Monday, April 13, 2020

দীপকরঞ্জন ভট্টাচার্য-এর কবিতাগুচ্ছ





রূপকথা






নৈঃশব্দ্য অগ্রন্থিত। পর্বতগাত্রে এইমাত্র প্রথম লোককবিতাটি লিখেছেন দেবদত্ত। স্বপ্নসখা এক দেবদাসী, সুতনুকা। ছেনির ফ্যাকাশে দাঁতে ভালোবাসার জন্য কুর্নিশ। গাঢ় নীল ওষ্ঠপুটে কার নিশান্তের বিষ। রামগিরি পাহাড়ের খর পিঠে ভোর ভোর যুদ্ধপ্রস্তুতি শুরু হয়। দুপুর একেশ্বর হবে ধীরে ধীরে সব চরাচরটুকু জুড়ে



গ্রন্থবীর্যগুলি হাতে এসে লাগে। এখন সকাল নয়, মধ্যদিন কিংবা গভীর রাত্রিও নয়। পরিখার জলে গুপ্ত আক্রমণে প্রস্তুত প্রাচীন রাজাদের ছায়া কাঁপছে । তরবারি ছিঁড়ে কার দীর্ঘশ্বাস মাটিতে ঝরে পড়ে!  সুবিশাল কাঠের ঘোড়া নারীস্তনের মতো ছন্দোময় , ভিতরে মৃত্যুসেনা। ঘৃণার  খড়কুটো সব জ্বলে ওঠো এবার



নিবিড় ঘন ছায়া। মজা বাঁওড়ের ওপর দিয়ে লাল প্রজাপতি উড়ে যায় -- এই দৃশ্যে কোথাও  অতিরঙের আশ্রয় নেই। শান্ত মাঠে দু'জন  হোমগার্ড চেয়ারে বসে ঢুলছে। অদৃশ্য এসে জরুলের মতো তেঁতুলের  গুড়িতে ঠেসান দেন। স্যালোর জলে রং-কারখানার রক্তদাগ ক্রমশ বৃদ্ধের পুরুষের মতো লঘু হয়ে আসে।  পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এসেছে --  ' সম্প্রীতি বজায় রাখুন'। এটি মোর গ্রাম। কীর্তনের খোল তৈয়ার হয় জানামাত্র শ্রী চৈতন্যের ভাবসমাধি হয়েছিল এই মাটিতে। ছোটো-বাইরেরত দু'টি কুকুর আনমনা দিগন্ত কাঁপিয়ে ছুটে যায়




মহাফেজখানার আলোগুলিকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হল। রাত যথেষ্ট এখন। অতীত আশ্চর্যরকম ক্লান্ত। পুণ্যাত্মা  নবিরা নাক্ষত্রবাগানে ঘুরতে এসেছেন। কম্পিত বায়ুমণ্ডল পেরিয়ে সেই একই ইতিহাস  মহাকালের বিজন চাদরে কুরুশের কাজ তোলে। নদীচরের ওই শ্বেত ঘোড়াটির নাম তবে উচ্চৈঃশ্রবা। প্রতারণার  কৃষ্ণসর্পরা লেজটি মাঝে মাঝে কাঁপিয়ে তুলছে তার।  এত পাথর, সেতুবন্ধনের দিন তবে কি সমাগত



হতে পারে নভেম্বরের দু'তারিখ কিংবা অন্য কোনো প্লাবিত দিনের কথা। রহস্যময় আত্মাদের সঙ্গে খেলতে খেলতে রোদ্দুর পেরিয়ে এক বারোমেসে অন্ধকারে ছলাৎছল বেজে ওঠে সম্বিতহীন  বাজনাগুলো। রাতের ঘন সর ঠেলে  তখনও পূর্বপুরুষদের ছাই উড়িয়ে দেয় নি কেউ ভারী বাতাসে! শহরকে থমথমে প্রতীক্ষায় রেখে ঘড়ির কাঁটাগুলো বিকট শব্দ তুলে ঘুরতে বেরিয়েছে নগরগোলক। সবজি কাটার ছুরির গায়ে বাসা বাঁধে  নিঃসঙ্গ মরচে। অযাচিত শান্তি কায়েম করে এক অন্ধ গলির শেষে ক্যাঁচোরক্যোঁচোরসহ ঝুলে থাকে এক রংচটা বিপুল হাতপাখা




সকালগুলো ভেঙে পড়েছে। বিপজ্জনক বাঁক নিতে নিতে সে এসে আমার উপর চেপে বসল। রঙে-চুবোনো পুরনো কাপড়গুলো নদীচরে কমনীয় হাওয়ার খেলায় মাতে। দরজার খিল যতই আঁটো তবু তার অন্তরঙ্গতা ছুঁয়ে দেবে আমাদের। বুকের কাপড় নামাতেই বউকে আজও চকমকি ঠুকে রক্ষা করে অরণি। বালির সমুদ্রের মধ্যে তলিয়ে যেতে যেতে শুনি সুপর্ণপক্ষীরা ডাক দিয়ে উড়ে যায়। দাবার বোড়েটা তার দিকে ঠেলে আরও কিছুটা সময় আমিও তুলে নিতে চাই। কতবার একই কথা থমথমে স্টিমারের মতো জল কেটে গেছে মনে হয়




মায়াহরিণীর কান্না শোনা গেল এ'সময়ে। একা একা জোছনায় ভিজে সে ঘরে নিয়ে আসছে সমস্ত পৃথিবীটা। সঙ্গমক্লান্ত সদ্যকিশোরীর জটপড়া চুল ফুটপাথের উলটো পিঠে ঘষা খায় ঘুমের মধ্যে পাশ ফিরতেই। নীরবতা বড়ো করুণ, ডানাছড়ানো মানুষের শান্তি কেড়ে নেয়। কারুকাজ করা রুপোর রেকাবিগুলোতে কারো কোনো লোভ নেই আজ। ঘুমের মধ্যে  স্বপ্নের সাইকেল ট্রিং ট্রিং বাজিয়ে ছেলেটা পেরিয়ে গেল আভাসির চাটান।  বারুদের স্তূপ তাকে ছুঁতে পারে না। রাতের সার্কাস নেমে থমথমে দিন থেকে সারাদিন বরফ সরায়




স্বপ্নস্নাত যুবতীর জন্য ভ্রূমধ্যের এই  পাখি। জাদুকরের খেলা থেকে দেশকালহীন পাখিটি  উড়ে এসেছে। পুলিশ ব্যারাকের সাইরেনের ওপর বসে মায়াপালকের রং ফেরাতে  আপাতত ব্যস্ত। নিজেকে উৎসর্গ করার জন্য প্রস্তুত হয় সে। কোথায় সেই মেয়ে? রাস্তায় আলো কমে এলে অন্ধকারের নদী পারাপার করে উৎসবপ্রিয় মাতাল। ভিখারিরা পিঁপড়ের মতো সারি দিয়ে জল পেরিয়ে গেছে দুপুরেই। ফাঁকা বাড়ির লিফটগুলো স্বর্গের দিকে,  আরোহীহীন। হারুণ অল রশিদ মাথা ঝুঁকিয়ে রাস্তা পার হলেন এইমাত্র




নীরবতার শৈলীগুলো ঝিনুকের মতো লাজুক। লোহার বর্ম পরা সেকেলে কাঠের দরজা ঠেলে বন্ধ মাংসের দোকানে একা এক বুড়ো এসে দাঁড়ায় । জল্লাদের দল এইমাত্র বদ্ধভূমি থেকে হাসিমুখে ফিরে গেছে। অ্যাসফাল্টের বুকে লাশ নিয়ে যাওয়া গাড়ি থেকে মাঝেমধ্যে দু'একটা স্বগতোক্তির ক্ষীণ আভাস চুইয়ে পড়ে। কমদামী একটা ধুপের গন্ধ মেঠো ইঁদুরের মতো বারান্দাগুলো চষে ফেলছে। একটা হাওয়া-ভরা পুতুলের মধ্যে নিজেকে লুকিয়ে যে যার মতো ভেসে পড়ে বেলুনে

১০

যৌনপল্লীর রাতগুলো  জলের মতো নীচু । মোমের আলোয় এক একজন পালা করে ভূতের গল্প শোনায়। নারীশরীরের ঘামে গন্ধে ক্লান্ত পোষা বিড়ালটা আর তেলচিটে ছাপধরা দরজাগুলো আলস্যে ঝিমচ্ছে। ভালোবাসার নদীপাড়ে কমলালেবু বাগানে পিট্টু খেলতে গেল কিশোরীরা। তিন দিনের ব্ল্যাক-আউটে স্বপ্ন থইথই মিনাবাজার। জাজিমটা ছড়াতে ছড়াতে শহরসুদ্ধু লোক উপচে পড়ে সেখানে। গল্প শোনার নেশায় ওষুধবিশুধে ভেজানো পরিডানাগুলোর দিকে কেউ  তেমন নজরই দেয়নি


1 comment:

  1. এ-জগৎ যেন আমাদেরই, অথচ কোনও পতঙ্গডানায় উড়িয়ে নিয়ে দেখানো হল আমাদের, এত মায়া, আর তবু এত নিরাসক্তি সেই দেখায়। যেন কোনও অদেখা দিগন্ত থেকে কোনও এক আগামীকালের কথা ভেসে এল আজকের ঘোলাটে চত্বরে।
    ধন্যবাদ দীপকরঞ্জন, এমন কবিতার জন্যই যে অপেক্ষা, আমাদের সকল মূঢ়তা আর জড়তার গ্লানির ভিতর দিয়ে, সেই কথা মনে করিয়ে দিলেন বলে।

    ReplyDelete

একনজরে

সম্পাদকীয়

একটি বিষয়ে আমাদের সকলের একমত হতেই হবে ভিন্ন মতের ও ভিন্ন রুচির বহুস্তরকে সম্মান জানিয়েও, যে, আমরা এই মুহূর্তে প্রায়শ্চিত্ত করছি। মানুষ...

বেশিবার পড়া হয়েছে যেগুলি