Monday, April 13, 2020

করোনামাহাত্ম্য পাঁচালি : যশোধরা রায়চৌধুরী





হিন্দোল বাবু বলিয়াছেন করোনা লইয়া কবিতা লেখা চলিবে না। তবে এ বাঙালি করে কী? সেই মেট্রোপলিটান যুগ হইতে, এথেনিয়াম ইনস্টিটুশনের মাস্টারমশাইয়ের আমল হইতে কবিতা লিখিতেছি, এবার না লিখিয়া পারি?

হে করোনা অতিমারী
আমি কি ভুলিতে পারি
 আজি হতে শতবর্ষ আগে সেই  স্প্যানিশ ফ্লু
সেই তোর মাতামহী
কোভিডে প্রভেদ নাহি
ধনী ও গরিবে সবে ডেকে বলে  : ত্রাহি ত্রাহি
আপামর নরকুল হল বেয়াকুব  তাহে  নাহি কোন ক্লু!

দ্যাখ না দ্যাখ কী চমৎকার কবিতা নামাইয়া ফেলিলাম, এইরূপে সকল বাঙালি একটি একটি নামাইলে টেস্ট কিটের বা পি পি ইর তুলনায় বেশি সংখ্যক হইবে। তাহার পর প্রদীপ জ্বালাইয়া কি থালাবাসন বাজাইয়া সেই কবিতা সবাই মিলিয়া গান করিয়া গাহিব, তাহাতে ভাইরাসের সাধ্য কী , না পালাইয়া!!!


মার্চ ২০২০
 আমাদিগের ন্যায় বয়স্থ ব্যক্তিগণের মনে পড়িবে, আশির দশকে পাড়ায় পাড়ায় ভাইরাল ফিভারের চল উঠিয়াছিল। শরীরে বিষব্যথা, প্রচন্ড জ্বর। সাতদিন হইলেই পগার পার। এক এক পরিবারে সকল মেম্বার শয্যাশায়ী। কেহ বাস বা কেহ ট্রেন হইতে আনিল, বাকিরা ভুগিল।  তখন হাত ধুইবার আর সেলফ আইসোলেশনের বিধানগুলি জানিতাম না। কেহ কেহ বৃদ্ধ বুজুর্গ ব্যক্তি রেস্পিরেটরি পাকে পড়িয়া ভোগের ওপারে চলিয়া গেলেও নাম ছিল না তাই গণনাও ছিল না। আমপোড়ার সরবত, মশারি ইত্যাদিই তখন  কাজে দিত। অকারণ ডাক্তারখানায় যাইতাম কদাচিৎ কেহ কেহ।  কিশোরী আমি এই করিয়া করিয়া এক ধেড়ে ডাক্তারের প্রেমেও পড়িয়াছিলাম কিছুদিনের জন্য। সে কেবল স্টেথো বসাইত। তখন বাঙালির খুব নতুন নতুন অ্যন্টিবায়োটিক পাইয়া শখ হইয়াছে। তাই  ফুলিয়া ফাঁপিয়া উঠিল সিফ্রান টিফ্রান নামের অ্যান্টি বায়োটিক। হরি বোল এখন শুনি অ্যান্টি বায়োটিক সব আদতে ব্যাক্টিরিয়া ঘটিত রোগের, ভাইরাসের ঔষধ নাই, কেবল সাবানজল।
সাবানজল খুব খানিকটা গুলিয়া খাইতে পারিলে বাঁচিতাম। তাহা ত নয়, ডানপিটে ছেলের দল আবার ভ্যাক্সিন, সাবান আর মোমবাতি গুলাইয়া ফেলিয়া আবার নতুন নতুন কেচ্ছাকীর্তি স্থাপিত করিতেছে।

এপ্রিল ২০২০
তা আশি দশকের ভাইরাল ফিভারেরা হঠাৎ উবিয়া গিয়াছিল। বালককুল যাহারা ৯০ তে জন্মগ্রহণ করিয়াছে তাহারা জন্ম হইতে শুনিয়াছে ভাইরাস একরকম কম্পিউটার ঘটিত বস্তু। বুঝিবা গেম কোন। ইশকুলের ক্লাস ফোরের কম্পিউটার পেপারের প্রশ্নপত্রে আসিত । ওয়াট ইজ ফ্লপি ডিস্ক। ওয়াট ইজ ভাইরাস।
 হঠাৎ এই সব নব্য শিক্ষা, চিনা জাপানি ফ্লু ইত্যাদির ২০১০ পরবর্তীতে ফ্যাশন উঠিল। এইচ ওয়ান এন ওয়ান, জিকা, ইবোলা, নিপা… সার্স। তথাপি আমাদিগের এতটা চেনাশুনা হয়নাই।  ভাইরাস কীরূপ দেখিতে হয়, তাহার লিপিড প্রোফাল কেমন হয়, ছেঁদা করিতে সাবান প্রযোজ্য, আর নতুবা অ্যালকোহল... ভাইরাসের ক্রমবিবর্তন, কনস্পিরেসি থিওরি ইত্যাদি ইত্যাদির এই পাঠ তবু আমরা পাইনাই। ইদানীং মোটকা সোটকা গোলগাল খেলনার ন্যায় ভাইরাসের ছবি দেখিয়া ইহা সার বুঝিয়াছি পৃথিবীতে হিরো নম্বর এক এই নোভেল করোনাই। ইহার মুখচ্ছবি ইকনমিস্ট হইতে লা ভোগ সবের প্রচ্ছদে।
ওয়াটস্যাপ ইউনিভার্সিটির একদল অধ্যাপক এদানী কেবল এই ভাইরাস লইয়াই লিখিতেছেন। সত্যজিত রায় রবীন্দ্রনাথ গান্ধি প্রমুখ ভাইরাস সম্বন্ধে কী কী বলিয়া গিয়াছেন তাহাও লিখিতেছেন খুঁজিয়া খুঁজিয়া। আমরা পড়িয়া ক্ল্যাপ দিতেছি, ক্ল্যাপ।

২০২০ অক্টোবর
 পূজা আসিতেছে। আনন্দময়ীর আগমনে প্রায় সকল পূজার থিমই করোনা-উমা সংবাদ বা করোনাকালিকা… অকরুণা-করোনা নামে নতুন যাত্রাপালা আসিল… সবই ভার্চুয়াল। কলিকাতায় পূজা হইবে ইউটিউবে, যাত্রাপালা ফেসবুক লাইভে। লকডাউন চলিতেছে, চলিতেছে, চলিতেছে। ব্লকবাস্টার শোলের ন্যায় করোনা নামক ছায়াছবির একবার আসন গাড়িয়াছে আর উঠিয়া যাইতেছে না।
এখন ব্যবসা করিতে হইলে সাবানের কোম্পানি খোল। সাবান আর হ্যান্ড স্যানিটাইজারের বাজার ফুলিয়া ফাঁপিয়া উঠিয়াছে। উকিলে আর মামলা লড়িতে যায়না, মামলা কেহই করেনা, কোর্ট ও বসেনা। উকিল সকাল সকাল উঠিয়া গামলায় কেমিক্যাল ঢালিয়া হ্যান্ড ওয়াশ বানায় আর বোতলে ভরে।
প্রকাশকদেরও দিন গিয়াছে। ইত্যবসরে, কলেজ পাড়ার নতুন নাম হইয়াছে টিস্যু পাড়া। বইয়ের দোকানগুলি লাটে উঠিতে উঠিতে ওঠে নাই। প্রতি পুস্তক প্রণেতা এখন  সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলি ব্লিচিং সর্বস্ব জলে চোবাইয়া, কাগজের মন্ডগুলি টিস্যু পেপারে রূপান্তরিত করিতেছেন। নাটক নবেলের বাজার গিয়াছে, কেবল টিস্যুর বাজার আছে।
অনুরূপ, শাড়ি জামা ডিজাইনার কাপড়চোপড়ের দোকানে এখন কেবলমাত্র মাস্ক বিক্রি হয়। পাতলা মাস্ক, মোটা মাস্ক, লাল মাস্ক সাদা মাস্ক, টুপির ন্যায় মাস্ক, রুমালের ন্যায় মাস্ক। নব নব উন্মাদনায় নতুন ধরনের মাস্ক রোজ উৎপাদিত হইতেছে।  সদ্য সকল মুখ ঢাকা মাস্ক বাহির করিয়াছেন তুরি কুমার, বশ্যশাচী মুখোপাধ্যায়রা। মুখমন্ডলে আঁকিবুঁকি, অ্যাবস্ট্রাক্ট চাহিলে তাইই, নাহইলে পৌরাণিক চিত্রও পাইবেন।। ঐশ্বর্য বা দীপিকার মুখচ্ছবি সম্বলিত মাস্ক ও হটকেকের ন্যায় বিক্রয় হইতেছে।
আমলারা ওয়ার্ক ফ্রম হোম করিতেছেন। প্রচুর জুম অ্যাপে মিটিং করিতেছেন। এক এক মিটিং এ পৃথিবী উদ্ধারের এক এক প্রকল্প হইতেছে। অনেকেই ভবিষ্যৎ দিশা বাহির করিতেছেন বাড়িতে বসিয়া। অংকের মডেল পাতিতেছেন, যন্ত্রগণক আজ ভাগ্যগণক হইয়াছে। জ্যোতিষীর স্থান নিয়াছেন এপিডেমিও লজিস্ট ও স্ট্যাটিস্টিকস বিশারদ একযোগে। এক এক মডেলে এক এক ফলাফল আসিতেছে। অ্যালগরিদম পালটাইয়া পালটাইয়া ডেটা চিবাইয়া চিবাইয়া থালার পাশে ছিবড়ার স্তূপ জমিতেছে।
সর্বাধিক ভাল ব্যবসা করিয়া লইয়াছে গায়ক নর্তক নাট্যব্যক্তিত্বের দল। ইহারা লাইভে আসিয়া দেড় হাজার দুহাজার ভিউ পাইয়া তৃপ্ত। টিকিট কাটিয়া হলে আসিত না কেন এত চেলাচেলির দল? ফ্যান ত হদ্দমুদ্দ করিতেছে লাভ সাইন দিতে দিতে। প্রতি লাইভে হৈ হৈ পড়িয়া যাইতেছে।
আর ব্যবসা করিতেছে নতুন অ্যাপের দল।  চালু হইয়াছে চুম্বন অ্যাপ ও আলিঙ্গন অ্যাপ। দুইটি পুতুল ভার্চুয়ালি পরস্পরকে আদর করিতেছে বোতাম টিপিলেই। অনন্তবার আদর করিতেছে, একশোবার চুম্বন করিতেছে। প্রাগৈতিহাসিক ঔপন্যাসিকের ন্যায় গুনিয়া গুনিয়া তেরোটি চুম্বন আঁকিতেছে সারা শরীরে, প্রেমিক প্রেমিকার অথবা ভাইসি ভার্সা।
এইরূপ আরো অনেক অ্যাপ তৈয়ার হইয়াছে। এক অ্যাপে জামাকাপড় খুলিয়া নেওয়ার জনয বোতাম। অন্য বোতামে , ধর্ষণ । আরেক বোতামে, হাত পা কাটিয়া লওয়া এইসব।
সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং এর জন্য সব ধর্ষক বাড়িতে আছে। কেবল এইসব খেলা খেলিতেছে। ফর এ চেঞ্জ , মেয়েগুলি বাঁচিয়া গিয়াছে।
তবে ছিঁচকে চোরেদের সুবিধা হইতেছে। আজিকালি প্রতি অশ্লেষা মঘা অমাবস্যায় ঢং ঢং বাদ্য বাজাইয়া আর লাইট অফ করিয়া প্রদীপ জ্বালাইয়া স্টে হোমের সলিডারিটি জানানো হইয়া থাকে।
 প্রথম প্রথম গ্রিড বসিয়া যাইত, এখন সকলের ন্যায় গ্রিডেরও গার্গল করা অভ্যাস হইয়া গিয়াছে। যতক্ষণ লাইট অফ থাকে চোরেরা কলাটা মূলাটা চুরি করিয়া বেড়ায় । অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়া।

৫।
অক্টোবর ২০৪০
 পৃথিবী হইতে চুম্বন ও আলিঙ্গন দুইটি বস্তু উঠিয়া গিয়াছে। কোন চুম্বন, আলিঙ্গন,  বাস্তবে আর নাই। একদা মাস্টারে কানমলা দিত, এই তথ্য যেমত কেবলই কাহিনি পুস্তকে আছে, কেহই দেখে নাই কোন মাস্টারকে কানমলা দিতে, সেইরূপ , প্রাচীন সাহিত্যে চুম্বন ও আলিঙ্গন আদি শব্দবন্ধ পাওয়া যায়।
করমর্দন নামে একটি শব্দকে রেগুলার ডিকশনারি হইতে সরাইয়া , প্রাচীন ও তামাদি শব্দের ডিকশনারিতে স্থান দেওয়া হইয়াছে।
নমস্কার করিবার  ভারতীয় ও  জাপানি পদ্ধতি এখন সর্ব বিশ্বে গৃহীত। কে না জানে যে জাপানিরা ভারতীয়দের হইতে শিখিয়াছিল। আমাদের বুদ্ধদেব উহাদের শিখাইছিল। আপাতত  ভারতীয়রা অপেক্ষায় আছে, মাউন্ট ফুজি আরেকবার তেরিয়া হইয়া উঠিলে বা আরেকটা জব্বর ভূকম্পে পুরো জাপান দ্বীপপুঞ্জ ডুবিয়া গেলে, ভারতই জগতসভায় রাজত্ব করিবে।
বলিয়াছিলাম কিনা, সর্বশ্রেষ্ঠ বৈদিক যুগ আসিতেছে? শুচিবায়ুগ্রস্তা ঠাকুমাদের লইয়া হাসিঠাট্টা? সারা জগত এখন স্পর্শ ভয়ে কাঁপে, সাবান চৌষট্টি টুকরা করিয়া হাত ধোয়!





ঈশিতা ভাদুড়ী-র কবিতা




এবং ভাইরাস  

ওয়ার্ল্ডোমিটার ওয়েবসাইটে মৃতের সংখ্যা বাড়ছে।
বুকের মধ্যে ধড়ফড় ধড়ফড়...

অন্ধকার রাতে অনিদ্রা-গাছ বেড়ে উঠছে।
এবং পরবর্তী দশ বছরের গায়ে অনিশ্চয়তা ক্রমশ...

কারুর সঙ্গে কারুর দেখা হবে আর কখনও,
কোনো পিকনিকে অথবা শ্মশানেই নাহয়?

ওয়ার্ল্ডোমিটার ওয়েবসাইটে মৃতের সংখ্যা বাড়ছে...
এবং ভাইরাসের আয়ু মানুষের থেকে বেশি...

বুকের মধ্যে ধড়ফড় ধড়ফড়...

প্রবালকুমার বসু-র কবিতা





ভুল হয়ে যায় 


ভেবেছিলে
হয়তো এরকমই ভেবেছিলে
পুরনো বাড়িটা ভেঙে
একেবারে ভেঙে
আবার নতুন করে
সম্পূর্ণ নতুন করে
তৈরি করতে পারলে
আমাদের যাবতীয় বিদ্বেষ ভুলে
আমরা আবার নতুন বাড়িতে
নতুন ডিজাইনের বাড়িতে
নতুন করে থাকা শুরু করতে পারব

আমাদের ভাবনার ভিতর
যে ভুলগুলি লুকিয়ে থাকে
সেই সব ভুল বুঝে উঠতে
বরাবরই ভুল হয়ে যায়
ভুল হয়েই যায়

পঙ্কজ চক্রবর্তী-র কবিতা








উপন্যাস: এক

চোরাশিকারী জানে উপন্যাস আসলে মধ‍্যবিত্ত মানুষের অসহায় যৌনদুপুর ।সব চরিত্র কাল্পনিক। তোমার বুনোফুল ,কাঁটাঝোপে দুএকটি মানুষ আজও গাছের সমান। এই নদী মাটির ভিতর থেকে উঠে এসে লুকিয়েছে ঘুমের কাঁথায় ।মাঝেমধ্যে এই পথে শাপভ্রষ্ট দেবতা আসেন। অদৃশ‍্য সাঁতার তার দেখে ফেলে দেহাতী রমণী। অচেনা পুরুষগন্ধ ,তার পিছুপিছু ছুটেছে হেঁসেল ,স্বর্ণগোধিকা,দুর্বল স্বামীর সন্দেহ। মানুষের ছদ্মবেশে দিবস রজনী। অবলুপ্ত দেবতার থান । যোনির বিছানা পেতে একদিন দেখেছে সে ভোর। ডালে ডালে ডাইনির শতচ্ছিন্ন শাড়ি।দেবতার সন্দেহ হয়।জল খেতে এসে মনে পড়ে অভিশাপ, এমনই সে বাঘিনীর চোখ।



উপন্যাস: দুই

আঘাত তোমার নীচে এই কালো দাগ অন্ধকারে দরজা খুলে দেয়। অনাবশ্যক এক সিঁড়ি। কুকুরের পিছু পিছু মানুষের স্বভাব জ‍্যামিতি। মাটির ভিতর থেকে উঠে আসে ডানা ভাঙা পাখির সন্দেহ।উড়ানের  এই হাওয়া বাতাসে তোমার ব‍্যাকুলতা বালকের স্কুলছুট মলিন জামায় লেগে আছে।  একছুটে দিগন্ত পেরোই। তিনতলা বাড়িটির পিছনে  হঠাৎই আগাছার জঙ্গলে পাড়ার দিদির উন্মুক্ত স্তন দেখে ফেলি। অপরাধমনস্ক হাওয়ায় তোমার শাড়ির মেঘে দুলে ওঠে মেগা সিরিয়াল।হারিয়ে যাওয়ার আগে... এখনও  টের পাই সেই কালো দাগ...

মাথার ভিতর অদৃশ্য মানুষের মিশে যাওয়া ঘামের শরীর

পার্থজিৎ চন্দ-এর কবিতা




ওয়টার লিলি


(উৎসর্গ – ক্লদ মনে)

অরিগ্যামি-সমুদ্রে থেকে বারবার ভেসে উঠেছিল ধূসর ডলফিন
আর বালির ওপর দিয়ে নিজের শরীর ঘষে
ড্রাই-ডকে ফিরে আসছিল বিষন্ন ও মায়াবী জাহাজ
মাতৃমুখী জেলেটির ঘুমে গিঁথে থাকা মাটির নোঙর
এঁকে বেঁকে চলে গেছে নীল জলের ইশারায়

আজ আমি অরিগ্যামি-সমুদ্র থেকে চুপচাপ উপড়ে ফেলি বয়া
এক শূন্যের চারপাশে এরপর দিশাহারা ঘুরতে ঘুরতে
আত্মহত্যা করবে তোমার শরীর

কিন্তু তার আগে তোমার আত্মাকে মুঠো করে ধরে
আমি চলে যাচ্ছি লতাপাতা-ঘেরা নির্জন জলাশয়ে

অরিগ্যামি-ডলফিন, তোমাকে অন্তত একবার আমি এই আলৌকিক জলে
প্রকৃত লিলির নীচে মেরে ফেলতে চাই

পায়েল সেনগুপ্ত-র কবিতা





অপত্য

হাঁটতে হাঁটতে জন্মেছিল মেয়েটা
কোথাও একটু ঝাউপাতা, কোথাও বালি
কোথাও নৌকো আর কোথাও শিকল দেখে
একদিন ভেসে যাওযার সিদ্ধান্ত নিল
সান্ধ্য কোনও রাগের মতোই তার এই চলন গমন
একদিন সমস্ত বাস্তব আর পরাবাস্তব ছাড়িয়ে
কোনও দূরগামী বাতাসের মতো হয়ে গেল
স্থল, জল, হাওয়া মহামারি...
একটা মেয়ে কেবলই একটা মেয়ে
মেয়ে মানেই সে একা এবং শূন্য
বেশ, শূন্যই যদি হবে, তবে অস্তিত্বহীন হোক
একে একে সে ছুড়ে দিল তার সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গ
মায়ের হাত, চোখের জল, প্রেমিকের জরায়ু, আর
বিশ্বাসঘাতকের হৃৎপিণ্ড ফেলে গেল নশ্বরতায়
কোল থেকে শুধু ফেলেনি তার সন্তান
এই মায়া আরও কত কোটি কোটি মেয়েজন্মের
শিকড় পুঁতে দিল স্থল, জল, হাওয়া মহামারি জুড়ে
মেয়েটা জানতেই পারল না....
তার অপত্যরা আজও হেঁটে যায়।

       


অভিজিৎ দত্ত-এর কবিতা




আমাকে জায়গা দেবে
-------------------------------

আমাকে জায়গা দেবে যশোরের সন্ধ্যার ওই মাঠ
যৌথ হরিয়ালি
হৃদয়ের স্মার্ত নীরবতা অগ্নি ও তামসে
একে একে খুলবে কপাট।

অনুপ চণ্ডালের হরিত ভূমায় নেমে
এইসব দীর্ঘ দীর্ঘ জিওল মাঠেরা বাউলকথার মতো
সন্ধ্যারাত্রির আগে আগে ভূ-বিজ্ঞানে
গোপন আত্মপরিচয় লিখে রেখে যাবে।

তারা জানে: অযুত অজাত লুণ্ঠনের দিন, দ্রোহ, ক্ষয়
শেষ হয়ে গেলে, বিনীত সুশীল সম্মানে
মৃত্যুও নিহত এখানে।


একটি অমিথ্যে বিজ্ঞাপন 
-----------------------------------

করোনা ভাইরাস জানে--  চৈত্যকল্পনা ও আগাম-বিষণ্ণতা
বিষয়ে ক'দিন আগে আমার একটি আট ফর্মার কবিতার বই
বেরিয়েছে, যার অক্ষরগুলো পিত্ত অথবা সবুজ রঙের
আর ভাবনাগুলো প্রসন্ন নীল ব্যথাময় শুশ্রূষার।
বলা বাহুল্য, ইদানীং বইটি আমার জীবনচর্যার একমাত্র প্রিল্যুড।

এসব আত্মকবিতা বেগুন ফুলের মতো শান্ত
হাওয়ামোরগের মতো অদৃষ্টের নির্ণয়কারী অথবা বলা যায়
নিমপাতার মতো বায়ুশোধনকারী, পাঠক ছাড়াও
যারা নিজেদের মধ্যে নীরবে নিরন্তর পঠিত হয়ে থাকে।

এই চৈত্রে বাড়ির সামনেটায় কিছু মরশুমি বেগুন
বরবটি টম্যাটো লঙ্কা গাছ লাগিয়েছি
আমার হাতের মুনিরা-আদরে উছলে উঠবে গর্ভের ফসল।
মানুষেরা রাস্তায় আছে, তারা হাঁটছে অনন্তের পথে;
তারাও মানুষ যারা রাস্তায় থাকে, করোনাও জানে।

প্রকাশক সী বুক এজেন্সির কর্ণধার জয়ন্তকে ফোন করলাম
হঠযোগে মাকেও জানালাম: 'জানো, চড়ুই আসছে,
আকাশ বেশ নীল নীল-- গাছপালা কেমন ভেজা ভেজা
করোনার থার্ড স্টেজ এখন, ডিউটিতে বেরোতে হচ্ছে রোজ;
তুমি কেমন আছ মা?'
বুঝলাম মাও সেই আরাধ্যা প্রকৃতিই। নির্ঘুম মধ্যযাম।

প্রভাতী পরিচর্যার সময় আজ আমি একটা ডাঁটো চায়না
বেগুন গাছকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে অনেকক্ষণ অকারণ কাঁদতে দেখলাম!

হিন্দোল ভট্টাচার্য-এর কবিতা






মৃৎফলকের কবিতা 


যদি দুঃখ মরে যায়, কাকে বলব যন্ত্রণার কথা?
আমি তো তেমন কোনও মহাকাল নই
প্রাচীন বেদেনী এক, মন্ত্র পড়ে ঝাপি খুলে দিয়ে
আদিম শ্বাপদ যেন ছুটে আসে বুকের উপরে।
কেন যে বিষাদকথা লিখি এতো, কেন লিখি যম
দেওয়ালে ফাটল ধরে, আকাশে কঙ্কাল হয় গাছ
চাঁদ অহঙ্কারী হয় জোয়ারে-ভাঁটায়…
আমাকে বোঝনি তুমি, তোমাকেও বুঝিনি কখনও
এখন সুন্দর লিখতে ভয় হয়, মিথ্যে কথা লিখে
গুহামানবের শিল্প রচিত হয়নি কোনওদিন
আমি তো কেবল এক অশ্বারোহী, যার
ঘোড়া ছুটে চলে গেছে আগুনের দিকে।

সন্দীপন চক্রবর্তী-র কবিতা






প্রহর, প্রহরগুলি

১.
চারদিক থমকে আছে
কিছু একটা হবে

কী হবেসেটা কেউ বলতে পারছে না

শুধু একটা অন্ধকার সাপ
আছড়েপিছড়ে মুচড়ে উঠছে বারবার

শব্দগুলো ছেঁড়া ফাটা
রক্তের কালো কালো ছোপ

শামুকেরা মুখ বের ক'রে
মেপে নিচ্ছে অনিশ্চিত পারদ

ঘর থেকে বেরোচ্ছে না কেউ

কিছু একটা ঘটবে মনে হয়


২.
মানুষ ভয়ে কুঁকড়ে গেলে
সমস্ত দাপট থেমে যায়।
পৃথিবী খুব শান্ত হয়ে আসে

আচমকা ভেসে ওঠে
নিজের অচেনা মুখ --
সে তখন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে
খানিক বোকার মতো মাথা চুলকায়
খানিক সঞ্চয় করে
কেন করেনিজেও জানে না

কুণ্ডলী পাকিয়ে তারা
নিরর্থ খবর শোনে,
গুজব ছড়ায়।
অল্পস্বল্প ইয়ার্কিও করে

তাদের গায়ের থেকে
ঝিরিঝিরি ঝিরিঝিরি
অনন্ত বাকল ঝরে পড়ে


৩.
তালা খুলে কোনো শব্দ বেরোতে পারে না
বাইরে পুলিশ

ট্রেন বাস ব্যাঙ্ক বা বাজার
এখন সমস্ত বন্ধ

ঘরের মেঝেতে শুধু হাড়গোড়ভাঙা এক অন্ধ আক্রোশ
ড্রপ খায়ড্রপ খেতে থাকে

তারপর একদিন দাঁড়ায় লাইন করে
ছোটবড়ভাঙাএলোমেলো

নিঃশ্বাস নেবার জন্য
ঘুমের মধ্যেও তারা পাশ ফিরে শোয়

এখনও তাদের ছুঁয়ে বেঁচেবর্তে থাকে
কিছু কিছু আহাম্মক বিফল মানুষ


৪.
ছোট্ট এক তুড়িতে ধ্বসে যায়
মানুষের সাজানো এ রঙচঙে বিরাট বাজার
বহুতল দম্ভগুলো ভয়ার্ত গুহা হয়ে ওঠে

হয়তো মানুষ তার কৃতকর্মের জের
অজান্তে বহন করে চলে
প্রজন্ম থেকে আরও প্রজন্মে ছড়িয়ে যায়
মধু মোহ বিষ --
দরজার বাইরে পুলিশ
বসিয়ে সেসব কথা অস্বীকার করে
অথচ গণৎকারে
সারাতে পারে না সেই বিকট অসুখ

অবোধ বা তীক্ষ্ণ ভাবুক
কেউ সে বৃত্তের থেকে বেরোতে পারে না
শুধু সে বৃত্তের
কাঁটাগুলো ধকধক করে ওঠে রাতের দেয়ালে

নিজস্ব খেয়ালে
মানুষ এখন আর চলতে পারে না।
তাকে বুঝে নিতে হয় ভূমি

তার হাতে বেজে ওঠে গ্রহতারাদের ঝুমঝুমি



অদিতি বসু রায়-এর কবিতা




কেউ কোথাও নেই


পথ একা পড়ে আছে

গাজনের মাঠে কাঁদছে চৈত্রমাসের ধুলো

একা একা কে আর কোথায় যেতে পারে, বলো ?

বন্দরের কাল যারা শেষ হবে ভেবেছিল, জাহাজে পা রেখে, 

তারা এখন আমার মতোই বসে আছে ক্যালেন্ডার ভুলে ।

একে কী সত্যিই ভুলে যাওয়া বলে ?

উত্তর জানে না বলে মা, একটু দূরে বসে হাতপাখা খোঁজে



আমাদের এদিকে ঝড় নেই। আমাদের এদিকে থমথমে হয়ে থাকে আকাশ

বাতাস চলে যাওয়ার পরে, মনে হয়, ভুল হয়ে গেছে খুব-

সামান্য কয়েকটা প্রত্যাখ্যান – বাকি রয়ে যাওয়া প্রেম – চুমুর অধুরা কাহিনি

 মনে পড়লে কষ্ট হয়।

 ইদানীং আয়ুর অতলে নেমে যাওয়া দিনগুলো,  দিকচিহ্নহীন

ইশারা ছাড়াই  গাছ খুব হাসে, মাঝারাতে

-      আমাদের ঘুম ভাঙে দেরীতে তাই ভোরের আলো ফিরে যায়

অন্ধকারে ফুল ফোটার অলীক গল্পে, তোমাকে এখনও পেয়ে যাই

মাঝে মাঝে !

দিনগুলো ঘুমোয় না – জাগে না – বসে থাকে

এলোচুলে! নদীর গানের পাশে, একা!

একনজরে

সম্পাদকীয়

একটি বিষয়ে আমাদের সকলের একমত হতেই হবে ভিন্ন মতের ও ভিন্ন রুচির বহুস্তরকে সম্মান জানিয়েও, যে, আমরা এই মুহূর্তে প্রায়শ্চিত্ত করছি। মানুষ...

বেশিবার পড়া হয়েছে যেগুলি