Monday, April 13, 2020

গল্প-- গোল্ডফিশ ও একটি জীবন্তজীবাশ্ম/ অরিজিৎ চক্রবর্তী





অনিম্যানিয়া ! সহজ বাংলায় এই রোগ হলো তীব্র শপিং এর প্রতি আকর্ষণ ! ব্যাপারটা শুনতে যতটা সহজ বা হাস্যকর লাগছে ভুক্তভোগীর জন্য তার চেয়ে অনেক বেশী কষ্টকর ! শপিং এর আকাঙ্ক্ষাটা তখনই রোগ হিসেবে পরিগণিত হয়, যখন বারবার শপিং করাটা বাধ্যতামূলক হয়ে যায় ! খুবই ইন্টারেষ্টিং ব্যাপার হচ্ছে রুগী শপিং চলাকালীন সময়ে তার যাবতীয় কষ্ট ভুলে থাকে এবং প্রফুল্ল থাকে ! যখনই বাড়ি ফিরে যায় তার ব্যাক্তিগত জীবনের নানা সমস্যার কথা আবার মনে হয় এবং সে তার কিছুক্ষণ আগের করা অপচয়ের জন্য অনুশোচনায় ভোগে ! কিছু কিছু রোগীর ক্ষেত্রে দেখা যায় তারা এই ধরণের শপিং এর জিনিসপত্র নষ্ট করে ফেলে একেবারেই যাতে পরের বার না যায় ! কিন্তু রোগের সংজ্ঞাই বলে শপিং তাকে করতেই হবে ! এই রোগের কারণে সে সামাজিক ভাবে , আর্থিকভাবে মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় ! অনেকেই ড্রাগ এডিক্টেক হয়ে পড়েন ! রোগটির সূচনা স্বাভাবিকভাবেই শপিং এর প্রতি আকর্ষণ থেকে !

মনোবিদ নীলাঞ্জনা দাশগুপ্ত গতকাল রাতে ফেসবুকে এটা পোস্ট করেছেন। তোয়া বার কয়েক পড়েছে। বন্ধুদের শেয়ার করেছে। আর নিজেকে নিয়ে ভেবেছে। সেকি অনিম্যানিয়ার শিকার। আজকেও ঋপণের ফিরতে দেরি হবে। অফিসে কাজের খুব চাপ। মার্চ মাস বলে কথা। চিন্তাটা কিছুতেই মাথা থেকে বার করতে পারছে না। সম্মোহ ফোন করেছিল। কিন্তু খুব একটা সময় নিয়ে কথা বলা হয়নি। ইচ্ছে করছিল না। একবার ভেবেও ছিল বিষয়টা সম্মোহ কে বলবে। বলেনি। কারণ তোয়া ভালো করেই জানে সম্মোহ কে বলা মানে হাসির খোরাক হওয়া। ' দূর উদোর চিন্তা বুদোয় ফেল।' মুহুর্তের জন্য ভেবে নেয় তোয়া। আকাশে মেঘ জমছে। ঝড় বৃষ্টি হতে পারে। তোয়া ব্যালকনিতে মেলে রাখা জামাকাপড় গুলো তুলে নেয়। আজ একবার সিটি সেন্টারে যাবার ইচ্ছে ছিল। সেখান থেকে বিগবাজার হয়ে বাড়ি ফেরা। ইন্দু বলেছিল একসাথে যাবে। কিন্তু মনটা কেমন যেন করছে। কিছু ভালো লাগছে না।

মোবাইল বেজে উঠল। ইন্দু ফোন করেছে। ' শোনো সেক্সী তোমাকে যেতেই হবে। কোনো কথা শুনবো না। তুমি না গেলে রকের ছেলে গুলো কার দিকে তাকাবে! মিঙ্কু গুলো যা বানিয়ে ছিস। মাইরি ! আমারই হিংসে হয়।' --- খিলখিল হাসির শব্দ। তোয়া হেসে ফেলে। ইন্দুর মুখ বরাবরই এরকম। সেই ক্লাস ওয়ান থেকে বন্ধুত্ব। তোয়া তৈরি হতে থাকে। মনটা উড়তে চায়। আকাশে মেঘ করলেও মেঘ ঠিক জমে না। এলোমেলো হাওয়া দিতে থাকে।

                                 ( ২ )

ড্রয়িং রুমের আলো নেভাতে যাওয়ার আগে প্রতিদিন একবার গোল্ডফিশ দুটো কে দেখে নেয় তোয়া। চোখের ভেতর মাছগুলো যেন খেলা করে। আর এই আলো নেভাতে যাওয়ার কাজটা অদ্ভূত ভাবে ওই করার জন্য তৎপর থাকে। তারপর বেডরুমের দিকে পা বাড়ায়। মাছ গুলো চোখের ভেতর ঘুরতে থাকে। ঋপণ বেডস্যুইচে হাত রাখে। অন্ধকার জেগে ওঠে। ঋপণ সারাদিনের খাটাখাটনির পর কিছুটা অভ্যাস বসে নিজেকে জাহির করতে চায়। কয়েক মিনিটের দুলুনিতে নেতিয়ে পড়ে। খানিক বাদেই নাক ডাকার শব্দে চারপাশ শান্ত হয়। তোয়া হোয়াটসঅ্যাপ খোলে। সম্মোহ অনলাইন আছে। তোয়া লেখে--

--- কি করছিস তুই?

--- তোর কথাই ভাবছিলাম।

---- কলকাতায় ফিরছিস কবে?

----- আগামী সপ্তাহে। কাজ শেষ হয়নি।

---- কি এত কাজ করছিস?

----- সেকি আর তুমি বুঝবে? বড়লোকের বউ! ঘুরছো বেড়াচ্ছো, আর এই গরমে আমার পেছন ফাটছে। আজকে কি তুই খুব ব্যস্ত ছিলি?

---- তেমন কিছু না। মনটা ভালো ছিল না রে।

---- কি হলো আবার? ঝগড়া!

---- সে তোকে বলা যাবে না। হাসবি। প্যাক দিবি।

----- আরে বল না। প্যাক দেব না। সত্যি বলছি। প্রমিস।

---- সত্যি! সত্যি বলছিস তুই। প্রমিস !

----- মা কালী! বল না।

---- অনিম্যানিয়া। আমার অনিম্যানিয়া হয়েছে।

---- সেটা কি জিনিস। খায় না মাথায় দেয়!

----- মানসিক রোগ। শপিং করার রোগ!

----- মাল টেনেছিস! বরের সাথে। সহ্য হয় না খাস কেন?

----- দেখলি তো, তুই কেমন অসভ্য। এ জন্য বলতে চাইনি।

------ ঘুমিয়ে পড়। কাল ফোন করিস।

সম্মোহ ল্যাপটপে মন দেয়। একটা পেজেন্টেশন রেডি করতে হবে। পুরুলিয়ার ভালডুংড়ি পাহাড়ে নরেন হাঁসদার সার্বিক কাজকর্ম নিয়ে। নরেন এখানে আদিবাসী ছেলেমেয়েদের নিয়ে একটা স্কুল চালায়। ঝুমুরগান আর সাঁওতাল গান গেয়ে যা রোজগার করে তা দিয়েই নরেন গড়েছে এই স্কুল। অনাথ স্কুল ছুট ছেলেমেয়েদের নিয়ে নরেনের এই আশ্চর্য স্বপ্ন।

                             ( ৩ )

প্রায় এক মাস কথা হয়না। মাঝেমধ্যে ওর ফেসবুক প্রোফাইলে তোয়া ঢুকে পড়ে। ইদানিং যেন অনেক বেশি বেশি ছবি পোস্টাচ্ছে নিজের। কদাচিৎ কাজ কর্মের আপডেট দেয়। আর ওর নিজস্ব ব্লগে নিয়মিত লেখে। লেখার হাতটা বরাবরই সম্মোহের ভালো। গতকাল রাতের পাল্টে দেওয়া প্রোফাইল পিকটা দেখে তোয়ার গা জ্বলছে বড্ড। লাল টি-শার্ট আর ব্লু সানগ্লাসে সম্মোহ যেন সবাই কে সম্মোহিত করছে! ছবির নিচে বেশির ভাগ সুন্দরীদের‌ কমেন্টস্। বিন্দাস, ঝিঙ্কুরে, এককাপ চা এ তোমাকে চাই, দেখা হোক ইত্যাদি ইত্যাদি। আর সম্মোহ কখনো 'স্মাইলি' কখনো 'লভ' চিহ্নে কখনো 'প্রাণিত হলাম' লিখে ওর সার্বিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তোয়া এসব দেখে ততধিক ক্ষেপে যাচ্ছে। কোনো ভাবেই সম্মোহ কে ভুলতে পারছেন না। সারাদিন যত ব্যস্তই থাকুক ঠিক শুয়ে যাবার আগে ও যখন প্রতিদিনের মতো ড্রয়িং রুমের আলো নেভাতে যায়, তোয়ার মনে হয় অ্যাকুরিয়ামের গোল্ডফিশ দুটো ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে অনেক হয়েছে এবার মিটমাট করে নাও। তোয়া নিজেই নিজের কাছে আশ্চর্য হয়় ঠিক এই সময় সারাদিনের সমস্ত ব্যস্ততাকে উপেক্ষা করে সম্মোহ ঠিক অ্যাকুরিয়ামের গোল্ডফিশ দুটোর অনুসারী হয়ে তোয়ার কাছে ধরা দেয়! আর তোয়া আলো নিভিয়ে বেডরুমের দিকে এগিয়ে যায়। তোয়ার চোখের ভেতরে সম্মোহ নামের গোল্ডফিশটা ঘাই মারে! ঋপণ নাইটির হুক খুলে বুকের উষ্ণতা চটকায়। শিহরণ জাগে! মায়াবী আলোর অ্যাকুরিয়ামে তোয়া দক্ষ সাঁতারুর মতন সাঁতার কাটতে থাকে। ' তুই কর ভালো করে কর!" তোয়া অস্ফূটে বলে ফেলে। মুহূর্তে সম্বিৎ ফিরে পায়! আর কিছু ইচ্ছে করে না। ভয় বাসা বাঁধে। ঋপণ কে তোয়া কখনো 'তুই' সম্বোধন করে নি। ঋপণ কিছু ভাবলো না তো! কিছু কি অনুমান করল ও। সারারাত এই অসমাপ্ত ঢেউ দোলায় তোয়া কে। একসময় ঘুমিয়ে পড়ে।

সকালে ঋপণের ডাকে ঘুম ভাঙে, " উঠে পড়ো রাজকুমারী, তোমার জন্য চা তৈরি! " তোয়া একমুখ হাসি নিয়ে ঘুম চোখে ঋপণের দিকে তাকায়। উঠে বসে ঋপণের গা ঘেঁষে। চা খায় দুজনে। ঋপণ কে বেশ খুশি খুশি লাগে। তোয়ার ভয় হয়! যদি গতরাতের কথা তোলে! বিশেষ করে 'তুই'  বলাটা।

ঋপণ আর তোয়ার মধ্যে একটা ব্যবহারিক সম্পর্ক আছে। ভুল হলো, বরং বলা ভালো প্রতিটি দাম্পত্যের এই ব্যবহারিক চাওয়া পাওয়া মারপ্যাঁচ। ঋপণ মেধাবী ভদ্র উচ্চপদস্থ চাকুরে। অর্থের অভাব নেই। তোয়ার সাথে দেখেশুনে সম্মন্ধ করে বিয়ে। তাও চব্বিশ বছর হতে চলল। একমাত্র মেয়ে ব্যাঙ্গালোরে বায়োটেকনোলজি পড়ছে। তোয়ার মতো মেয়ে ঐশী যথেষ্ট সুন্দরী। ঋপণ চুয়ান্ন ছূঁই ছুঁই। চুলে পাক ধরেছে সামান্য। তোয়া এখন চুয়াল্লিশ। শরীরে বয়সের ছাপ নেই বললেই চলে। মা মেয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে তোয়া কে ঐশীর দিদি মনে করে যে কেউ। তোয়াও খুব মেনটেইন্ড।

বুলির মা রান্না চাপিয়েছে। ঋপণের অফিসে যাওয়ার তাড়া। তোয়ার আলসেমি কাটে না। ঋপণের জামাকাপড় বের করে দেয়। তারপর টিফিন গুছিয়ে দেয় লাঞ্চবক্সে। আসলে ঋপণ বাইরের খাবার খেতে চায় না। তোয়া যেহেতু রেস্টুরেন্টে খেতে পছন্দ করে তাই কখনো সখনো ওকে নিয়ে যায়। অফিসের গাড়ি এসে গেছে। যথারীতি ঋপণ প্রতিদিনের মতো তোয়ার দিকে একটা মিষ্টি হাসি ছুঁড়ে দিয়ে গাড়িতে উঠে বসে।

তোয়া ব্যালকনি থেকে হাত নেড়ে ড্রয়িং রুমের সোফাতে বসে পড়ে। সকালের কাগজে চোখ বোলাতে বোলাতে সামান্য ব্রেকফাস্ট সেরে নেয়। অ্যাকুরিয়ামের গোল্ডফিশ দুটোর দিকে চোখ চলে যায়। ওরা কাঁচের বাক্সের হলুদ আলো আর কৃত্রিম ঝর্ণার নিচে অনন্ত কাল ধরে ছোটাছুটি করছে। কোনো ক্লান্তি নেই ক্লেদ নেই। তবে কি ব্যাবহারিক অন্তর্ঘাত আছে? প্রশ্ন করে নিজেকে। উত্তর পায় না। অন্যদিন হলে সম্মোহের ফোন আসতো। এখন আর আসবে না। তোয়া জানে।

চৈত্র মাসের দুপুরেও মনের কোকিল ডাক দেয়। তোয়ার মধ্যে অস্থিরতার জলরঙ। স্নান সেরে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। শরীরে জড়ানো বাথরব খুলে ফেলে। নিজেকে অবাক হয়ে দেখে! মনে হয় সারা শরীর জুড়ে একটা রহস্যময় অ্যাকুরিয়ামের স্পন্দন! লতা গুল্ম গোল্ডফিশ নুড়ি পাথর কত কি! ঘরময় জলরাশি! ঢেউ! আর সম্মোহ খানিক বাদে ডুবে যাওয়া সেই ডুবন্ত জাহাজের ক্যাপ্টেন কত দুপুর যে কেটেছে ওদের। কত কথা। কত ব্যথা। হাসি। আনন্দ। গসিপ। আজ  খা খা শূন্যতা।

একটু বাদেই রশ্মি ফোন করবে। প্রতিদিন করে। তোয়ার সাথে খানিকটা সময় কাটায়। রশ্মি কনফারেন্স কলে নীরা কে নেয়। এরা সবাই তোয়ার কলেজ জীবনের বন্ধু। তাই কথার অজুহাত লাগে না। প্রতিদিন কথার ভেতর সম্মোহ এসে পড়ে। রশ্মি বোঝায়। নীরা বোঝায়। বলে ঝগড়াটা মিটিয়ে নিতে । তোয়া গোঁ ধরে থাকে। বলে, না। ওর অত দেমাক কিসের! ও তো ফোন করতে পারতো একবার! এখন দেখ গিয়ে অন্য কারো সঙ্গে ফস্টিনস্টি করছে! জানিস রুমা কি বলেছে? ওকে সম্মোহ বিছানায় ডেকেছে। বলেছে শুলেই ওর গানের অ্যালবামটা বের করে দেবে। রশ্মি বিশ্বাস করে না। নীরাও সায় দেয়। বলে ধূর যত উল্টোপাল্টা কথা। রুমাকে বলিস আয়নায় নিজেকে একবার দেখতে। সম্মোহ একথা যদি বলেও থাকে ওতো নিশ্চয়ই শুয়ে পড়েনি। তাছাড়া তোকে একথা জানিয়ে নিজেকে কি প্রতিপন্ন করতে চাইছে রুমা! ও তোদের সম্পর্কটা জানে। তোদের ঝগড়ার কথা জানে। এটা বলা মানে বন্ধুত্বের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটানোর অভিসন্ধি।তোয়া ওদের কথায় শান্ত হয়। প্রসঙ্গ পাল্টায়।

---তোরা তাহলে কবে আসছিস? শান্তিনিকেতন যাওয়াটা কি হচ্ছে?

--- 'মহাপুরুষের সাথে আগে ঝগড়া মেটাও তারপর বেড়ানো।' রশ্মি বলে দেয়। নীরা সহমত হয়ে বলে, 'একদম ঠিক বলেছিস রশ্মি।'
তোয়া রেগে বলে ওঠে, 'খুব দরদ দেখছি তোদের মহাপুরুষের প্রতি।' খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে ওরা দুজনে।

                            ( ৪ )

আজ বিকেলে ঋপণের সাথে বেরোতে হবে। ডাক্তার বুক করা আছে। পায়ের ব্যথাটা বেড়েছে তোয়ার। কদিন ধরে কষ্ট পাচ্ছে। ঋপণ অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরবে। তারপর ওরা অর্থোপেডিক ডঃ বসুর ক্লিনিকে যাবে। মা ফোন করেছিল। খোঁজ খবর নিচ্ছিল তোয়ার। ঘড়িতে চারটে তিরিশ। হাতে খুব একটা সময় নেই। ঋপণ পাঁচটা নাগাদ এসে পড়বে। তোয়া তাই তৈরি হতে থাকে। তোয়া আজ ঠিক করেছে ডাক্তার দেখানোর পর অযথা শপিং করে পয়সা নষ্ট করবে না। স্কাই কালারের সিফনের শাড়িটা ওকে মানিয়েছে বেশ। আয়নার দিকে তাকাতে তাকাতে তোয়ার এটা মনে হয়। সঙ্গে স্কাই ব্লু কালারের স্লিভলেস আর পুঁথির অরন্যামেন্টস। ডোর বেল বেজে ওঠে। তোয়া দরজা খুলে দেয়। ঋপণ হাতমুখ ধুয়ে জামাকাপড় পাল্টে নেয়। বেরিয়ে পড়ে ওরা দুজন।

ডঃ বসু তোয়ার বাঁ পা  নিরিক্ষা করতে করতে শঙ্কা প্রকাশ করেন। " ভালো ঠেকছে না ম্যাডাম, কয়েকটা টেস্ট দিচ্ছি। সঙ্গে কিছু ওষুধ। আগামী সপ্তাহে টেস্ট গুলো করিয়ে দেখা করুন'!

তোয়ার মন খারাপ হয়ে যায়। সামনে দোল। পাড়ায় দোলের বড় অনুষ্ঠান। খাওয়া দাওয়া। হৈহৈ। এবার আর থাকা হলো না ওর। ঋপণ তোয়ার হাত ধরে। ' এত চিন্তার কিছু নেই। কলকাতায় আরো নামি ডাক্তারের কাছে যাব। সব ঠিক হয়ে যাবে।

ঋপণ বিগবাজারের সামনের পার্কিং এ গাড়িটা পার্ক করে। তোয়া একটু বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে, ' এখানে কেন আবার? কিছু কেনার নেই আমার।' ঋপণ অবাক হয়! 'হঠাৎ! টেনশন করছো কেন? চলো চলো, একটু না হয় ঘুরে নীচের আইসক্রিম পার্লারে আইসক্রিম খেয়েই চলে আসবো।'

তোয়া গাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসে। ঋপণ হাত ধরে তোয়া কে নিয়ে যায়।

' এই দেখ দু লিটার কোক নিলে আরেকটা ফ্রি। নিই বলো? ' --- তোয়া সায় দেয়। তারপর একে একে আরো কিছু কেনা হতে থাকে। তোয়ার পছন্দের সাবান, শ্যাম্পু, ডিও, পাউডার, কুকিস, ব্রেড এরকম আরো বেশ কিছু সংসারের টুকিটাকি। তোয়া কে খানিকটা খুশি খুশি দেখায়। বিল মিটিয়ে আইসক্রিম পার্লারে বসে দুজনে। বব ডিলানের গান বাজছে। চারপাশে সবাই যে যার মতো করে আনন্দ খুঁজে নিচ্ছে।
অথচ তোয়ার মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে। পা নিয়ে ভুগতে হবে এবার। মাঝে অনেকটাই সুস্থ ছিল। রোগটা ঘুরে এলো আবার। না কিছুই ভালো লাগছে না। অর্ধেক আইসক্রিম খেয়ে তোয়া ঋপণ কে খেয়ে নিতে বলে। যেন কোন কিছুতেই তেমন আগ্ৰহ নেই। বাড়ি ফেরে ওরা দুজনে।

রাতে কিছুতেই ঘুম আসে না। ব্যথা! পা থেকে ব্যথাটা ছড়িয়ে পড়ে। পেনকিলারেও কাজ হয় না। ঋপণ সারারাত জেগে থাকে। তোয়ার পায়ে হাত বুলিয়ে দেয়। গরম সেঁক দেয়। চোখ থেকে জল বেরিয়ে আসে তোয়ার। ' খুব কষ্ট হচ্ছে! ' ভেবে ঋপণ আরও অস্থির হয়ে পড়ে। মনে মনে ঠিক করে নেয় আগামীকাল কলকাতায় যাবে তোয়া কে নিয়ে। টেস্ট গুলো ওখান থেকেই করাবে। প্রয়োজনে দুদিন থেকে নামী কোনো ডাক্তারের কাছে দেখিয়ে নেবে তোয়াকে।

                              ( ৫ )

প্রতিটি সম্পর্কের বাঁকে আত্মহত্যা লেখা থাকে। আমরা সবাই মিউজিক্যাল চেয়ারের মতো এই কোমল আত্মহত্যায় অংশ নিই। আর নিই বলেই জীবন এত বৈচিত্র্যময় ও সুন্দর হয়।

সকাল বেলায় গাড়ি হুহু করে কলকাতার পথে এগিয়ে যাচ্ছে। বুবাই গাড়ি চালাচ্ছে। পেছনের সিটে ঋপণ আর তোয়া। তোয়ার মাথাটা ঋপণের কাঁধে যেন আশ্রয়ের সাধ নিচ্ছে! ঋপণ মুহূর্তটাকে একাত্ম হয়ে অনুভব করছে। চোখের সামনে ভেসে উঠছে সম্মোহের হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো ম্যাসেজগুলো। নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছে ঋপণের। অসহায় মনে হচ্ছে। না, তোয়া কে কিছু জানায়নি! জানাবেও না কোনোদিন। শুধু তোয়াকে পুরোপুরি সুস্থ করে বাড়ি ফিরতে হবে। তোয়াকে সময় দিতে হবে। তোয়ার উপর ঋপণের রাগ হয়েছিল প্রথমে। ঘৃণা হয়নি এমনটাও নয়। কিন্তু এখন আর হচ্ছে না। কারণ আত্মহত্যা! ঋপণকে আজ আত্মহত্যা করতে হবে। কোমল আত্মহত্যা! রিরংসা থাকবে না। কেবল প্রেমের প্রশ্রয় থাকবে।

তোয়া কি কখনো আত্মহত্যা করেছে? ঋপণের মনে প্রশ্ন উঁকি দেয়! এবং নিজের উত্তর খুঁজে নেয়। অবশ্যই করেছে। অজস্রবার করেছে। বিয়ের পর ঋপণ হানিমুনে গেছে মাকে সঙ্গে নিয়ে। তোয়া তার বসন্তের আচরণে যতটা রক্তিম হয়ে উঠেছিল, ঋপণ সেই মর্যাদা দিতে পারেনি। দার্জিলিং এর ম্যালে দাঁড়িয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে দেখতে কখনো তোয়ার হাতে নিবিড় ভাবে হাত রাখেনি। তোয়ার আবদারে রেড ওয়াইন কিনে আনেনি। শুধু বলেছে , ' মা আছে আমাদের সঙ্গে , ছেলেমানুষী বন্ধ করো।' তোয়া ফুঁপিয়ে কেঁদেছে। এও কি কম আত্মহত্যা! এরকম আরো বহু ঘটনার ঘনঘটা ওদের সম্পর্কে এসেছে। তোয়া গানের থার্ড ইয়ারের পরীক্ষা দিল না। খুব গান ভালোবাসতো! ঐশী তখন পেটে। ফলে আর হলো না। গানটা জীবন থেকে হারিয়ে গেল। ঋপণ অনুভব করে, তোয়াও হয়তো হারিয়ে যাবে। কিন্তু এটাই শেষ সুযোগ। ওকে সুস্থ করে এবার নিশ্চিত তোয়ার পছন্দের কোনো জায়গায় বেড়াতে যাবে দুজনে।

হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ ঢোকে। ঋপণ কোনো কৌতূহল অনুভব করে না। শুধু তোয়ার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে জীবন্ত জীবাশ্মের সন্ধান করতে চায়!

1 comment:


  1. "প্রতিটি সম্পর্কের বাঁকে আত্মহত্যা লেখা থাকে। আমরা সবাই মিউজিক্যাল চেয়ারের মতো এই কোমল আত্মহত্যায় অংশ নিই। আর নিই বলেই জীবন এত বৈচিত্র্যময় ও সুন্দর হয়।" অসাধারণ স্যার !

    ReplyDelete

একনজরে

সম্পাদকীয়

একটি বিষয়ে আমাদের সকলের একমত হতেই হবে ভিন্ন মতের ও ভিন্ন রুচির বহুস্তরকে সম্মান জানিয়েও, যে, আমরা এই মুহূর্তে প্রায়শ্চিত্ত করছি। মানুষ...

বেশিবার পড়া হয়েছে যেগুলি