আমি ঢুকে যাব কি ভয়ের কৃষ্ণগহ্বরে ? সমস্ত সত্য, সমস্ত সুন্দর গ্রাস করে নেয় এই গহ্বর। টেনে নিয়ে নিঃশেষ করে দেয়। আমি টেলিভিশনে দেখলাম আলো মাখানো সংবাদ। লিখলাম,
প্রথম আক্রান্ত সুস্থতার পথে। তার দ্বারা সংক্রমণ হয়েছে বলে জানা যায়নি। এক বৃদ্ধের হয়েছে, তার স্ত্রী পুত্রের হয়নি। এসবই আশার আলো। এই যে এত মানুষ ঘরে ফিরবে বলে দিল্লির বাস টার্মিনালে জমা হয়েছেন, এদের বিমান ভ্রমণের ইতিহাস নেই। এদের আছে মাইলর পর মাইল পায়ে হাঁটার অভ্যাস। এদের কাছাকাছি বাবুরা যান না, এদের সংক্রমণ হবে না। হে ভারতবর্ষ, এরাই তোমার প্রাণ। এরাই শক্তি। এদের কাজ গেছে। তাই পেটে ভাত নেই। এদের ভাত রুটি চাই। এরা না হলে আমরা পরজীবী মানুষ বাঁচব না। মনে করুন চাযাবাদ নেই, গমের ক্ষেত শূন্য, মনে করুন রেস্তোরাঁয় পরিচারক নেই, বারে ওয়েটার নেই, আমার জীবন চলবে? চলবে কাগজ পৌঁছে দেওয়ার হকার না থাকলে, সব্জি ডিম বিক্রেতা না থাকলে? কফি হাউসের বেয়ারা না থাকলে মজলিশ হবে? জন্মদিনের পার্টি হবে এদের ছাড়া। মুড়ি, চিড়ে না ভাজলে খাব কী? এদের জন্য আগে ভাবতে হবে। সরকার এই মানুষের পাশে দাঁড়ান। তিন মাস ই এম আই দিতে হবে না ঋণের। এদের জন্য কী প্যাকেজ? আছে। তা যেন ও পি এল, বাবু বি পি এল সেজে খেয়ে না নেয়। ত্রাণ এলে স্থানীয় বাবুরা ফুলেফেঁপে যান। তা যেন না হয়। ঐ যে সন্তান কাঁধে নিয়ে হেঁটে চলেছেন ভারত জননী, ওঁকে গ্রামে পৌঁছে দিন। উনি অভুক্ত। ওঁর ঘরে খাদ্য দিন। যদি ভুল বলে থাকি মার্জনা করবেন।
আমার কেমন মনে হচ্ছিল এই জনতার কিছু হবে না। এরা সংক্রামিত হবে না। এদের দায়িত্ববোধ অনেক বেশি, এদের প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক বেশি। মন্বন্তরে মরিনি আমরা, মারি নিয়ে ঘর করি। কে ঘর করেন, কারা মারি নিয়ে ঘর করেন ? না, আমরা নই। আমরা সুখে থাকি। গাড়ি বাড়ি ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স নিয়েই সারা বছর ভাবিত থাকি। থাকি বহুতলে, থাকি ক্ষমতার পাহাড়চূড়ায় বসে, মারি নিয়ে ঘর করেন তাঁরা যারা শত শত মাইল হেঁটে বাড়ি ফিরছেন। চেন্নাই থেকে ফিরেছিল যারা তাদের কাহিনি বলি। অনেক পথ পার করে তারা বরাভূম স্টেশনে নেমেছিল। তারপর হেঁটে গ্রামের পথে। বাড়িতে কি আলাদা ঘর আছে যে কোয়ারান্টিনে যাবে ? গাঁয়ের মানুষই তাদের জন্য ব্যবস্থা করে রেখেছিল। গাছের উপর খাটিয়া বেঁধে মশারী টাঙিয়ে দিয়ে তাদের বলল, ঐভাবে চোদ্দ দিন অশৌচ পালন কর। তারা তাইই থাকল। বুঝুন গ্রামের মানুষের সচেতনতা। তারা জেনেছে এই রোগ প্রথমে লুকিয়ে থাকে, বসন্ত রোগের মতো একটু একটু করে ফুটে উঠতে থাকে। তখন ছোঁয়াছুঁয়ি হলে ছড়িয়ে যাবে। বলছি, এঁরা অক্সফোরডে পড়েন না, এঁরা সুইৎজারল্যান্ড থাকেন না, এদের বাবারা ডাক্তার নন, ব্যবসায়ী নন, কিন্তু এঁরা জেনেছেন কী করতে হবে। একা হয়ে থাকতে হবে চোদ্দদিন। বাড়িতে মৃত্যু মানে বাড়ি দূষিত হয়েছে, মৃত্যুর বীজানু রয়েছে ঘরবাড়ি, মৃতের বিছানা মাদুরে। সুতরাং বাড়ি বীজানু মুক্ত করতে হয়, মৃতের বিছানা পুড়িয়ে ফেলতে হয়, শ্মশান থেকে ফিরলে নিমপাতা।লোহা, আগুনে শুদ্ধ হতে হয়। চোদ্দ দিন অশৌচ পালন মানে কোয়ারান্টিনেই থাকা। এসব আমাদের সামাজিক এবং ধর্মীয় আচার। পক্স হলেও, অমনি বারো দিন পরে নিম পাতা হলুদ দিয়ে স্নান, এই আচার তো সেই কোয়ারান্টিন থেকে মুক্ত হওয়া। সেই শ্রমিকরা বাড়ি না গিয়ে গাছে বাঁধা খাটিয়ার উপরে থেকে কোয়ারান্টিন অশৌচ পালন করতে লাগলেন। হাটেও গেলেন না, বাজারেও না। বুক বাজিয়ে বললেন না, খড়্গপুর থেকে আসা হলো বটে। পুরুলিয়া জেলার খবর এই। কদিন বাদে বিডিও জানতে পেরে অঙ্গনওয়ারি কেন্দ্রে তাঁদের থাকার ব্যবস্থা করেন। মারি নিয়ে ঘর করেও এই ভাবে বেঁচে থাকে এই দেশের মানুষ। এই জনগোষ্ঠীর অসামান্য সমাজবোধ। এই শিক্ষা আমাদের মধ্যে নেই।
আমরা ভয় তাড়াতে সময় কাটাতে কত রকম প্রয়াস না চালাচ্ছি। কেউ বিশ্ব ক্রিকেট একাদশ তৈরি করছেন। আমিও বললাম, আমার নামটা ঢুকিয়ে দাও প্লিজ। শ্যামসুন্দর মিত্র, কল্যাণ মিত্রর সঙ্গে অমর মিত্র...হা হা হা।
সন্ধ্যায় দাদা ফোন করেছিলেন। দৈবপাখি নাটকটি ২৮শে মার্চ মঞ্চস্থ হওয়ার কথা ছিল। হলো না। ৮১ পার হয়ে গেছেন। অনেকদিন পায়ের সমস্যায় ভুগেছেন। বেরোন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বছর দেড়। তারপর এই নাটক নিয়ে ফিরে আসতে চেয়েছিলেন। নাটকের মানুষের নাটক ছাড়া আর ফেরা হবে কীভাবে ? নাটকটি অনেক পরিমার্জন করেছেন। আমি পড়েছি। সক্রেটিস এই নাটকের প্রধান চরিত্র। আমার কাছে দুঃখ করছিলেন, রিহার্সাল খুব ভালো হয়েছিল, ২৮ তারিখের শো খুব ভালো হত, আবার সব নতুন করে গড়ে তুলতে হবে। কবে হবে তা আমার কাছে জানতে চাইলেন। যেন আমি সব জানি। আমি বললেই হয়ে যাবে। বয়স হলে নির্ভরতা দরকার হয়। আমি খবরিয়া। কত খবর রাখি। আমাকে ফোন করে পরামর্শ নেন। খোঁজ নেন দেজ পাবলিশিঙের অপু কিংবা করুণা প্রকাশনীর বামাবাবু কেমন আছেন। সকলে ঘরে থাকছে তো? খোঁজ নিলেন আমরা কেমন আছি। চাল ডাল, আলু, ডিম ঘরে আছে তো ? আমি বললাম তুমি ইউ টিউবে পুরোন ছবি দেখতে পার। দাদা বললেন, ইন্টারনেট আছে, কিন্তু ওসব পারি না। এই বয়সে তা আর সম্ভব নয়। ও বাড়িতে যাঁরা থাকেন সকলে বৃদ্ধ। কেউ ইন্টারনেটের ব্যবহার জানেন না। দাদার হোয়াটস আপ করা অ্যানড্রয়েড ফোনটিও নষ্ট হয়ে গেছে এই সময়। আমি জানি রোদ ওঠার আগে এবং রোদ পড়লে তিনি বসে থাকেন ব্যালকনিতে। সামনে একটি নিমগাছ। একটি কেরল দেশীয় নারকেল গাছ। বাড়ির পিছনে হিমসাগর আমের গাছ। গাছে বৌল এসেছে। তার গন্ধ বাড়িটিকে ঘিরে আছে। এই সুগন্ধ কি ভাইরাস আটকাতে পারবে ? শুনতে পাচ্ছেন দূষণ নেই। আকাশ পরিস্কার হয়ে গেছে। বাতাসে ধূলিকণা কম। হৃদযন্ত্রে একবার বাইপাস এবং স্টেইন বসেছে আর একবার। বাইপাস হয়েছিল ২০০৩ সালে। স্টেইন ২০০৯-১০ নাগাদ। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, শুনতে পাচ্ছি উত্তর মেরুর হিমবাহ গলন থেমে গেছে।
হ্যাঁ, আমি হোয়াটস আপে পেলাম।
দাদা জিজ্ঞেস করলেন, শুনতে পাচ্ছি ভেনিসের ক্যানেলে হাঁসেরা ফিরে এসেছে ?
হুঁ, কে যেন বলল, উটি থেকে কোয়েম্বাটোরের রাস্তায় হরিণ বসে আছে, ফেসবুকে দেখা গেছে।
আমাকেও ফোন করে বলল একজন, আমার অ্যানড্রয়েড ফোনটা নেই, আমি হোয়াটস আপে এসব পেলাম না, আকাশ বাতাস দুশো বছর আগের মতো হয়ে যাচ্ছে ?
হতে পারে।
তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এখন অনেক দূর দেখা যাবে ?
যাবে বলতে দাদা বললেন, আমার ব্যালকনি থেকে অনেকদূর দেখা যাচ্ছে মনে হয়, আগে যা দেখতে পেতাম না, তা...।
৮১ বছর পেরিয়ে ৮২-তে পা দেওয়া অভিনেতা, নাট্যকার, দার্শনিক বসে আছেন তাঁর ব্যালকনিতে। তিনি তাকিয়ে আছেন বহুদূরে। আকাশ বাতাস পরিষ্কার হয়ে গেছে। সীমান্তের অদৃশ্য দেওয়াল সরে গেছে। তিনি দেখতে পাচ্ছেন সব। ঐদিক পুব। তাঁর জন্মভূমি। ঐ দিক পুব, তাঁর ছেলেবেলা...সাতক্ষীরে, ধূলিহর, বেত্রবতী, কপোতাক্ষ, ময়মনসিংহ, কালিহাতি, ব্রহ্মপুত্র, নেত্রকোণা, গারোপাহাড়...সব ফিরে আসছে তার কাছে। আহা, এই জীবনে এমনও দেখা যায়। বাংলাদেশ মনে পড়তে লাগল। খুলনা, রূপসা, ১৯৪৭, লঞ্চঘাটে হারিয়ে গিয়েছিল রঙিন ছাতা। অকালে চলে যাওয়া সেই বোন, ডিলডিল...সকলে মুখ দেখাচ্ছে দূর থেকে।
হ্যাঁ বাংলাদেশের খবর এল, তরুণ লেখক মোজাফফর হোসেন লিখলেন ৩০ তারিখে। কবি এবং উপন্যাস লিখিয়ে ভাস্কর চৌধুরীর বোন করোনা কিংবা নিমোনিয়ায় মারা গেছেন চাঁপাই নবাবগঞ্জে। তিনদিন আগের ঘটনা। ভাস্করের বোনের মৃত্যু সংবাদ আমি দেখেছিলাম। ভাস্কর শেষ দেখা দেখতে যেতে পারেনি। আতঙ্ক। এবং উপায় ছিল না যাওয়ার। করোনা টেস্ট হয়নি। মোজাফফর ভাস্করের কবিতা নিবেদন করেছে ফেসবুকে। তার একটু অংশ...
১
আমার আত্মার কসম
আমি এ লাশ
ফেলতে পারবো না।
এ লাশ আমার বোন ছিলো
অনেক বছর
এ লাশ আমার ভাই ছিল
অনেক বছর
এ লাশ
আমার পড়শী ছিলো
আশি টা বছর
আমি এ লাশ ফেলতে পারবো না
আমি বসে আছি
গায়ে জ্বর
কেউ কেউ চলে গেছে
আমি আছি
আমিও লাশ হবো
এ লাশের সাথে যোগ হবো
এম্বুলেন্স আসলে যাবো
না এলেও যাবো
সকলেই গেল
এ শহর ফাঁকা করে
অন্য কোথাও দালান উঠবে
এখানে মরে গেলে
হাসপাতাল হবে
বাড়ির উঠোন ভরে
কচি ঘাস হবে
লাশের সারে বেড়ে যাবে দ্রুত
তখন হাসপাতালগুলো
প্যাথলজি করে
লিখে যাবে
সর্দি ছিলো
জ্বর ছিলো
কাশি ছিলো
হাঁপানি
চিনি রোগ ছিলো
হার্টের সমস্যা ছিলো
ওরা সব আদ জাতির মতো
গজবেই মরে গেছে।...।
------------
দুই
খবর পেলাম দক্ষিণ কলকাতায় রাতে শিয়াল, ভাম বেরিয়ে আসছে। দিনেও দেখা যাচ্ছে তাদের। রবীন্দ্র সরোবর এলাকায় শিয়াল আছে অনেক। শব্দের ভয়ে তারা বেরোয় না। এখন সব নিস্তব্ধ। তারা নিশ্চিন্তে ঘুরছে ফিরছে। বন দপ্তর লক্ষ্য রাখছে। আজ হোয়াটস আপে নিউইয়র্কের টাইমস স্ক্যোয়ারের ছবি দেখলাম। খা খা করছে জায়গাটি। ওখানেই ব্রডওয়েতে নিউইয়র্কের বিখ্যাত নাট্যমঞ্চগুলি। সব বন্ধ।
দুপুরে দেবাঞ্জন চক্রবর্তী ফোন করেছিল। একটি খবর দিল, আমাদের এই এলাকায় কৃষ্ণমল্লিক লেনে তার বন্ধুর দাদা কোভিড ১৯-এ মারা গেছেন। মৃত্যুর পর তাঁর লালারস পরীক্ষার রিপোর্ট আসে পজিটিভ। তাদের পুরো পরিবারকে পুলিশ তুলে নিয়ে রাজারহাটে কোয়ারেন্টাইনে পাঠিয়েছে। দেবাঞ্জনের ভাই খবর দিয়েছে দাদাকে। সে এখানে দেবাঞ্জনদের পুরোন বাড়িতে থাকে। আমি ভাবছিলাম ঐদিকে ডায়মন্ড টি সেন্টারে যাব চা আনতে। দেবাঞ্জনের কথায় কুঁকড়ে গেলাম। এত কাছে এসে গেছে ? দুপুরে আগাথা কৃষ্টির গল্প পড়তে পড়তে সব ভুলতে লাগলাম। মহামারির ভয় কাটাতে লাগলাম। গত দুদিন ধরে পড়েছি গ্যাব্রিয়েল গারসিয়া মার্কেজ প্রণীত ‘ক্রনিকল অফ আ ডেথ ফোরটোল্ড’। প্রেম ও মৃত্যুর অভাবিত এক বিবরণ, যার সমস্তটাই বলে দেওয়া আছে, কিন্তু সমস্তটাই ক্রমশ অচেনা হয়ে যাচ্ছে। সমস্ত দেশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। নিজামুদ্দিনের জমায়েত হোক, রাম নবমী হোক, সবেতেই জমায়েত হচ্ছে ভালো রকম। ধর্মে মাথা মুড়িয়ে দিয়েছে মানুষ। জমায়েত থেকে কে কোথায় ভাইরাসে সংক্রামিত হয়ে লুকিয়ে পড়েছে তা খোঁজা হচ্ছে। কী দাঁড়াবে ভবিষ্যৎ অজানা। কতদিন গৃহবন্দী হয়ে থাকতে হবে, জানি না। দুপুরে সিডনির তপনজ্যোতি মিত্রকে ফোন করলাম। আমার ২০-২২ বছর বয়সের বন্ধু তপনজ্যোতি বহুদিন ঐ দক্ষিণ গোলার্ধে। ছিল নিউজিল্যান্ডে বহুদিন। এখন অস্ট্রেলিয়ায়। আমাদের দুপুর তিনটেয় ওদের সিডনিতে রাত নটা। আগের দিন ২৪ ঘন্টা কাজ করেছে। ও ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ার, ব্যাঙ্কিং সেকটরে কাজ করছে। সকাল দশটায় কাজ শেষ করে ঘুমিয়েছে। এখন ওদের কাজের চাপ বেশি। ইস্টার পরব সামনে। না, সিডনি খোলা নেই। সমস্ত পরব বন্ধ হয়ে গেছে সরকারি ফরমানে। দিন পনের আগে ও বলেছিল, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য ফুরিয়ে যাচ্ছে মানুষের আতঙ্কের কারণে। আজ বলল, সব কিছু শান্ত হয়ে মেনে নিয়েছে মানুষ। প্রথম সকালে সিনিয়র সিটিজেনরা বেরবেন। তারপর অন্যরা। হ্যাঁ, ইস্টার পরব, ক্রিসমাস পরবে কেনাকাটা বেশি হয়। পরব বন্ধ হলেও অনলাইনে কেনাকাটা হচ্ছে। বেশ চাপ আছে। ঘরে থেকেই মানুষ উৎসব করবে। নানা কথা হতে লাগল। লকডাউনের সুফল ফলতে আরম্ভ করেছে। স্পেন, ইতালি, ব্রিটেনের মতো অবস্থা ভয়ানক হয়নি অস্ট্রেলিয়ায়। তাদের সিডনিতে। তপনজ্যোতি বলল, দেখ অমর, ভাইরাস, এই যমদূতের ঘুম ভাঙিয়েছি আমরা। এমন মহামারি কতবার হয়েছে পৃথিবীতে। আরো হবে। আরো। দূষণ, হিমবাহর গলন এসব শুনেছ তো, আমি আমার নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলি। তপনজ্যোতি হিমবাহর নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার কথা বলল আমাকে। নিউজিল্যান্ডে থাকার সময় আওরাকির মাউন্ট কুক ন্যাশানাল পার্ক দেখতে গিয়েছিল তারা। আওরাকি নিউজিল্যান্ডের দক্ষিণের দ্বীপভূমি। নিকটেই একটি শহর আছে ট্যাইজেল। মাউন্ট কুক নিউজিল্যান্ডের সবচেয়ে বড় পর্বতমালা। মাউন্ট কুক অঞ্চলেই গিয়েছিল তপনজ্যোতিরা। তারপর তাসমান হিমবাহ, হুকার হিমবাহ, লেক পুকাকি, লেক টেকাপো দেখেছিল। সবই হিমবাহ গলে জন্ম নিয়েছে। হেলিকপ্টার তাদের নামিয়ে দিয়েছিল হিমবাহর উপর। সে এক অনন্ত তুষার স্ম্রাজ্য। মাথায় অপূর্ব এক ঘননীল আকাশ। তার সঙ্গের গাইড বলেছিল, ছোটবেলায় তার ঠাকুরদার কাছে শুনেছিল, লেক ছিল না একশো বছর আগে, ঠাকুরদার ঠাকুরদা তাঁকে তাঁর বাল্যকালে বলেছিলেন তা। ছিল হিমবাহ, বরফের বিস্তার ছিল অসীমে। সেই বরফ গলে লেকের জন্ম হয়েছে। তপনজ্যোতি বলল, সেই প্রথম দেখার কুড়ি বছর বাদে আবার গিয়েছিল সেই লেক দেখতে। দেখেছিল লেকের বিস্তার বেড়েছে, আর সেই হিমবাহ দূরে সরে গেছে। কুড়ি বছরে অনেকটাই গলে গেছে তা। এই এক মাস, দেড় মাস, দু’ মাসের লকডাউন হয়ত কিছু দূষণ কমাবে। হিমবাহগুলির গলন কমাবে উষ্ণায়ন কমলে। তার বন্ধু এক জৈব বিজ্ঞানী তাকে বলেছে, আন্টারটিকায় হিমবাহর নিচে লক্ষ লক্ষ বছর যারা ঘুমিয়ে আছে, উষ্ণায়নে বরফ গলে গেলে, তাদের ঘুম ভাঙবে। সভ্যতার বিপর্যয় ঘটে যাবে তখন। তপনজ্যোতিকে ঘুমতে যেতে বললাম। ওদের ওখানে রাত অনেক। ঐ গোলার্ধে এখন শীতকাল আসছে।
কিছুই করার নেই। বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলছি ফোনে। বই পড়ছি। স্ত্রী পুত্রের সঙ্গে কথা বলছি। ভবিষতের কথা আন্দাজ করতে চাইছি। নেট অনুসন্ধান করছি। করতে করতে অনলাইন আনন্দবাজার পত্রিকায় ১৮৯৮ সালের মহামারির কথা পেয়ে গেছি। প্লেগ মহামারি হয়েছিল। দলে দলে মানুষ পালিয়ে যাচ্ছিল কলকাতা থেকে, সেই বিবরণ রয়েছে ‘ অনুসন্ধান ‘ নামে এক পত্রিকায়। সেই বিবরণ না শুনিয়ে পারছি না। খবরটি বেরিয়েছিল ১৩০৫ সালের ২৫শে বৈশাখ। কবির জন্মদিনে।
“কলিকাতার লোকের আতঙ্ক ভয়ানক বৃদ্ধি পাইয়াছিল। সকলেই বৈভব দূরে ফেলিয়া পুত্রকন্যা সঙ্গে লহিয়া শহর ত্যাগ করিবার জন্য প্রস্তুত হইল। কী ধনী, কী নির্ধন, কী বৃদ্ধ, কী বালক, কী যুবক, কী যুবতী– সর্বসাধারণের সে আশঙ্কা, সে ভয়, সে ভাবনা সহজে বর্ণনা করা যায় না। কেহ রেলওয়ে স্টেশন অভিমুখে, কেহ স্টিমার ঘাটে, কেহ নৌকা সন্ধানে, কেহ গড়িতে, কেহ পদব্রজে- যে যেরূপে যেদিকে সুবিধা পাইল সে সেইরূপ সেইদিকে ছুটিতে লাগিল।...সহস্র সহস্র লোক ভাগীরথীর বক্ষে হাওড়া স্টেশন অভিমুখে ছুটতে লাগল। স্টেশনে দুই হাজার করিয়া লোক বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। টিকিট কিনিয়াও স্থান না পাইয়া সেদিন ৫০০ লোক ফিরিয়া আসিল। অবস্থা বুঝিয়া রেল কোম্পানি নিয়মিত ট্রেন ব্যাতীত অতিরিক্ত তিনখানি ট্রেনের বন্দোবস্ত করিলেন। সমস্ত ট্রেনই পরিপূর্ণ হইয়া গেল। শেষে মালগাড়িতে লোক লইতে বাধ্য হইলেন। স্টেশন হতে পোল পর্যন্ত লোকের ভিড়ে চলাফেরা বন্ধ হইয়াছিল। শেষে গাড়ি, পাল্কি, নৌকা মেলা ভার হইল। অনেক পুত্র-পরিবার লইয়া ব্যতিব্যস্ত হইয়া হাঁটিয়া পলাইতে আরম্ভ করিলেন’। তখন গুজব রটে যে কোয়ন্টাইন জারি হবে।”
না এখন কেউ প্রাণভয়ে পালাচ্ছে না। বরং গৃহে বন্দী হয়ে আছে। ঘর থেকে বেরলেই অদৃশ্য ঘাতকের ছায়া। চৈত্রের বাতাসের ঢেউ শুরু হয়ে গেছে। সেই বাতাসের গায়ে পেনসিল, কলমে এসব লেখা এমনিই ভেসে যাবে।
অমর, এটি একটি অসাধারণ আলেখ্য বর্তমান কঠিন, নিষ্ঠুর সময়ের ওপরে, আরো এইরকম দিনলিপি লিখো, এইগুলি সময়ের ঐতিহাসিক দলিল হয়ে থাকবে |
ReplyDeleteআহা,দুখজাগানিয়া লেখা। পড়ে চোখ আপনা থেকেই জলে ভরে ওঠে !
ReplyDeleteঅসাধারণ
ReplyDelete