধনা তারাই করে যারা ক্ষমতার মানে বোঝে। ইন্টারেসটিং লেগেছিল রিচার্ডের। এই অর্ধ-শিক্ষিতদের দেশেও শক্তির আরাধনা হয়?

একদিন নাওমি সেই শ্যামা আর কয়েকটা পাড়ার মেয়ের চাপাচাপিতে ওই বাবার কাছে গেল। সেদিন 'শক্তি'র মানেই বদলে গেল।

ছোটো থেকে নিজের কর্ম প্রিয় বাবাকে দেখে বড় হয়েছে নাওমিদেখেছে ঈশ্বর-এর প্রতি ভক্তি। মানুষের প্রতি ভালবাসা সেবা মানে সে বোঝে । কিন্তু এই মহারাজের কাছে সে প্রথম শুনল যোগ-এর কথা। না ব্যায়াম না, সে শুনেছিল, ইন্ডিয়ান তান্ত্রিকরা নাকি যোগ-ব্যায়াম করে অনেক মিরাকেল করতে পারে। সাপের বিষ খেতে পারে, মাটি থেকে দু হাত ওপরে শূন্যে ভেসে থাকতে পারে। কিন্তু অন্তর চেতনা লাভ, এক এর মধ্যে বাস করে যে একাত্মা ... যার শক্তি কণা বাস করছে আমাদেরই শরীরের প্রত্যেক কোষে...নাহ্‌! এ জিনিস সহজে মাথা থেকে বেরোবে না।

হ্যারি শুনল মন দিয়ে নাওমির অভিজ্ঞতার কথাবন্ধুর মন বোঝার চেষ্টা করল পুরো দমে। রবার্টের দিকে তাকিয়ে বলল, 'হ্যাঁ রবার্ট, মানুষের সেবা দিয়েই ঈশ্বর চেতনা হয়... সেটা তো নতুন কিছু নয়। আমরা তো শিখেছিলাম সেই সব, মনে আছে? স্কুলে বয়েজ স্কাউটে তুমি তো বেশ পপুলার ছিলে। একবার সেই রাস্তার এক কুকুরকে স্কুল কমপাউন্ডে ঢুকিয়ে তাকে জল খাইয়ে সুস্থ করেছিলে... বেশ বকা-ও খেতে হয়েছিল তোমাকে সেইদিন...'

রবার্ট একভাবে জানলার দিকে তাকিয়ে আছে। হ্যারির কথা ওর কানে ঢুকছে না। বিকেল হয়ে আসছে । নাওমি এখনো ফেরেনি। সারা দুপুর মেয়েটা যে কোথায় থাকে! বাইরে মায়াবী পড়ন্ত রোদ ...শীতকাল আসছে, নভেম্বর মাস এখন। এই সময়েই এই ব্ল্যাক গডেস্‌ এর নাকি পুজো হবে। তাই নাওমি খুব ইনভল্বড হয়ে পড়েছে। উফ এই কয়েক সপ্তাহ আগে শংকরচার্য বাবা যা বলেছেন ওকে, যেটা শুনে রবার্টের অদ্ভুত এক কিউরিওসিটি হয়েছে বাবার সম্পর্কে ... হ্যারি কে যা কোনদিনই বোঝানো যাবে না... 'অন্তরের সেবা , মানুষ কে না, নিজেকে সেবা... তাও কি, না সব কিছু ত্যাগ করে ওই ছেড়ে দেওয়া টুকুই যা কষ্টের... একবার করে ফেলতে পারলে, আনন্দ হি আনন্দ' বাবা যেন দু'হাত মাথার ওপর তুলে নাচছিল এটা বলতে বলতে' - নাওমি বলেছিল। নাওমির বিশ্বাসকে রবার্ট উড়িয়ে দিতে চায় নি।

নাওমি ফিরে অবধি বেশ প্রশান্তিতে ছিলওর মুখ দেখে বোঝা যায়। বেশী কথা বলল না। জিজ্ঞেস করাতে বলল, 'খুব ভাল লাগল। তুমি কিন্তু পরের দিন অবশ্যই যেও। বাবা বার বার করে বলেছেন।'

রবার্টের মনে হল নাওমি দিনে দিনে কিরকম শান্ত হয়ে যাচ্ছেজৈবিক ক্রীয়ার সাথে যার কোন মিল নেই কিন্তু। হ্যারি এই সব ব্যাপারে খুব প্র্যাগম্যাটিক। ও আনন্দ বোঝে আনন্দের উলটো 'ভালো না লাগা' বোঝে। দুঃখটা আলাদা। ওটা খুব স্ট্রং। কিন্তু শান্তি ঠিক বোঝে না। ওর মতে 'পিস্‌ ইজ অ্যান ইলিউশান'। সত্যিই তো। ভেবে দেখলে, ছাই কে ছাই পড়ে রইল। তুমি শুধু ওটার কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে, তার মধ্যে এক আধলা অবশিষ্ট পড়ে থাকা জিনিস তুলে ঘর সাজিয়ে নিলে। নাম কিনা, কি সুন্দর ঘর আমার! বেসিক্যালি, ইউ 'মেক পিস্‌' উইথ দ্য কেঅস। ব্লিসফুল অবলিভিয়ন। এইসব কথা বললে নাওমি আবার আজকাল রিঅ্যাক্ট করে।  মনের ভেতরের কেঅসটা নাকি ঠিক অন্যরকম। হোমিওস্ট্যাসিস, জার্নি, ডেস্টিনেশন অনেক কিছু বুঝিয়ে দিল। ও কিছুটা বুঝল, কিছুটা শুধু শুনল। নাওমি নাক কুঁচকে, হাত পা নেড়ে যখন বোঝায়, বেশ লাগে। সেটা কেক বানানোই হোক বা জীবনদর্শন, বেশ সুস্বাদু লাগে।
কিন্তু রবার্টের যেটা প্রিয়, হ্যারির কাছে অপ্র্যয়োজনীয় বিশেষ করে বৈষয়িক ব্যাপারটা যেখানে বিঘ্ন ঘটছে, যার বিহীত করতে সে এখানে এসেছে, সেখানে এইসব তাত্ত্বিক বা আত্মিক ব্যাপার বুঝতে সে সম্পূর্ণ নারাজ বরং আর্থিক ব্যাপারটাই...

এখানেও গোল পাকিয়েছিল নাওমি কলকাতায় এসে ও যে সুখেই আছে, সেটা মাসে অন্তত দু'টো চিঠি  পাঠিয়ে জানাত নিজের বাড়িতে একে নতুন দেশ, তার ওপর নতুন বিয়ে - ওর কাছ থেকে কুশল সংবাদ পেয়ে কিছুটা নিশ্চিন্তে থাকত নাওমি আর রবার্ট - দু'জনেরই বাড়ির লোক কারণ চিঠি লেখা, কুশল সংবাদ আদান-প্রদান করা, এইসব পারিবারিক-সামাজিক দায়িত্ব নাওমি সুন্দরভাবে পালন করার ফলে রবার্ট স্বচ্ছন্দে এগুলো এড়িয়ে যেতে পারত

কিন্তু নাওমি সরল মেয়ে বিবাহিত জীবনের শোবার ঘরের দরজা যে সবার কাছে খুলে দিতে নেই, সেটা ওর মাথায় নেই। ঘটা করে লিখে পাঠাল ওর 'বাবার' কাছে যাওয়া। নিয়ম করে ওখানে গিয়ে সময় কাটানো। কেমন ওদের কাজের লোক শ্যামা ওকে লাল টিপ আর শাড়ি পরিয়ে একেবারে বাঙালি বৌ সাজিয়ে তুলেছিল একদিন শনিবার এবং ধুপ-ধুনোয় মগ্ন ঘোরগ্রস্থ বাবা ওকে দেখে 'মা, মা' করে চেঁচিয়ে উঠেছিল এবং ওকে আগামী দিনের পুজোর সব দায়িত্ত্ব নিতে বলেছেন

কিন্তু এই খবর ভাল নজরে গ্রহণ হল না ওদের পরিবারে। 'স্নেক চার্মারদের' দেশে এই সব কীর্তিকলাপ ওরা বোঝে না, বরং একটু ভয়ই পায়। কি বলতে কি বশ করে নেবে। তারপর এই খবর যখন রবার্টের বাবার মুখ থেকে ওদের সরকারী অফিসারদের কানে গেল, তখন সমস্যা হল বৈকি।

ইষ্ট ইন্ডিয়া কম্পানির সাথে ব্রিটিশরা যখন কলকাতায় ঢুকেছিল, প্রথমে এসেই যেটা চোখে পড়েছিল, এ শহরটা পরিষ্কার। ইন্ডিয়ার অন্যান্য শহরের মত রাস্তাঘাট অত সরু নয়। ঘর বাড়ি বেশ ছবির মত। সব চেয়ে বড় কথা শহরটায় কালচার আছে। এখানে এক শ্রেনীর মানুষরা তো রীতিমত ওদের মাথায় তুলে রাখত। ব্রিটিশদের সাহিত্য, আদব-কায়দা, খাওয়া দাওয়া থেকে শুরু করে জামাকাপড়, এখানে খুবই আদৃত। বাধ সেধেছিল আর এক শ্রেণীর একটু কম শিক্ষিত মানুষরা। ওরা ভগবান মানত। বিশেষ করে এই সব অবৈজ্ঞানিক অবাস্তব জিনিসে অন্ধ বিশ্বাস। এবং এই বিশ্বাস এতই জোরালো যে এতে বাধা পড়লে, এরা অনায়াসে সেই সিস্টেম বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে চলে যেতে পারে। এখন একটা জাতকে যখন তুমি ভাঙচোই, তখন তাকে মেরুদন্ড থেকে ভেঙে ফেলাই ইংরেজ সরকারের নীতি। মোট কথা এই সব লোকভক্তি, লোকশক্তি, ছোটলাট বা মেজলাট কেউই পছন্দ করত না। এবং এই সঙ্ঘে যোগ দেবে গোরাদেরই অফিসার বা তার বৌ, এ কখনোই মানা যায় না। মেজলাটের ওখান থেকে নোটিস এসেছিল - হয় রবার্টরা এসব থেকে সরে যাবে, নাহলে ওদের সরিয়ে দেওয়া হবে, যেখান থেকে ওরা এসেছিল, সেখানে।

হ্যারি চেয়েছিল নাওমির সাথে নিজে কথা বলতে কিন্তু রবার্ট ওকে বারণই করেছিল। কারণ এতে নাওমিকে অশ্রদ্ধা করা হবে, ওর বিশ্বাসকেও। ও নিজে যেতে চায় একবার বাবার কাছে, বুঝতে চায়। বাবা ওকে বোকা বানানোর চেষ্টা করছে কিনা, ভাওতা দিচ্ছে কিনা। কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়। এই যে ওর মাথা থেকে নোটিস এল, ওদের বিশ্বাস-ভাবনাকে কন্ট্রল করার যে চেষ্টা, এটা কেমন কথা? কেন রবার্টকে বারবার 'সবাইয়ের' ঠিক-বেঠিকের ডেফিনিশান অনুযায়ী... যাই হোক। এই সব সময়ে ওর প্রিয় রঙগুলো ওকে খুব টানে। আর 'এগুলো' ভীষণ ধূসর মনে হয়। নাওমির এদিকে খুব আনন্দ, যেন যুদ্ধে জিতে বসে আছে। রবার্টকে নিয়ে বাবার কাছে যাবে, ওর আনন্দ দেখে কে।

রবার্টদের বাড়ির সামনের রাস্তাটা বেশ... সেদিন সারাদিন একটু একটু বৃষ্টি পড়ছিল। আকাশে কালো সিয়ামিশ বেড়ালের মত মেঘ...লেজ গুটিয়ে সরে সরে যাচ্ছে...নাওমির সাথে রবার্ট বাবার ঠেকে গিয়ে পৌঁছল।

ধুনো, ধুপ, মাটি, কিছু একটা তেল আর মানুষ মেশানো ভীষণ ভারতীয় একটা গন্ধ। ওদের দেশে চার্চে এরকম গন্ধ না। ঘরটায় বেশী লোক নেই। ঘরের মাঝখানে লাল কাপড়ে মোড়া কালো একটা মূর্তি। বাবা তার সামনে হাঁটু মুড়ে বাচ্চা ছেলের মত বসে আছে। যেন মূর্তিটার সাথে মনে মনে কথা বলছে। আশে পাশে কয়েকটা পুরুষ মহিলা ওনাকে দেখছে। নাওমি চুপ করে বাবার পাশে গিয়ে বসে পড়ল। রবার্টকে ইশারায় বসতে বলল। এই দেশে এসে রবার্টের এই এক মুশকিল হয়েছে। এরা কথায় কথায় মাটিতে বসে পড়ে। কোট-প্যান্ট পরা রবার্টের বেশ অসুবিধাই হল মাটিতে বসতেবাবা আস্তে আস্তে ওর দিকে তাকাল। অমায়িক, স্নিগ্ধ, সরল - না, রবার্টের এক মুহূর্তের মধ্যে ওই সিয়ামিশ বেড়ালের মত সন্দেহের দলাটা মনের মধ্যে থেকে পালিয়ে গেল। বাবা ইংরাজি জানে না। কিন্তু প্রবল উত্তেজিতভাবে ইশারায় ওকে কি সব বোঝাতে শুরু করল। ওকে পা ধরে থাই-এর ওপর পায়ের চেটো তুলে বসতে বলল। বাবা ওর পায়ে হাত দিচ্ছে...কি লজ্জার ব্যাপার! বাবার ওদিকে হুঁশ নেই। উনি কি ওকে যোগ-ধ্যান শেখাতে বসলেন নাকি? মোট কথা, জেনে বুঝেই হোক বা হঠাৎ ধাক্কা খেয়ে, প্রথম জলে পড়লে একটু অস্বস্তি হয় বৈকি কিন্তু বাবা যখন ওর চোখের মাঝখানে হাত রেখে, ওকে কি ভাবে জানি অন্তরের দিকে দৃষ্টি ফেরাতে বলল, রবার্ট স্পষ্টই সেটা বোধ করতে পারল খুব আস্তে অথচ দৃঢ়ভাবে বাবার 'অউম্‌' ধ্বনি, মাঝে মাঝে 'ভেতরে আরো ভেতরে' একটু একটু বাঙলা শিখেছিল রবার্টঅধিকাংশ সাহেবের মতই বলতে পারত না, বুঝতে পারত। তাই কানের কাছে বাবার উচ্ছসিত গলায় কথাগুলো বুঝতে অসুবিধে হল না - 'ছেড়ে দেওয়া টুকুই যা কষ্টের... আনন্দ হি আনন্দ'রবার্টের মনে হাবিজাবি অনেক কিছু, একের পর এক অন্ধকার ঢেউ অদ্ভুত শান্ত হয়ে যাচ্ছিল কি সব কিছু? ওদের ওয়্যার নদী, ওর প্রিয় রংগুলো বেশ কিছুক্ষণ পর রবার্ট আস্তে আস্তে চোখ খুলল নাওমি কিন্তু এতক্ষণ কিচ্ছু বলেনি ও বাকি মহিলাদের সাথে কিসব কথা বলছিল বাবা আস্তে আস্তে রবার্টের মাথায় সস্নেহে হাত রাখল... সেই মোহময় হাসি। রবার্ট আর নাওমি ফিরে এল।

এরকম শান্ত উপলব্ধি হবে রবার্ট ভাবেনি মোটেও। উত্তর না, বরং কিছু প্রশ্ন স্পষ্ট হল রবার্টের কাছেওর ভবিষ্যৎ, ওর কাজ, সত্যিই কি চেয়েছিল এই ক্ষমতা-শ্রেনীর দ্বন্দ? হোক না অশিক্ষিত বাবার সঙ্গ, নাওমি যদি এর মধ্যে থেকে একটু প্রশান্তি লাভ করে, তাতে ক্ষতি কি? হ্যারিকে ও বুঝিয়ে বলল। ওর মতামত। হ্যারি অনেক কিছুই চাপিয়ে দিতে চাইছিল ওর ওপর যেমন বরাবর করত। কিন্তু এবার দেখল রবার্টের স্বর একটু আলাদা। একটু বেশী দৃঢ় কি? ও দেশে ফিরে গেল সব শুনে

নাওমি বুঝল। রবার্ট ওকে আশ্বস্ত করল যে সাহেবের চোখ রাঙানিকে ওর আমল দেওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। ও পুজোর দায়িত্ব নিক। বরং রবার্ট চেষ্টা করবে যতটা সম্ভব ওর সাথে থাকার। নাওমি এক অন্য চোখে দেখল রবার্টকে। এক পারস্পরিক অ্যাডমিরেশন, কি ভীষণ সুন্দর অনুভব একটানাওমিকে বলল যে ফেরত যদি যেতেই হয়, ও আর এই চাকরি করবে না। দেশে ফিরে ওয়্যার নদীর পিছনে কোথাও একটা ঘর ভাড়া নেবে। ও ছবি আঁকবে, নাওমি কেক বানাবে। সেখান থেকে সানসেট দেখতে পাওয়া যাবে... একদম অন্য রকম রঙ। নাওমি নাক কুঁচকে সমর্থন করল। যে দরজা দিয়ে অনেক দূর দেখতে পাচ্ছে এখন রবার্ট, সেটা ভেতরের দিকে খুলছে। মনের ভেতরে। ফিরবে, ফিরতে ওকে হবেই। বাড়ি নয়, অন্দরে।








No comments:

Post a Comment

একনজরে

সম্পাদকীয়

একটি বিষয়ে আমাদের সকলের একমত হতেই হবে ভিন্ন মতের ও ভিন্ন রুচির বহুস্তরকে সম্মান জানিয়েও, যে, আমরা এই মুহূর্তে প্রায়শ্চিত্ত করছি। মানুষ...

বেশিবার পড়া হয়েছে যেগুলি