নববর্ষের কথা ভাবলেই অবধারিত ভাবে ছোটবেলার গন্ধ এক পা দুই পা করে হেঁটে হেঁটে চলে আসে এক্কেবারে হাতের মুঠোতে। যেন ছেলের হাতের মোওয়ার মতো হাত ঘোরালেই রঙিন ক্যালাইডোস্কোপে হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে মায়ের সপ্তাহব্যাপী পইপই সাবধান বাণী - শোনো সামনেই নববর্ষ আসছে, সেদিন কিন্তু কোনো রকম অবাধ্যতা করবে না। আমাকে যেন সেদিন অন্তত উত্তম মধ্যম দিতে না হয়, বচ্ছরকার দিন বলে কথা। মায়ের চেতাবনি কর্ণগোচর না করেই আমার গা জ্বলানো জিজ্ঞাসা ছিল - তার মানে তুমি কি বলতে চাও বাকি দিনগুলো সব বছরের বাইরে? একথা বলেই তুরন্ত লংজাম্পে কানমলা খাওয়ার গন্ডির বাইরে এবং মায়ের সেই অমোঘ নির্ঘোষ - দাঁড়া হচ্ছে তোর।
যদিও এটা কোনো সেকাল একালের গল্প নয় তবুও ডিংডং করে ঘন্টা বাজিয়ে খুলে যায় পুরনো চিলেকোঠার দরজা..লোহার সিন্দুক তো নয়, যেন প্যান্ডোরার বাক্সের ডালা খুলে বেড়িয়ে পড়ছে তাবৎ কোলাজ....
কীই বা পেতাম তখন ! বড় জোর একটা সস্তা সুতির ফুলছাপ নতুন ফ্রক আর বাড়তি দুএক পদ বেশি রান্না, সন্ধ্যায় মিষ্টির প্যাকেট আর মায়ের শাসনের রাশ কিছুটা আলগা , তাতেই এমন মাখোমাখো ভাব হতো এমন আহ্লাদে গড়িয়ে পড়তাম.... এখন হাড়ে হাড়ে টের পাই বয়স কেমন করে নিংড়ে বের করে নিয়েছে সেইসব অনাবিল আনন্দ বোধ।
তবুও চিলেকোঠার দরজায় টুকি মারতেই দেখি ওমা সে তো এলাহি কান্ড কারখানা..... নববর্ষের বেশ কয়েকদিন আগে থাকতেই শুরু হোতো ধোলাই এর রুটিন। না না এ ধোলাই আমার পিঠে পড়ত না, পড়তো বাড়িঘর আসবাবপত্র জামাকাপড় মায় রান্নাঘরের মশলার কৌটা চালের টিন মুড়ির টিন এমনকি বঁটি শিলনোড়া অবধি। যেন সেই 'মার ঝাড়ু, মার ঝাড়ু, মেরে ঝেঁটিয়ে বিদায় কর' এর লাইভ টেলিকাস্ট। এখন বুঝতে পারি এর গূঢ় অর্থ, আসলে তো পুরো একটা বছর যা কিছু ময়লা জমে মনের ভিতরে একটা নতুন বছরকে সাক্ষী রেখে সেসবই ধোয়ামোছা করা...
সেই আমাদের প্রাণের ঠাকুর লিখে গেছেন না " আমার এ ঘর বহু যতন করে/ ধুতে হবে মুছতে হবে মোরে..."
তবে একেবারে সরাসরি নববর্ষের ভোরে চলে যাচ্ছি না এখনই, প্রথমে আরোহণ অবরোহণ ঠাট তারপর স্থায়ী অন্তরা এসব সেরে তবেই না সঞ্চারীতে যাওয়া। তো আমাদের তখনকার সেই নববর্ষের শুরুয়াৎ হতো আগের দিন ছাতুর সরবৎ খেয়ে এবং তার একটা মনোলোভা নামও ছিল ছাতু সংক্রান্তি, বাড়ির সব সদস্যকেই সেদিন যবের ছাতুর এই পানীয়টি খেতেই হবে আর ছিল আমাদের ছোটদের জন্য সবচেয়ে শাস্তিযোগ্য খাওয়া অথচ এখন যেটা প্রায় অমৃত খাওয়ার মুখ করে খাই ( যদিও অমৃত ব্যাপারটা সত্যি সত্যিই জিভস্থ করিনি এখনো একথা বলাই বাহুল্য ) সেই আদি এবং অকৃত্রিম নিম-বেগুন ভাজা, চোখের জল ফেলতে ফেলতে গ্লাসের জল দিয়ে কোনও রকমের ভাতের মন্ডের মধ্যে পুরে কোঁৎ করে গিলে ফেলতাম। না খেলে নাকি ঠাকুর পাপ দেবে আর কে না জানে ঠাকুর পাপ দিলে নববর্ষের দিনে ভালো-মন্দ খাবার দাবার মোটে পাওয়া যায় না ! এখনো হয়তো কোনো কোনো বাড়িতে এই সব আচার পালন করা হয়....
যাই হোক , চৈত্র সংক্রান্তির বিকেলের দিক থেকেই শুরু হতো ভাইবোনেরা মিলে রান্নাঘরের দিকে ঘুরুঘুরু। কাল তো দারুণ দারুণ সব খাওয়া দাওয়া হবে বচ্ছরকার দিন বলে কথা । তারই আগাম আভাস নেওয়া আর কী। দেখতম আয়োজন চলছে পুরোদমে
আমাদের বাড়িতে অবশ্য নববর্ষের দিন আমিষ খাওয়ার চল্ ছিল, আমার ঠাকুমা বলতেন আজকের দিনে দুধে মাছে থাকলে তবেই না বছরভর লক্ষ্মীদেবী সদয় হয়ে দুহাত উপুড় করে দেবেন ছেলেপিলের সংসারে। বাজারহাট সব ( মাছ ছাড়া ) আগের দিনই হতো ঐ যে এখানেও কাজ করত লৌকিক বিশ্বাস, যে উপার্জন এতটাই বেশি যে গত বছরের রসদে এই নতুন বছরেও উদরপূর্তি হচ্ছে। আমাদের পড়শী জেঠিমাকে দেখতাম চৈত্র সংক্রান্তির রাত্রেই রাশিকৃত রান্নাবান্না করে রাখতে এবং পরের দিন সেইসব খাওয়া দাওয়া হতো, সেই একই লৌকিক আচার মেনে।
যথারীতি নববর্ষের দিন আমাদের ইস্কুল ছুটি এবং ছুটি মানেই গরম গরম রুটি... জানি বকাঝকার রিখটার স্কেল বিপজ্জনক সীমায় পৌঁছনোর কোনো ব্যাপার নেই আজ বচ্ছরকার দিনে, সুতরাং সকাল সকাল ওঠা এবং পরবর্তী প্রাত্যহিকিগুলো ইচ্ছা করেই বিলম্বিত লয়ে শুরু হতো এবং এই যে আমাদের এত জানবুঝ অবাধ্যতা সত্ত্বেও মাতৃদেবী তার ক্রোধের উনুনে গনগনে আঁচ দিতে পারছেন না, আমরা ভাইবোনেরা মায়ের এই অসহায়তাটাকে বেশ উপভোগ করতাম। ততক্ষণে বাড়ির পুজোপাঠ সেরে ফেলেছেন বড়রা। এরপর আমাদের ধরে বেঁধে স্নানপর্ব সারানোও সমাপ্ত হতো এবং মায়ের কড়া নজরদারিতে তেত্রিশ কোটি ঠাকুর-দেবতা এবং যাবতীয় গুরুজনদের প্রণাম এপিসোড।
রান্নাঘর থেকে ফুলকো লুচির সুবাসে ভরে যাচ্ছে আমাদের অধৈর্য্য জিভ অথচ মায়ের সেই চোখ পাকানো - একদম না, আগে ঠাকুরের প্রসাদ মুখে দেবে তারপর....
রেডিওতে বাজছে এসো হে বৈশাখ এসো এসো.....
সকালের সুস্বাদু জলখাবারের পর আমরা উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছি দুপুরের রকমারি ঝোলে ঝালে অম্বলে সাজানো থালার....
না না এখানেই শেষ নয়। পরবর্তীতে আছে এক রুদ্ধশ্বাস ঘটনা কখন সন্ধ্যা নামবে আর আমি ফুলছাপ নতুন ফ্রক পরে বাবার সঙ্গে বেড়িয়ে পড়ব সেই অনির্বচনীয় উৎসব যাকে 'হালখাতা' বলা হতো ।
ব্যাপারটা যে ঠিক কী সেটা অতশত বোধগম্য হতো না তখন, তবে দেখতাম সুনীলকাকুর দোকান যেখানে তেল চাল আটা সুজি বিস্কুট থেকে শুরু করে মায়ের হিমানি স্নো বঙ্গলক্ষ্মী আলতা বাবার দাড়ি কামনোর গোল বাটি-সাবান ঠাকুমার জোয়নের আরক পর্যন্ত পাওয়া যেত, যে দোকানের কাচের বয়ামে রাখা হজমিগোলা বিচ্ছিরি ভাবে খালি হাতছানি দিত আমাদের, সেই প্রতিদিনের মুদিখানা দোকানে গিয়ে দেখতাম বাবা টাকা বাড়িয়ে দিচ্ছেন আর সুনীলকাকু লাল মোড়কের খাতায় সেসব লিখে রাখছেন এবং অন্যান্য দিনের চেয়ে ঠোঁটে অনেক বেশি হাসি ঝুলিয়ে বসুন বসুন করছেন এবং কী আশ্চর্য বাবার হাতে মুদিখানার জিনিসপত্রের বদলে সুনীলকাকু ধরিয়ে দিচ্ছেন চৌকোনো মিষ্টির প্যাকেট অথচ সুনীলকাকুর কিন্তু মিষ্টির দোকান নয়। মিষ্টির বাক্সের সঙ্গে সঙ্গে রামকৃষ্ণের ছবি আঁকা গোল করে পাকানো বাংলা ক্যালেন্ডারও ঢুকে যাচ্ছে বাবার বাজারের ব্যাগের পেটে । এমনকি আমার মতো পুচকেরও বসার জায়গা বরাদ্দ হতো সেদিন। প্রথম প্রথম আমি ভাবতাম আচ্ছা বাবা যদি মিষ্টিই কিনবেন তো ঘোষালজেঠুর মিষ্টির দোকানে না গিয়ে সুনীলকাকুর মুদির দোকান তারপর অন্নপূর্ণা বস্ত্র ভান্ডার দয়াময়ী বাসনালয় আরও সব অন্যান্য দোকানে যাচ্ছেন কেন ! যথারীতি নিজের বুদ্ধির উপর আমার যথেষ্ট আস্থা ছিল সুতরাং বাবাকে অযথা এখানে ওখানে ঘোরাঘুরি না করে সোজাসুজি ঘোষালজেঠুর মিষ্টির দোকানে যেতে বলেছিলাম আমি আর ভেবেছিলাম বড়রা বড্ড বোকা হয়। তারপর বাবা যখন বুঝিয়ে বললেন তখন জানলাম হালখাতা কাকে বলে। অবশ্য তখন আমার নিজেকে মোটেও বোকা মনে হয়নি। আহা রে !আমি তো ছোট তাই না? এতকিছু আমি জানব কী করে!
সবচেয়ে মজা হতো কোনো কোনো দোকানে যখন লাল বা কমলা রঙের শরবত খেতে দিত। বাইরের লোকজনের সামনে বাবা বলতে পারতেন না যে মা বলেছেন সন্ধ্যাবেলায় ঠাণ্ডা খেতে নেই। বাবা বরং সেদিন ইস্কুলের বন্ধুদের মতো বলতেন সব কথা বাড়িতে জানাতে নেই। পরের দিন ইস্কুলে গিয়ে আমরা খোঁজ করতাম কার বাড়িতে কতগুলো ক্যালেন্ডার এল তাতেই বুঝে যেতাম কত মিষ্টির প্যাকেট এসেছে সুমিতা তনুশ্রী বা মিতালিদের বাড়ি। আসলে সরাসরি মিষ্টির কথা কি কাউকে বলা যায় ! হ্যাংলা ভাববে যে।
এখন শপিংমল আর ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের ঝাঁ চকচকে জলুষে পুড়ে গেছে সুনীলকাকুদের লাল মলাটের হালখাতারা । এখন আর ধারের খতিয়ান লেখা হয় না খাতার পাতায়,এখন পকেটে পকেটে ক্রেডিট কার্ড। এখন আর হালখাতা ফেরত মিষ্টির প্যাকেটর পেটের ভিতর চমচমের রস গড়িয়ে গিয়ে ভাব জমায় না তিনকোণা নিমকির সঙ্গে। এখন স্মার্ট পোশাকের যুবক হোম ডেলিভারি দেয় পিৎজা বার্গার। এখন আর বাবার হাত ধরে দোকানে গিয়ে সন্ধ্যায় লাল-কমলা শরবত খাওয়া নেই ফ্রিজে এখন রংবেরঙের কোল্ড ড্রিংকসের সুন্দরী বোতল, চমচমকে সপাটে বাউন্ডারির বাইরে পাঠিয়ে এখন আমার দাঁত আয়েশ করে কামড় দেয় ডার্ক চকোলেটে। মায়ের হাতের চিতল মাছের মুইঠ্যা আজকাল বোর লাগে খুব অথচ বচ্ছরকার দিন বলে কথা জম্পেশ বাঙালিয়ানা না দেখালে কি চলে! তাহলে তো ভারচুয়্যাল দেওয়ালে আমার স্ট্যাটাস পুরো টাঁই টাঁই ফিশশশশ্ হয়ে যাবে । তড়িঘড়ি অনলাইনে অর্ডার দিই ডিলিশাস বেঙ্গলি ডিশ। ফেসবুকে ফটো আপলোড করি.... ফিলিং প্রাউড উইথ তাঁতের শাড়ি পাঞ্জাবি আর MACCHER JHOL.... ঝপাঝপ পাঁচশ সাতাশ টা লাইক একশ তিপান্নটা কমেন্ট।
আত্মরতির স্রোতে পানসি ভাসে তরতরিয়ে.....
নববর্ষ পহেলা বৈশাখ হতে হতে ১লা থেকে এক-লা হয়ে যায়
No comments:
Post a Comment