Sunday, April 12, 2020

নিবন্ধ অক্ষর-কাশ্মীর ঃ আগা শাহিদ আলি’র শব্দ-তসবির - প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়






 সর্বপ্রথমে দিও আমায় নিজস্ব ইতিহাসের বোধ...  
ভিন জাতের ফুলের খোঁজে
কিশোরী মেয়েদের ইতিউতি ঘুরে বেড়ানো
আর অচেনা কারো সাথে কথা বলা ঠিক নয়...      
                            (কবিতাংশলিটল রাইডিং হুডকে নেকড়ের পুনশ্চ-বার্তা)    

পাঠকের মনে পড়লেও পড়তে পারে পাশবিক যৌনলিপ্সায় নিহত অষ্টমবর্ষীয়া কুঁড়ির নাম—‘আসিফা। কবি যেন এক পেশকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন এই কবিতায়,স্বীয় মানসচক্ষের নিরালা আদালতে অবশ্যই, নিখাদ প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের জোরেই শুধু রানিং কমেন্টারি গোছের কাব্যিক রিপোর্টাজে তত্ত্ব-তথ্যের ডকুমেন্টেশন পুঁতে রাখেন ; শব্দশরব্যতার মর্মভেদী সার্থকতায় পরের বইটির নামকরণও করেন—‘রুমস আর নেভার ফি্নিশড।অর্থহীন বিপন্ন ক্লীবতায় গড়গড়িয়ে পড়ি এ কান্ট্রি উইথআউট এ  পোস্ট আপিসকবিতার ৪৫১ ডিগ্রি ফারেনহাইট সৃষ্টিকারী ছত্রগুলো—“শেষ হয়ে গেছে সব, বাকি নেই কিছু আর / জোর ফলিয়ে এই নৈঃশব্দ্যকেই বানাব আরশি / দিকনির্ণয়ের জন্য, দৃষ্টিগোচর হয় যাতে তার স্বর / ঢেউ তুলে আগুন দৌড়য় / আমার কি ওই নদীটি পার হওয়া উচিত ?...নিবিড়পাঠ শেষে, প্রশ্ন জাগেএ কি ১৯৮৯ নাকি ২০১৯?শাহিদ আলির নির্ভুল রোগনির্ণয়ের মতোই ১৯৮৯ যেন ২০১৯-এও সজীব।জেরক্সকপির মতন নিখুঁত সবাই দিশাহারা কীরকম,হতভম্ব।আর তাই, আগুনের নদীটি পার হওয়ার প্রশ্নটি ভুসভুসিয়ে উঠছে!ধন্দে পড়িকি আখ্যা দেব এই পংক্তিগুলোকে?ক্যারোলিন ফর্খে কথিত রিপ্রেজেন্টেশ্যনাল’? নাকি এভিডেন্সিয়ারি কিংবা নথি-পুঁথি-দলিল-দস্তাবেজ গোত্রীয় উইটনেসপোয়েট্রি?    

মে,  ২০১১,‘পোয়েট্রিপত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধে প্রখ্যাত মার্কিন কবি-প্রাবন্ধিক-তাত্ত্বিক শ্রীমতী ক্যারোলিন ফর্খে দাখিলা দিয়েছেন যে—‘ ত্রিশ বছর পর খেয়াল হল যে এই আমি, এক তরুণী কবি,যে নাকি এল সালভাদর ঘুরতে গিয়েছিলফিরে আসেনি সে।মানবাধিকার লঙ্ঘনের কেন্দ্রস্থলটি সরেজমিনে ঘুরে দেখার তাগিদে ত্রিশবছর আগে তিনি,নিশ্চিতই,এল সালভাদর গিয়েছিলেন।কিন্তু, ১৬ই মার্চ,১৯৮০-তে দেশে ফিরে আসেননি তিনি।স্বদেশমুখো না হয়ে ওই মহিলা বরং,প্রকৃতপ্রস্তাবে,ওইসব বছরগুলোয় এল সালভাদরে অর্জিত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সাতখানি কবিতা ও একটি প্রবন্ধ লিখে ফেলেছিলেন,যার একটি লাইন হল এইরকম—“ইট ইজ মাই ফিলিং দ্যাট দি টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি হিউম্যান কন্ডিশন ডিম্যান্ডস এ পোয়েট্রি অফ উইটনেস।(সরল বাংলায়),,‘আমার নিজস্ব অনুভব হল যে বিশশতকীয় মানুষে্র হাল-হকিকত দাবি জানায় যে সাক্ষ্যসম্পৃক্ত কবিতা লেখা হোক।’  

অর্থ হয়Trauma আমাদের পূর্বস্মৃতিকে জাগিয়ে তোলে,অতীত-ভাবনায় ভাবিত করে কবিতা তবে কি, নিছকই ,এক  স্মৃতিপ্রতিক্রিয়া ? অথবা কবিতা কি ব্যক্তিগত বিলাপকে কাটিয়ে ওঠা এক বিমূর্ত শিল্পসম্ভাবনা ?জবাবদারির ভঙ্গিমায় ফর্খে আরো লেখেন যে সাক্ষ্যপ্রধান কবিতাকে রাজনৈতিক কবিতা ভেবে বসবেন না যেন! বরং,“ইট ইজ এ মোড অব রাইটিং... রিডারলি
এনকাউন্টার...ইটস মোড ইজ এভিডেন্সিয়ারি রাদ্যার দ্যান রিপ্রেজেন্টেশন্যাল অর্থাৎ, কোনো ঘটনার নিছক প্রতিনিধিস্বরূপ হয়ে  ওঠার চেয়ে বরং পাঠকের নিজস্ব নিবিড়পাঠের দৌলতে কবিতাটির সাক্ষ্য-সম্পৃক্ত হয়ে ওঠাই হল আদতকথা।তাই, স্বীয় বক্তব্যের উপসংহারে উপনীত হয়ে মন্তব্য করেন'অ্যাজ এভিডেন্সিয়ারি,ইন ফ্যাক্ট,অ্যাজ স্পিলড ব্লাড'   


সাক্ষ্য' হিসাবে কবিতার গ্রহণয়োগ্যতা,তথ্য-তত্ত্বের গুরুত্ব প্রতিস্থাপনে কবিতার উৎকর্ষতা প্রমাণই হল ফর্খের 'এগেনেস্ট ফরগেটিং' বইটির মূল চর্চা-তর্জার বিষয়। যুদ্ধ-রাষ্ট্রীয় অত্যাচার-মানসিক আঘাতজনিত দুর্দশা-দুর্ভোগের কারণেই কি আ-বিশ্ব বিশেষ অনুভূতিপ্রবণ অগুনতি 'গ্রেগর সামসারা অত্যাচার-অবিচারের 'আঁখো দেখা হালটিকে লিখিত ভাষ্যে চিরস্থায়িত্ব দিতে উদ্যোগী হন? তাই কি লেখা হয় ফর্খের 'পোয়েট্রি অফ উইটনেস' তত্ত্ব?কিংবা শাহিদ আলির "দি ভেইল্ড সুঈট"?সাক্ষ্যসাবুদী কবিতা”-র থিম,বস্তুত,জনমানসকে এমনভাবে নাড়া দিয়েছিল যে কবিতাই নয় শুধু,একই নামে একটি সিনেমাও প্রযোজিত হয়েছিল,২০১৫-য়  কবি ক্যারোলিন ফর্খে,কবি ফাদি যৌদা,কবি মারিও সুসকো আর নির্বাসিত 'উদ্বাস্তু' কবি সাঘি ঘাঘরামন প্রভৃতির সহযোগিতায়  চলচ্চিত্রায়িত হয় সেই ছবি''পোয়েট্রি অফ উইটনেস' তাই, নিঃসন্দেহে বলা যায় যে বিশশতকীয় বিশ্বসাহিত্যে দলিল-দস্তাবেজ, নিশ্ছিদ্র সাক্ষ্যপ্রমাণ হয়ে ওঠার মতন সাহিত্যকৃতির সংখ্যা ,বিশেষত,কবিতার ক্ষেত্রেঅবশ্যই বিস্তর।আর এই সন্দর্ভে উল্লেখযোগ্য কিছু নাম হল আনা আখমাতোভা,ওসিপ মান্দেলস্তাম,মাহমুদ দারুউইশ,পাউলো সেলান, উইস্লাভা সিম্বোর্স্কা, ফয়েজ প্রভৃতি  উচ্চশির-অদম্যমনা-নির্ভীক প্রতিবাদী আত্মা  কবিতার মাধ্যমে তাঁরা বিস্মরণের আলঝাইমার থেকে স্মৃতিকে রক্ষা করতে চেয়েছিলেন। প্রার্থনা করেছিলেনস্মৃতি যেন বিস্মৃতি-গ্রস্ত না হয়ে পড়ে। অত্যাচারীকে সতর্ক করে দিয়ে মিউশ লেখেন—'দি পোয়েট রিমেমবারসকবি মনে রাখেন।কবিতার গ্রন্থনে থাকে সেই 'ডকুমেনটেশন' বা তথ্য-সংযোজনের প্রয়াস। 'উইটনেস' পোয়েট্রির এই ধারারই উত্তরসূরি হলেন আগা শাহিদ আলি।বাস্তবিকইগ্রেগর সামসা গোছের 'মেটামরফোসিস"-এর চূড়ান্ত পরিণতি দেখা যায় তাঁর কবিতাকর্মে১৯৭০-এর নস্টালজিক থেকে ১৯৯২-এর সাক্ষ্যসাবুদী কবিত্বে রূপান্তরিত সত্ত্বার নামআগা শাহিদ আলি। 

র্খে বিশেষিত লক্ষণগুলোর সঙ্গে কবিতার স্মৃতিবিক্রিয়া বিষয়ে আরো এক বিশেষ গুণবত্তার উল্লেখ রাখতে চাই ঃ কবিতার   'প্রকৌশলী সত্ত্বা''স্মৃতিলিপি' নামের বইতে কবি-প্রাবন্ধিক আর্যনীল মুখোপাধ্যায় 'স্মৃতি' বিষয়ে এক দুরন্ত উপস্থাপনা দিয়ে শুরু করে লিখেছেন—“ সব সৃষ্টির ভিতপুজোয় লাগে এক পুনর্গঠন।স্মৃতিহীনের কোনো পুনর্গঠন নেই,কল্পনা নেই। স্মৃতিই অতীতের বর্তমান কাল।ভবিষ্যতের অতীতর্খের সুবিখ্যাত,তিচর্চিত বইয়ের নাম হল'এগেনেস্ট ফরগেটিং।'অর্থাৎ,বিস্মরণ-বিরোধিতা। ফর্খে উচ্চারিত লক্ষণগুলো হল ট্রেস-এভিডেন্স(বা চিহ্ন,প্রামাণিক সাক্ষ্য),ফ্লিন্ট (বা চকমকি পাথর) কিংবা 'টিন্ডার(স্ফুলিঙ্গ- সম্ভব শুকনো খড়কুটো।এই সবকটি লক্ষণই এক বিশেষ প্রবণতার কথা বলছে ঃ কবিতার দহনসম্ভাব্যতা ওর্ফে কবিতার প্রতিক্রিয়া। কিন্তু, সেই প্রতিক্রিয়া, দহনসম্ভাব্যতা তো কবিতা গঠিত হয়ে যাবার পরের ঘটনা ।পক্ষান্তরে ,কবিতার প্রাথমিক স্তর অর্থাৎ স্মৃতিকেন্দ্রিক গঠন, তার নির্মাণ বা হয়ে ওঠার কথা পেড়েছেন আর্যনীল।'স্মৃতি'-র প্রাথমিক গুণবত্তা-কার্যকারিতা বা সৃষ্টির রহস্যময়তা  এককথায়, স্মৃতি নামক চারাগাছটির ফুলেল সম্ভাবনা ।সেই সাংস্কৃতিক-মনস্তাত্ত্বিক স্মৃতি-অনুসন্ধানের আলোকেই কবি আগা শাহিদ আলির 'অক্ষর-কাশ্মীর' ভ্রমণে ব্রতী হব।
     
১৯৭২, অর্থাৎ, আজ থেকে প্রায় ৪৭ বছর আগে কলকাতার রাইটার্স ওয়র্কশপ থেকে প্রকাশিত হয়েছিল শাহিদ আলির বই 'দি বোন স্কাল্পচার '। সেই বইয়ের প্রথম ছত্রেই রয়েছে রক্ত,মাটি,শোকার্ত শোভাযাত্রা আর স্মৃতির সঙ্গে স্মৃতির মিলমিশের কথা। পরবর্তীকালে প্রথম পাঁচটি বই থেকে কয়েকটি কবিতা নির্বাচন করে,১৯৯২-য়ে, ভাইকিংপেঙ্গুইন সংস্থা 'দি বিলাভেড উইটনেস' নামাঙ্কিত এক সঙ্কলন-গ্রন্থ প্রকাশ করেছিল। ১৯৭৫-এ কবি আমেরিকা প্রবাসী হয়েছেন এবং নিজেকে কাশ্মীরিআমেরিকান কবি হিসাবে চিহ্নিত করেছেন।অথচ,পশ্চিমের প্রগতি-প্রগলভতা-চড়া সুরের আধুনিকতার মধ্যে নিত্যদিন ডুবে থাকা সত্ত্বেও জন্মভূমির প্রতি গহীন-গভীর আকর্ষণ অনুভব করেছেন।বস্তুত,কবিজন্মের প্রথম লগ্ন থেকেই তাঁর কবিতাকর্মের পথে-পথে, প্রান্তরে-প্রন্ত্যন্তে ছড়ানো রয়েছে জন্মভূমি 'কাশ্মীর'-এর অজস্র অ্যানেকডোটাল মুক্তোদানা।

'ছয় ইঞ্চি বাই চার ইঞ্চি ঘেরের আমার চিঠি-ঘরে
কোনোক্রমে কুঁকড়ে কুঁচকে ঢুকে পড়ল কাশ্মীর
চিরকালই প্রিয় আমারপরিচ্ছন্নতা, ধরে রেখেছি
মুঠিতে, এই তো আধা ইঞ্চি হিমালয়               
                                (পোস্টকার্ড ফ্রম কাশ্মীর ঃ হাফ ইঞ্চ হিমালয়)                

পোস্টারের ঢঙ-য়ে,পোস্টকার্ডের ইঞ্চিকয়েক পরিসরে, সাঁটা হয়েছে প্রকাণ্ড এক ভৌগোলিক অস্তিত্বের কাব্যিক মিনিমাইজেশন,বাস্তবে  যা এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবচেয়ে বড়ো দৈর্ঘ্যদূরত্ব,ভ্রুক্ষেপহীন উর্দ্ধগামিতা,২৯০২৯ ফিট প্রোন্নত অবস্থান।তবে কেন এমন বৈপরীত্যের কল্প-আশ্রয়? কেননা, প্রায় অনস্তিত্বে পর্যবসিত কাশ্মীরের বর্তমান কালখণ্ডটিকে, রূপকের ঘুরপথে, একদা সুমহান গভীর-গহীন অতীতের সচল পূর্বাবস্থায় দেখতে চেয়েছেন কবি আগা শাহিদ আলি আর তাই,আয়োজিত হয়েছে এমন ছয় বাই চার ইঞ্চি ঘেরের ক্যানভাসে আবদ্ধ এক গালিভারীয় বিশালতার আস্তিত্বিক পিগমিকরণ,বাস্তবিকতার যে পর্যায়ে কুঁকড়ে-কুঁচকে, কোনোক্রমে,স্মৃতি-ঘরে সিঁটিয়ে থাকে গুণাঢ্য,কলহণ,সোমদেবের কাশ্মীর।মুঘল স্থাপত্যশৈলী কিংবা পাশলে-পারসিক।মনখারাপের চিঠি-ঘরে তখন কেমন এক রুদ্ধ-বিরুদ্ধ-অবরুদ্ধ ইজাহার।প্রবাসের সেই চোদ্দো বাই সতেরোয়,হঠাৎ হাতে আসা পোস্টকার্ডটির সূত্রে, আশৈশব চেনাজানা সামাজিকতার,নির্বিরোধী সাংস্কৃতিকতার যৌথতায় আকস্মিক হাজির হয় যেন এক ভিন্ন উপস্থিতি,ভিন্ন ঠিকানা

১৯৬০-৭০এর,সেই পরিচিত কাশ্মীর যেন কোথাও হারিয়ে গিয়েছে।ত্রিধাবিভক্ত তার হাল-হকিকত।কোথাও থাবা গেড়ে বসে পড়েছে চীন ।পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিমের বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড কব্জায় নিয়েছে পাকিস্তান।রাজনৈতিক বিরোধের পটভূমিতে বেশ কয়েকবার ভারত-পাক যুদ্ধ হয়েছে।আর ঘটনার গতি-প্রকৃতি প্রতিবারই কিছু 'ভিন্নস্বাদের' ছবি এঁকে দিয়ে গেছে। নিজের কবিতাধর্মের 'দ্বিমুখী' প্রবণতা সম্বন্ধে নিজেই ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন।প্রথমপর্বের,অর্থাৎ,র্উনিশশো একানব্বই পর্যন্ত শাহিদ আলির কবিতাকে অনায়াসেই স্মৃতিতাড়িত উৎসার হিসাবে চিহ্নিত করা যায়শাহিদ নিজেও তাই বিশ্বাস করতেন ; যে কারণে বইয়ের শিরোনামে 'নস্টালজিস্ট' শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন অমনই, ১৯৯২-য়ে প্রকাশিত নিজস্ব কবিতা-সঙ্কলনের নামকরণে 'উইটনেস' শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন।কিন্তু,১৯৯২ পরবর্তী কালখণ্ডে তাঁর কবিতায় বিশেষ মোড়বদল ঘটে।স্মৃতিনির্ভর কবিতার বদলে কাশ্মীরের বাস্তব পরিস্থিতির মুখ্য সচেতক হয়ে ওঠে তাঁর সৃষ্টি।'কান্ট্রি উইথআউট এ পোস্টঅফিস','কল মি ইসমাইল টু নাইট','রুমস আর নেভার ফিনিশড'...বইয়ের নামগুলো কেমন পালটে যেতে থাকে।এই পর্বের কবিতাগুলো,নিঃসন্দেহে,স্মৃতির পুনর্গঠন নয় আর কল্পনার আতিশয্যরহিত।এভিডেন্সিয়ারি।নথিসুলভ।বাস্তব পরিস্থিতির কাব্যিক প্রতিচিত্রণ বরং'ফিউচার অব নস্টালজিয়া' নামের বইতে Swetlana Boym লেখেন'ওয়ান ইজ নস্টালজিক নট ফর দি পাস্ট দি ওয়ে ইট ওয়াজ, বাট ফর দি পাস্ট দি ওয়ে ইট ক্যুড হ্যাভ বিন।ইট ইজ দি পাস্ট পারফেক্ট দ্যাট ওয়ান স্ট্রাইভস টু রিয়েলাইজ ইন দ্য ফিউচার।' শাহিদের "পোস্টকার্ড ফ্রম কাশ্মীর" কবিতায় চিত্রিত  হয়— 'হাফ ইঞ্চ হিমালয়'...   This is home . And this is the closest / I’ll be ever be to home. When I return / the colors won’t be  so brilliant ,/ the Jhelum’s water so clean,/ so ultramarine. My love / so overexposed / And my memory will be a little / out of focus ,in it  / …(পোস্টকার্ড ফ্রম কাশ্মীরকবিতার মধ্যাংশ),যার বঙ্গানুবাদ করেছি এরকম

এটাই আমার ঘর , এর চাইতেও আরো কাছে
যেতে আর পারব কি কখনও, ফেরার পথে
রংগুলো কি আর তেমন দুরন্ত মনে হবে
ঝিলমের জলস্বচ্ছ তেমন
আমার ভালোবাসা সমুদ্রনীলাভ অমন
সুস্পষ্ট অতোটাই ,প্রকট
আমার স্মৃতি, কয়েকগুছি
এরই মধ্যে .. অস্পষ্ট কেমন
                       
প্রসঙ্গের জের ধরে রাখা আর কবির মনোভাবের অতাপতাটি একশোভাগ খুঁজে পেতেই ,মূল ইংরাজি টেক্সটির উল্লেখ রাখলাম। কেননা, ট্রানশ্লেষনের নিজস্ব দুরূহতা আছে।থাকবেও। কবি অভীপ্সিত 'closest'  শব্দটির গহীনতা অস্বীকার করার কোনো ছল-ছুঁতোই ,সম্ভবত, যথেষ্ট নয়।কোনো এক সময় ছিল যখন ঝিলমের জল ছিল টলটলে; জীবনকে বর্ণময় করে তুলত রঙের মহক।সমুদ্রগহীন ভালোবাসার নীল আঁচলে ঢাকা থাকত খুশির অষ্টপ্রহর ; ভুসভুসিয়ে উঠছে পুরোনো সেইসব দিনের স্মৃতি। অথচ, কবিতাটিতে একবারই শুধু past tense বা অতীতকালের সুস্পষ্ট প্রয়োগ করা হয়েছে।তিন নম্বর লাইনে কবি বলেছেন 'চিরকালই প্রিয় ছিলপরিচ্ছন্নতা। আর সেই প্রিয়তার সূত্রে ফুটে উঠেছে "অব্যক্ত" অতীত।নেহাতই খেলার ছলে যদি 'এটাই আমার ঘর' শব্দগুচ্ছের পাশে কয়েক ছত্র পিছিয়ে থাকা "আমার স্মৃতি, কয়েকগুছি/ এরই মধ্যে...অস্পষ্ট কেমন" অভিব্যক্তিটি জুড়ে দিই, তবে নিশ্চিতই, দু' হাজার বিশের 'অবরুদ্ধ' কাশ্মীরের পটভূমিকায় কবির আশঙ্কা-উদ্বেগের সন্দর্ভটি মানানসই মনে হবে। ক্যামেরায় অধরা বস্তুকে 'out of focus' বলা হয় ।' আউট অব ফোকাস' অর্থাৎ যা অস্পষ্ট, ধরাছোঁয়ার বাইরে। যদি কখনও কাছে আসতে পারেন কবি, তবে হয়তো সেই চিরচেনা কাশ্মীরকে তাঁর আউট অব ফোকাস মনে হবেচিনে নিতে পারবেন না । অপরিচ্ছন্ন এই কাশ্মীর  ধুন্দলাসা।

কবি দাখিলা দেন অনুগত আমরা।ওদের দরোজায় টাঙ্গিয়ে রাখি গোড়ের ফুলমালা; প্রতিরাত্রে...
অপরিচিত স্বর জানায়  রয়েছি আগুনের মাঝে / খুঁজে পেয়েছি আঁধার।                   
                                               (“ এ কান্ট্রি উইথআউট এ পোস্ট আপিস)

যুগপৎ,অতীত ও বর্তমানের ঘের জড়িয়ে লতিয়ে উঠেছে এই দুই মন্তব্য।ডি-কলোনাইজেশনের মাধ্যমে আফ্রিকা মুক্ত হয়। অথচ, সেই একই কালখণ্ডে ,ঠাণ্ডাযুদ্ধের বকলমে, ‘রি-কলোনাইজেশন”-য়ের বলি হয় কাশ্মীর।সেই পরিপ্রেক্ষিতে ,’অনুগতশব্দবন্ধ বা গোড়ের ফুলমালা’-র সংযোজন কবিতাটিতে ভিন্নমাত্রা জুড়ে দেয় না কি?কিংবা, ‘রয়েছি আগুনের মাঝে / খুঁজে পেয়েছি আঁধার।তাঁর মনন-চিন্তনের ক্যানভাসে অতীত অধ্যায়গুলোর পুনরুদ্ভব হয় তখন।ঝিলমের আল্ট্রামেরিন জল,তার রঙ্গিন প্রহর।পর্যায়ক্রমে ফুটে ওঠে দীর্ঘ সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের আদরণীয় ইতিহাসহিন্দু-বৌদ্ধ-শৈব-তুর্কি-মুঘল-পারসিক সংস্কৃতির মেলবন্ধনে গড়ে ওঠা কাশ্মীরের নিজস্ব জীবনচর্যা  খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতকে লেখা রাজতরঙ্গিনীকাব্যকথার জন্য প্রথমতম ভারতীয়ইতিহাসকার হিসাবে গণ্য হন কলহণ। বসুগুপ্ত-কুমারজীব হয়ে খ্রিস্টীয় চোদ্দোশতক থেকে ঐশ্লামিক সংস্কৃতির নিবিড় ঐতিহ্য। সমাজবিজ্ঞানী শ্বেতলানা ব্যম লেখেন—‘স্মৃতি-আশ্রয়ী হয়ে পড়ে মানুষ,কারণ ভবিষ্যতেও সেই বিচ্যুতিহীন অতীতকেই আদতে ফিরে পেতে চায়।কেননা,তার ইন্টারেস্ট ইন নস্টালজিয়া ইজ লেস অ্যাবাউট লস,মোর অ্যাবাউট ইনভিগোরেশনতাই হিন্দু দরোজায় গোড়ের ফুলমালা।কিন্তু পরের লাইনেই থাকে নিথর বাস্তবতা।রয়েছি আগুনের মাঝে। সেই আগুনের হাত থেকে বাঁচার জন্য অন্ধকারের দুয়োর খটখটায় হতভাগ্য বেহাল বেজুবান সমস্ত বিংশ শতাব্দী জুড়ে এইভাবেই বেঘর-বেসাহারা হয়েছে মানুষ। আর বেদখল হয়েই চলেছে পরিত্যক্ত ঠিকানা।  

প্রতিটি ছত্রে ছড়িয়ে রয়েছে তুলনা টানার কী অসীম আকুতি।সো ব্রিলিয়ান্ট, সো ক্লিন, সো আল্ট্রামেরিন,সো ওভার-এক্সপোজড।প্রতিটি বিশেষিত অনুভবের স্ফূরণের জন্য 'সো' শব্দের তুলনাধর্মী এবং গুণবাচক ক্রমান্বয়ী ব্যবহার। অর্থ হয়, পরিবর্তিত হয়েছে কাশ্মীর,যা এখন এক 'প্রকাণ্ড নেগেটিভ' নঞর্থকতা।যা অপ্রস্তুত,যা অপরিপুষ্ট ।এমন এক সাদামাটা বর্ণহীনতা, সম্পর্কশূন্যতা—যা সমস্ত রংকে অস্বীকার করে।এমন এক নৈরাশ্যবাদিতা,যা ভূবিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘাকৃতি অস্তিত্বকে খাটো করে,খুদে বানায়,বামনাকৃতি দেয় ।অমনই কিছু রহস্যময় বৈপরীত্যের সমাবেশ ঘটানো হয়েছে 'পোস্টকার্ড ফ্রম কাশ্মীর' কবিতার শেষ দুটি পংক্তিতে— 'a giant negative , black / and white, still undevelop.'  
            এক সুবিশাল নেগ্যাটিভ,কৃষ্ণবর্ণ
            শ্বেতশুভ্রতা,যা
            অপরিপুষ্ট এখনো।  
স্পষ্টতই, negative-black and white আর undevelop—তিনটি শব্দই (আপাতদৃষ্টিতে)ফটোগ্রাফিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু, নিবিড়পাঠের সূত্রে ধরা পড়ে যে ইঞ্চিছয়েক দৈর্ঘ্যে ২৯০২৯ ফিট উচ্চতাকে ঠুসে দেওয়ার মতই এও এক চূড়ান্ত শ্লেষধর্মী অভিব্যক্তি। আর তাই সংযোজিত হয়েছে giant আর still শব্দব্যঞ্জনাদুটি ঃ এরা দুয়ে মিলে কবিতাটিকে স্বাধীনতালাভের চল্লিশ বছর পরেও কাশ্মীরি অনুন্নয়ন,অর্থনৈতিক দিশাহীনতার বাস্তবিকতাকে তুলে ধরেছে।সমস্ত দুনিয়া যখন রংধনুর সাতটি রংকেই যাপনচিত্রের শরিক করে নিতে পেরেছে,যৎপরোনাস্তিরঙ্গিন হয়ে উঠেছে, বোধে-বৈভবে-বৈদগ্ধ্যে ; অত্যাধুনিকতার সেই আ-বিশ্ব নতুনত্বেও কাশ্মীর রয়ে গেছে still undevelop,সাদাকালোর গতানুগতিকতায়,সাদামাটা black and white আনপ্রসেসড জায়ান্ট নেগ্যাটিভ। না ,ওই 'closest ' শব্দটির মতনই অনুবাদযোগ্য নয় এই 'negative 'শব্দটি ।


No comments:

Post a Comment

একনজরে

সম্পাদকীয়

একটি বিষয়ে আমাদের সকলের একমত হতেই হবে ভিন্ন মতের ও ভিন্ন রুচির বহুস্তরকে সম্মান জানিয়েও, যে, আমরা এই মুহূর্তে প্রায়শ্চিত্ত করছি। মানুষ...

বেশিবার পড়া হয়েছে যেগুলি