Monday, April 13, 2020

বিশেষ নিবন্ধ অশান্ত সমুদ্রে ভাসছে আমাদের জলযান বিশ্বদীপ চক্রবর্তী





এক একটি পরিবার আজ হঠাতই এক একখানা প্রস্তুতিহীন আস্ত জাহাজ। সমুদ্রে পাল তুলে চলেছে নিজের নিজের জীবন তরণীর।   
কি গো যাত্রীরা গন্তব্যের কিছু জানা আছে নাকি?
ও নাবিক কোথায় নিয়ে চলেছো? জানো কিছু তার? কোন অক্ষারেখা কোন দ্রাঘিমারেখায় পৌঁছালে তবে এই যাত্রার ক্ষান্তি?
ভোঁ দিতেই বাধ্য নাবিকের মত দড়িদড়া খুলে ভেসে পড়েছি সবাই। এখন মাস্তুল ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছি। ভাসার আগে যে যা পেয়েছি রসদ তুলে ভাঁড়ার বোঝাই করেছি। কে জানে পারে ভিড়ানো যাবে না কত দিন, কত মাস।
থাকবে তো রসদ, ততদিন? উত্তরের অপেক্ষা না রেখেই যাত্রীরা একে অপরকে প্রশ্ন করে। 
চালিয়ে নিতে হবে। সমুদ্র যাত্রায় খুদকুড়োও ফেলনা নয় কিছু। অপচয় করা যাবে না। সাবধান করতে করতে চিফ মেট সব রসদ হিসেব করে তুলতে থাকে। 
কাপ্তান অভয় দেয় যাত্রীদের। হিসেব মত চলতে পারলেই একদিন ঠিকঠাক নিশ্চিন্ত ডাঙ্গায় পৌঁছে যাবো।
মাংকি আইল্যান্ডে উঠে জাহাজের বড় নাবিক চোখে দূরবীন ঠেকালেন। যতদূর চোখ যায় কোন জনপ্রানী নেই যে।
ওই যে? একটা কাঠবেড়ালি? ডেকের উপর লেজ তুলে সন্তর্পণে চলেছে। আঙ্গুল তুলে দেখাল সেকেন্ড মেট।
আর ওই যে পাখিটা মাস্তুলের উপর? আমাদের সঙ্গেই যেন চলেছে, সমুদ্র যাত্রায় পাখি সঙ্গে থাকা বড় পয়মন্ত। সারেং-এর চোখের জালিতে একমুঠো বিশ্বাস। 
মন্দ কি, একটু বৈচিত্র্য। দিনের পর দিন ভেসে বেড়াবার জীবনে এরাই হবে বেঁচে থাকার খোরাক।
তাই বলে আবার এদের খাওয়াতে ছুটো না যেন। স্টুয়ার্ট পইপই করে সাবধান বানী শোনায়।
শুনেই থার্ড মেটের চোখ ছলছল, ওদের তো আর নিজেদের ভাঁড়ার নেই। ওরা বাঁচবে কি করে?
আমাদের তাতে বয়ে গেছে, খুঁটে খাবে। মুখে কড়া কথা বললেও স্টুয়ার্টের নাকের ডগা দিয়ে যখন পাখির খাবার ছড়ানো হয়, দেখেও না-দেখা করে থাকেন। 
আর সব জাহাজ ছেড়েছিল তো?
রেডিও অফিসার খবর আদান প্রদান করেন অন্য জাহাজের সঙ্গে। ক্যাপ্টেনের এই প্রশ্নে চোখ তুলে তাকাল। জানা গেল বন্দর ছাড়ার আগেই এক জাহাজে অসুখ ঢুকে পড়েছিল। সে জাহাজ আর ছাড়ল না।
হে ভগবান, তাহলে ওদের কি হবে? থেকে যেতে হবে ডাঙ্গায়? সারেং আর্তনাদ করে উঠলেন।
না, নামতেও পারছে না। এখন তো ওরা কোয়ারেন্টাইন।
ক্যাপ্টেন নিজের জাহাজের খোঁজ খবর চান এবার, আমাদের জাহাজে সবাই দুরস্ত আছে তো?
দুই একজনের সী সিকনেস হচ্ছে, এছাড়া সব ঠিকঠাক।
তাহলে চলতে থাকো। কারো জন্য এখন থামার উপায় নেই। সবাইকে এখন ভেসে বেড়াতে হবে, এগোতে হবে নিজের পথে যতদিন না নোঙর ফেলার জন্য জুতমত একটা তীর পাওয়া। খুঁজে পেতে হবে এমন এক বন্দর যেখানে কোন অসুখ নেই, জরা নেই, মৃত্যু নেই, শোক নেই। বুঝেছ সবাই? দিগন্তে চোখ রেখে বসে থাকো, ওয়াচে আছো তো সবসময়ে? 
হট্টমালার দেশের খোঁজে এমনিভাবেই ভেসে চলে এই অলৌকিক জলযান। সমস্ত জাহাজের সব যাত্রীর মত তাদের মনেও বিশ্বাস এই জাহাজের মাথায় আছে আশীর্বানী। আশ্বাস দিয়েছে কাপ্তান। সব ভাল হবে, পৌঁছে যাবে একদিন নিশ্চিত ভরসার জায়গায়।
তবু একেকদিন আকাশ কালো হয়ে আসে। দেখা দেয় ভয়ানক দুর্যোগ। আকাশ ঠিক ভেঙ্গে পড়বেই এইবার। মাস্তুলের দড়িদড়া ছিঁড়ে যেন উতাল বাতাসে উড়ে যাবে এই জাহাজ। তুষার বৃষ্টিতে অন্ধকার আরও গভীর। পোর্ট হোল খুললেও কিছু দেখা যাচ্ছে না কোথাও। শব্দতরঙ্গে এদিক ওদিক জাহাজডুবির বার্তাও ভেসে আসে বুঝি।  রেডিও অফিসার, কে গেল? কাদের পালা ছিল এবার? এই যাত্রায় পেছনে তাকিয়ে দেখার দস্তুর নেই। বিগতরা দ্রুত সংখ্যা হয়ে যায়। সংখ্যারা জাহাজের মাথায় খলখল করে হাসতে হাসতে নেচে বেড়ায়। সবাই জড়ামুড়ি করে, আয় আমরা বেঁধে বেঁধে থাকি।
ক্যাপ্টেন আশ্বাস দিতে চায়। ভেবো না তোমরা। অচিরেই আয়ত্তে এসে যাবে এই ঝড় ঝঞ্ঝা। গলা ছেড়ে হাঁক দেয়। রেডিও অফিসার! কি খবর আসছে শব্দ তরঙ্গে? কেন তোমার মুখে কথা সরছে না এখন? জাহাজের নাবিক, সেকেন্ড মেট, থার্ড মেট এমন জবুথবু হয়ে গেলে কেন তোমরা সবাই?
কাপ্তানের এতো হাঁকডাকেও সাহস জাগাতে পারছে না যে। সবার চোখে ভয়ের ছায়া। শুধু সারেং-এর কোন হেলদোল নেই। বরং সে শোনায় আগের আগের ঝড়ের কথা, এটা তো তার প্রথম সমুদ্র যাত্রা নয়! যেদিন দক্ষিণ সমুদ্র এমনি উত্তাল ছিল আর তাদের পুরনো মাস্তুলভাঙ্গা জাহাজ কেমন খাবি খাচ্ছিল, কথকতা শোনানোর মত সুর করে শোনায় সারেং। সেই জাহাজের কাপ্তান কেমন মাথা ঠান্ডা করে সামলাচ্ছিল তাদের জাহাজ। ছিল বটে সে এক বাজখাঁই লোক। কম্পাস গেছিল ভেঙ্গে, দিকনির্দেশ ছিল না কোথাও। তবু তাকে হার মানানো সহজ ছিল না মোটে।  শেষে কেমন এক বিশালকায় পাখি উড়ে উড়ে তাদের পথ দেখিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল শান্ত সমুদ্রে। শুনতে শুনতে সবাই সারেংকে ঘন হয়ে ঘিরে আসে, তাদের শরীর আবার সাহসে ডগমগ করে ওঠে। 
চিফ মেট দৌড়ে মাংকি আইল্যান্ড উঠে আরও সবাইকে জানাতে চায়। শুনছো, কে কোথায় আছো! ভয় পেয়ো না কেউ। তোমরা কি জানো না এমন আগেও হয়েছে। এরকম উত্তাল সমুদ্রে প্রাণ হাতে করে জাহাজে পাড়ি জমিয়েছে আমাদের মত মানুষ। সব দুঃস্বপ্নের রাতের মত এই কাল রাতও একদিন শেষ হবে। ভয় পেয়ো না কেউ, শুধু সজাগ থাকো। সতর্ক থাকো। এই অশান্ত সমুদ্র এক সময় নিবিড় হবে, হবেই। আমাদের জীবন তরণী আবার তড়তড়িয়ে এগিয়ে যাবে। 
তেমনি আর এক সকালে আকাশ ঝকঝকিয়ে ওঠে। রেডিও তরঙ্গে অন্য জাহাজিদের বিপদমুক্ত হবার খবর আসে। জানা যায় কোয়ারেন্টাইন হওয়া জাহাজও ছেড়ে দিয়েছে আবার। আনন্দের উল্লাস ছড়িয়ে পড়ে জাহাজের কোনে কোনে। এও তো এক রকমের জয়। একজন জিতে অন্যদের আশ্বাস জোগায়। ডেকে আবার কাঠবেড়ালিটা আনন্দে নেচে ওঠে।  জাহাজে এখন ক্রুজ শিপের আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে। উতসব। লাস্যময়ী তরুণীরা নাচতে নাচতে নেবে আসছে ডেকে। তরবারি ঝনঝনিয়ে রাজকুমার আসছে রাজকন্যার সন্ধানে। জাহাজের যাত্রীরা উবু হয়ে বসে দেখছে। নাবিক তার ওয়াচ ডিউটি ভুলে গেছে, রান্না ছেড়ে স্টুয়ার্ড প্যাকেজ খুলে খাবার গরম করে বেড়ে দিয়েছে, সোনামুখ করে সেটাই খাচ্ছে সবাই। কাপ্তান উদ্গিগ্ন হয়ে তাকালে স্টুয়ার্ট আশ্বস্ত করে। যেন তার অন্নপূর্ণার ভান্ডার। আছে আছে, ভয় করোনা ক্যাপ্টেন। রসদ এখনো মজুদ।
জানে ক্যাপ্টেন, বোঝে না কি? যতদিন যাবে রসদ তো কমতেই থাকবে। খরচ করতে করতে রাজার আঁড়তও একদিন তলানিতে ঠেকে। বুকের ভিতর গুড়গুড় করে ওঠে তার। পারবে তো সবাইকে সামলিয়ে নিয়ে যেতে? কদিন বাদে সি সিকনেস দেখা দেবে, অস্থির হয়ে উঠবে সবাই ডাঙ্গায় নেবে রোজকার জীবনে পা রাখার জন্য। একটু একটু করে খাবার কমে আসবে, জল ফুরাতে থাকবে। মন দুর্বল হতে থাকবে। কাপ্তানের কথা শুনতে চাইবে না তখন কেউ আর। বেশি দেরী হলে ওদের বিশ্বাসে চিড় ধরবে।
কাপ্তান জানে ওটাই আসল শক্তি। বিশ্বাস, শুধু এক অপরের জন্য ভরসা অটুট রাখতে পারলেই ভেসে থাকা যাবে। চলতে চলতে ইঞ্জিন দুর্বল হয়ে পড়বে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভেঙ্গে পড়তে পারে জাহাজ। তবু এই জলযানকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে, ভাসিয়ে রাখতে হবে। হাতে হাত ধরে থাকা চাই। মনে করিয়ে দেয় চিফ মেটকে। সারেং-এর চোখ থেকে ফিরে ফিরে খোঁজে আশ্বাস। 
সবাই আশায় বুকে বেঁধে ভাসতে থাকে নিরাপদ বন্দরে নোঙর নাবানোর প্রতীক্ষায়।       

No comments:

Post a Comment

একনজরে

সম্পাদকীয়

একটি বিষয়ে আমাদের সকলের একমত হতেই হবে ভিন্ন মতের ও ভিন্ন রুচির বহুস্তরকে সম্মান জানিয়েও, যে, আমরা এই মুহূর্তে প্রায়শ্চিত্ত করছি। মানুষ...

বেশিবার পড়া হয়েছে যেগুলি