গিরগিটি
ধূসর রঙের প্রাণীটা সরসর করে
চলে গেল পোড়ো বাড়ির ভাঙা পাঁচিলের মাথা বেয়ে। কিছুদূর গিয়েই লাফ মারল, ছিটকে পড়ল
জংলা লতাপাতার মধ্যে- আমার থেকে দু’হাত দূরে- রঙ
পাল্টে হল সবুজ। শিউরে উঠলাম... শুনেছিলাম ঠাকুমার কাছে, গিরগিটি চোখ গিলে খায়।
ভয়ে পিছিয়ে গেলাম দু’পা, নিজের অজান্তেই... জঙ্গলে আর বল খুঁজে কাজ নেই। ঠিক সেই
মুহূর্তেই গিরগিটিটা লাফিয়ে উঠল- তার লেজটা শরীরের তিনগুণ লম্বা, সরু, কেউটের ফণার
মতো উঁচু হয়ে দুলছে- কামড়ে ধরল, বনফুলে মধুপানরত এক প্রজাপতিকে। আর সহ্য করতে
পারলাম না আমি- দৌড় দৌড়, দৌড়...! পালিয়ে এলাম।
সেই রাতে দেখলাম ভীষণ স্বপ্ন এক।
একটা সুবিশাল লাল রঙের, নীল চোখের গিরগিটি আমার বিছানায় উঠে আসছে, আমি পালাতে
পারছি না... তার লেজ গোটা ঘরের সমান। তারপর দিন, আবার একই স্বপ্ন... এরকম চলল এক
সপ্তাহ- টানা। বুঝতে পারলাম, গিরগিটিটাকে নিকেশ না করলে আমার ভয় যাবে না। তাই, মনকে
সাহস জুগিয়ে ফের চললাম, সেই পোড়ো বাড়ির জঙ্গলে। আর কি খুঁজে পাব তাকে?
পেলাম। সে হলুদ রঙের এবার,
ঝরা-পাতার স্তূপে। একটা বড় দেখে কার্নিশ-ভাঙা চাঙর তুলে নিলাম, সঠিক মুহূর্তের
অপেক্ষা করে, পেশাদার আততায়ীর নৈপুণ্যে, অব্যর্থ লক্ষ্যে নিক্ষেপ করলাম হাতের
অস্ত্রটি। মুহূর্তেই, গিরগিটির শরীর চাপা পড়ল, তার দেহটা ক্রমে বদলে গেল চাঙর-রঙে।
কিন্তু, দীর্ঘ, গা ঘিনঘিনে লেজটা বেরিয়ে থাকল চাঙড়ের বাইরেই- সেটা কাটা-মুণ্ডু
মুরগীর ধড়ের মতো তিড়িংবিড়িং করে নাচছিল। আমি এবারও আর সহ্য করতে পারলাম না, দৌড়
দিলাম... জানতাম, আর সে স্বপ্নে ভয় দেখাতে পারবে না, সে মৃত। জানতাম না, তার গা
ঘিনঘিনে লেজটা এবার স্বপ্নে আসবে- যাকে হত্যা করার কোনও উপায়ও আমার নেই।
অন্ধ-তারার আলো
তারাখচিত রাতের আকাশ। যেন কালো
স্লেটের ওপর জোনাকি জ্বলছে। বছর সাতেকের বাচ্চা ছেলেটি ছাদের পাঁচিলের ধারে
বসেছিল। সঙ্গে, তার থেকে দু’বছরের বড় দিদি। আচমকাই দিদি চিৎকার করে উঠল, ‘ভাই,
ভাই! তারা খসল, আকাশ থেকে...!’ ছেলেটি অন্ধ, সে দেখতে পেল না কিছুই। শুধু মনে-মনে এই প্রার্থনা করল, ‘আমার মা’কে ভাল
করে দাও।’ এই ধরণের তারা-খসাকে বলে ‘শুটিং স্টার’, বাংলায় উল্কাপাত। ছেলেটি
শুনেছিল, শুটিং স্টারের কাছে প্রার্থনা জানালে- সেই প্রার্থনা সফল হয়।
দীর্ঘদিন ধরে তাদের মা অসুস্থ। ছেলেটি জ্ঞান হওয়া থেকে জেনে আসছে, মা বিছানা ছেড়ে
উঠতে পর্যন্ত পারেন না। যদিও কোনোদিন সে মাকে দেখেনি, যেহেতু জন্মান্ধ- তবুও সে ঘ্রাণ নেয় মায়ের শরীরের, শাড়ির, বিছানার। সেই গন্ধ লেগে থাকে তার আঙুলে, শরীরে, মাথার
ভিতর, স্মৃতি-বিস্মৃতির গভীরে। কোনো-কোনোদিন রাতে, কষ্ট হলে, সে মা’কে জড়িয়ে ধরে ঘুমায়। গোপনে কাঁদে। মা কবে ভাল হবে?
একদিন মা ওকে কাছে ডেকে, মাথায়
হাত বুলিয়ে বললেন, ‘তুই আবার চোখে দেখবি, সোনা।’ অন্ধ ছেলেটি আনন্দে লাফিয়ে উঠল। সত্যি!
‘হ্যাঁ, সত্যি!’ মা স্নেহ-মাখা
অথচ আর্দ্র স্বরে বললেন, “তবে, আমি চলে যাব।”
শুনেই আঁতকে উঠল ছেলে। বলল,
“কোথায়?”
“দূরে। অনেক দূরে। তারা হয়ে
যাব... আকাশের,” মা কান্না চেপে নিলেন, ‘আকাশে তাকালেই আমায় দেখতে পাবি।”
তারপর, একদিন ছেলেটির চোখ সেরে গেল।
সে দেখতে পেল, আলো, মাটি, মেঘ, জল আর আকাশের হাজার-হাজার জোনাকির মতো উজ্জ্বল তারা। কেবল একজনকেই দেখল না সে। তার মা। তাই, সে বসে
থাকে, রাত জেগে, আকাশের দিকে তাকিয়ে; আকাশে লক্ষ-কোটি তারা, তাদের
মধ্যে কেউ না কেউ একজন তার মা। কিন্তু, কোন তারাটা? সে বুঝতে
পারে না। বোবা, শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকে নক্ষত্রপুঞ্জের দিকে। অথচ তার মায়ের চোখের
তারা এখন তার চোখে, তার চোখের আলোয়।
অপর
আমি তাকে চিনতাম না, সেও আমাকে
চিনত না। আমি কাজ করতাম দশটা-পাঁচটা, দিনের আলোয় আর, তার কাজ ছিল রাতে, সকলের
অলক্ষ্যে, একাকী। আমার কাজ ছিল ক্লান্তিকর, মুখ বুজে সহ্য করে যাওয়া কত কিছু,
শরীরে বর্ম পরে বিরুদ্ধতা করা নিজের। সে ছিল মনের সুখে, রাজার মতোই। আমাকে পাত্তা
দেয়নি কোনোদিন। তারপর, একদিন আমাদের দেখা হল, রেলব্রিজে- নিচে সশব্দে ছুটে যাচ্ছিল
একের পর এক মেল ট্রেন। সে আমাকে বলল, “কেন পড়ে থাকো তুমি এত অপমান, এত
তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য সহ্য করে? কী পাও? লজ্জাশরম কি একটুও বেঁচে নেই?” আমি বললাম,
“তোমার জন্যই সব সহ্য করতে হওয়া আমাকে। যদি একটু বুঝদার হতে, আমার জীবনটা অন্যরকম
হত আর তুমিও থাকতে না। বেশ হত।” শুনে, সে ‘হো, হো’ করে হেসে উঠল। তারপর, আমার পিঠে
এক চাপড় মেরে বেরিয়ে গেল ‘সিটি’ দিতে দিতে। সেদিনও আমরা, আমি ও সে, কেউ কাউকে
চিনতে পারলাম না- অথচ, আমরা দু’জন, একজন মানুষ!
বাহ।। সুন্দর
ReplyDelete