চুয়াং ৎসে : তিনটি টুকরো
শব্দভাবনা
মাছ ধরার জন্য প্রয়োজন হয় মাছধরার জালের, কাজ মিটে গেলে আমরা কি আর জালটাকে মনে রাখি? ভুলে যাই। খরগোশ ধরার জন্য আমরা খরগোশ ধরার ফাঁদ পাতি। খরগোশ ধরা হয়ে গেলে, ফাঁদটিকে গুরুত্ব দেওয়ার আর দরকার আছে কী? শব্দ তার অর্থের কারণে বেঁচে আছে; একবার অর্থ হৃদয়ঙ্গম করতে পারলে, তুমি শব্দকে ভুলে যেতে পারো। কোথায় সন্ধান পাই সেই ব্যক্তির, যিনি শব্দ ভুলেছেন, তার সঙ্গে আমার যে দুটো কথা আছে !
*
বাঁধের ধারে চুয়াং ৎসে
হাও নদীর বাঁধের ধারে এক মনোরম দিন; চুয়াং ৎসে আর তাঁর বন্ধু হুই ৎসে সেখানে বেড়াচ্ছেন। বাঁধের স্বচ্ছ জলে রুপোলী মাছেরা খেলে বেড়াচ্ছে । চুয়াং ৎসে মুগ্ধনয়নে দেখছিলেন সেই দৃশ্য, দাঁড়িয়ে প’ড়ে বন্ধুকে বললেন,‘কি সাবলীল ভঙ্গিতে মাছগুলি সাঁতরে বেড়াচ্ছে দেখুন! একেই বলে মাছের অনাবিল আনন্দ।’
‘আপনি তো আর মাছ নন’, বললেন হুই ৎসে, ‘মাছের আনন্দের বিষয়ে আপনি কী ক’রে জানলেন?
প্রত্যুত্তরে শান্ত কণ্ঠে একটি প্রতিপ্রশ্ন করলেন চুয়াং ৎসে, ‘আপনি তো আর আমি নন। আপনি কী ক’রে জানলেন মাছের আনন্দের বিষয়ে আমি সম্পূর্ণ অজ্ঞ?’
‘অবশ্যই। আমি নিশ্চিত জানি না, কারণ আমি আপনি নই। কিন্তু, এটা অতীব পরিষ্কার যে, যেহেতু আপনি মাছ নন, সেহেতু মাছের আনন্দের বিষয়ে আপনি কিছুই জানেন না!’, বেশ আত্মতৃপ্ত ভঙ্গিতে চুয়াং ৎসেকে জানালেন হুই ৎসে।
কিছুক্ষণ নীরবে পাশাপাশি হাঁটলেন দুই বন্ধু । তারপর, চুয়াং ৎসে সেই একইরকম নিরুত্তাপ কণ্ঠে বললেন,‘প্রসঙ্গটি নিয়ে তলিয়ে ভাবা যাক: যখন আপনি আমায় প্রশ্ন করেছিলেন, মাছের আনন্দ-বিষয়ে আমি কী ক’রে জানলাম, তখন আমার অবগতির কথা আপনি জানতেন, না হলে, ওই প্রশ্নটি আপনি আমায় করতেনই না । নয় কি ? অর্থাৎ, আসলে আপনার প্রশ্নটি ছিল সামান্য অন্যরকম,“মাছের আনন্দের বিষয়ে আমি জানলাম কোন্ উপায়ে?” সেই পুনর্বিন্যস্ত প্রশ্নের উত্তর এবার নিবেদন করি, জলের ধার দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে আমি মাছের আনন্দের বিষয়ে জেনেছি ।’
*
তরবারি-বিষয়ক *
*এটি একটি প্রক্ষিপ্ত রচনা
বহুকাল আগে, চাও প্রদেশে এক প্রবীণ ও অকর্মণ্য শাসক ছিলেন, নাম ওয়েং ওয়াং, যাঁর একমাত্র বিনোদন ছিল তলোয়ার-খেলা । তাঁর সভায় অসিযোদ্ধাদের ভিড় লেগেই থাকত, যে-কোনও সময়ে, দেখা যেত হাজার তিনেক সুদক্ষ সৈনিক ও খেলোয়াড় ভাগ্যোন্নতির আশায় সেখানে ঘোরাঘুরি করছেন। দিনরাত তলোয়ার-খেলা চলছে, ভরা সভায়, অলিন্দে, প্রমোদকাননে, এমন কি রাজপ্রাসাদের প্রশস্ত সিঁড়িতেও, সর্বত্র ; সারা বছর জুড়ে, কত যে রক্ত ঝরত, মৃত্যু হত অবিরাম, তার কোনও হিসেব নেই। তবু প্রভু ওয়েং ওয়াং অতৃপ্ত।
তিন বছর এইভাবে কাটল; ন্যায়বিচার নেই, প্রশাসন ভেঙে পড়েছে, এই অবস্থায় ওয়েং ওয়াং-এর প্রতিপক্ষ ও উচ্চাভিলাষীরা গোপনে মসনদ ওলটাবার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলেন। কথাটা সুযোগ্য রাজকুমারের কানে পৌঁছল। তিনি বিশস্ত রাজকর্মচারীদের সঙ্গে কর্মপন্থা বিষয়ে পরামর্শ করলেন এবং প্রভু ওয়েং ওয়াং-কে যিনি দুর্মতিমুক্ত করতে পারবেন তাঁর জন্য এক সহস্র ভরির রৌপ্যমদ্রার পুরস্কার ঘোষণা করলেন। রাজকর্মচারীরা সকলে একযোগে রাজকুমারকে জানালেন যে একজনই আছেন যিনি এই দুঃসাধ্য কাজ সম্পন্ন করতে পারবেন, চুয়াং ৎসে । এক হাজার ভরি রুপোর মুদ্রা নিয়ে রাজদূত ঘোড়া ছুটিয়ে চুয়াং ৎসে-র কুটিরে উপস্থিত হল । চুয়াং ৎসে একটি মুদ্রাও গ্রহণ না করলেও, নিজেই রাজকুমারের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। দূত তাঁকে তার ঘোড়ায় তুলে নিয়ে দ্রুত ফিরে চলল রাজপ্রাসাদের দিকে।
চুয়াং ৎসে-কে মর্যাদাসহ রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরে নিয়ে যাওয়া হল, কিন্তু লোকলস্কর, আড়ম্বরকে কিছুমাত্র গুরুত্ব না দিয়ে, তিনি সরাসরি রাজকুমারকে প্রশ্ন করলেন,‘আমাকে আপনার কী এমন প্রয়োজন হল রাজকুমার, যে আমার হাতে এক হাজার মুদ্রা তুলে দিতে চাইলেন?’
রাজকুমার সঙ্কোচের সঙ্গে বললেন, ‘আমি শুনেছি আপনি একজন ঋষি। আপনার জন্য ওই অর্থ আমি পাঠাই নি, পাঠিয়েছিলাম আপনার ভৃত্যদের জন্য। ওটি সামান্য এক আনুষ্ঠানিক কৃত্য মাত্র। আপনি অর্থ ফিরিয়ে দিয়েছেন । আমি এ-বিষয়ে আপনাকে আর কী বলি?’
চুয়াং ৎসে বললেন, ‘আপনি চান যে, আমার হাতে ওয়েং ওয়াং-র এই অদ্ভুত ব্যাধির নিরাময় হোক, তা আমি জানি। এবার, ধরুন আমি বিফল হলাম। তখন, আপনি আমাকে নিশ্চিত ভাবে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করবেন। তখন, ওই মুদ্রা আমার কোন্ কাজে লাগবে? আবার ধরুন, আমি যদি সফল হই, তা হলে এই রাজ্যের যে-কোনও সম্পদ, আমি যা চাইব, আপনি নির্দ্বিধায় আমার হাতে তুলে দেবেন। সে ক্ষেত্রেও ওই পুরষ্কার আমার কোনও কাজে লাগবে না।’
রাজকুমার অনুমান করলেন চুয়াং ৎসে-র সহায়তা মিলবে, তাঁকে সতর্ক করার জন্য তিনি বললেন, ‘আপনি হয়তো জানেন, অন্য কারুর সঙ্গে নয়, আমার পিতা কেবল অসিযোদ্ধাদের সঙ্গেই দেখা করেন।’
‘চিন্তা করবেন না, তলোয়ার চালনায় আমি পারদর্শী’,গুরু চুয়াং রাজকুমারকে জানালেন।
‘এ-ছাড়াও, আপনাকে জানাবার একটা বিষয় আছে’, চুয়াং ৎসে-কে আরও সতর্ক ক’রে দিতে চাইলেন রাজকুমার। ‘পিতা যে-সমস্ত অসিযোদ্ধা দেখতে অভ্যস্ত, তাদের পোশাকপরিচ্ছদ অশোভন, প্রত্যেকেরই মাথার চুল ঝাঁকড়া, অবিন্যস্ত, এবং এতই লম্বা যে টুপির নিচ দিয়ে গোছায়-গোছায় বেরিয়ে এসেছে। টুপির আকারও বিচিত্র, টেরছা ভঙ্গিতে মাথা থেকে ঝুলে রয়েছে, টুপির কানা থেকে বিনুনি-করা রুক্ষ সুতোর ট্যাসেলের গুচ্ছ দুলছে, প্রত্যেকের পরনে খাটো মাপের টেলকোট। তাদের চাহনি আর মুখের ভাষা হিংস্র, তাদের আলোচনার একমাত্র বিষয় তলোয়ার-খেলা। পিতা এইরকমই পছন্দ করেন। আপনি যদি এক শিক্ষিত সজ্জনের পরিধানে তাঁর সম্মুখে উপস্থিত হন, ফল বিপজ্জনক হবে।’
‘আমি উপযুক্ত পোশাকেই যাব’, রাজকুমারকে এই আশ্বাস দেবার পর, চুয়াং ৎসে শরীরচর্চা ও অসিচালনার অনুশীলনে মন দিলেন। তিনদিন পর, নিজেকে সম্পূর্ণ প্রস্তুত ক’রে, তিনি ওয়েং ওয়াং-র সম্মুখে হাজির হলেন, সঙ্গে রাজকুমার। সভাগৃহে চুয়াং ৎসে প্রবেশ করা-মাত্র ওয়েং ওয়াং খাপ থেকে নিজের ধারালো তলোয়ারখানা মুক্ত ক’রে তাঁর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন । চুয়াং ৎসে দ্রুত এগিয়ে গেলেন না, ওয়েং ওয়াং-কে কোনওরকম সম্মানজ্ঞাপনও করলেন না ।
‘তুমি যে রাজকুমারের সুপারিশ নিয়ে এখানে এসেছ, তা বুঝতে পারছি,’ হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন ওয়েং ওয়াং, ‘বলো, কী বলবার আছে!’
চুয়াং ৎসে খুব নম্র ভাবে বললেন,‘আমি শুনেছি, হুজু্র তলোয়ার-খেলা খুব উপভোগ করেন। আমি সেই আকর্ষণে এখানে খেলা দেখাতে এসেছি।’ কর্মপ্রার্থীকে পরিমাপ করবার জন্য ওয়েং ওয়াং তাঁর প্রশিক্ষণ বিষয়ে জানতে চাইলেন ।
উত্তরে চুয়াং ৎসে বললেন, ‘দশ পায়ের দূরত্বে আমি যদি একের–পর-এক প্রতিপক্ষের সম্মুখীন হই, তা হলে তাদের একে-একে পরাস্ত করতে-করতে আমি তিন শো মাইলেরও বেশি এগিয়ে যেতে পারার শক্তি ধরি।’
‘শাবাশ!’ জানালেন ওয়েং ওয়াং, ‘এ-রাজ্যে তোমার জুড়ি মেলা ভার হবে ব’লে মনে হচ্ছে।’
চুয়াং ৎসে অবিরাম নিজের বড়াই ক’রে চললেন, ‘আমি যখন লড়াই করি, গোড়ার দিকে মনে হতে পারে আমি দুর্বল । সেইখান থেকে ধাপে-ধাপে আমার আক্রমণ আমি গ’ড়ে তুলি । শুরু করি সবার পরে, শেষ করি সবার আগে! হুজুরের কাছে অনুরোধ, খেলা দেখাবার একটা সুযোগ আমায় দিন!’
ওয়েং ওয়াং উত্তর করলেন, ‘র’সো, র’সো, তোমার সুযোগ আসবে। আমার নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করো।’
যে যোদ্ধারা আগে এসেছিলেন, তাদের মধ্যে সাত দিন ব্যাপী প্রতিযোগিতা শুরু হল। প্রায় ষাট জন প্রতিযোগী হতাহত হবার পর, ওয়েং ওয়াং পাঁচ-ছয়জন প্রতিযোগী বেছে নিয়ে, তাদের পাশের ঘরে অপেক্ষা করার নির্দেশ দিলেন। এইবার, চুয়াং ৎসে-র ডাক পড়ল, ওয়েং ওয়াং হাঁক দিলেন, ‘এইবার তোমার পরীক্ষা শুরু!’
চুয়াং ৎসে এগিয়ে এসে দাঁড়াতেই ওয়েং ওয়াং তাঁকে প্রশ্ন করলেন,‘একটা কথা, অস্ত্রের দৈর্ঘ্যে সম্পর্কে তোমার কি কোনও পছন্দ-অপছন্দ আছে?’
‘কিছুমাত্র না’, জানালেন চুয়াং ৎসে। ‘তবে, জানিয়ে রাখি, আমার তরবারির সংখ্যা তিন। তাদের মধ্যে একটি বেছে নেওয়ার জন্য হুজুরকে আমি অনুরোধ করব, সেই তরবারি দিয়ে শুরু হবে আমার পরীক্ষা!’
‘তাই নাকি? বাহ্ বেশ তো! বিস্তারিত বলো দেখি! কোন্ তিনরকম তলোয়ারের খেলা তুমি জান?’,ওয়েং ওয়াং কৌতূহলী হয়ে উঠলেন ব’লে মনে হল।
চুয়াং ৎসে বললেন, ‘সর্বাগ্রে স্বর্গপুত্রের তরবারি, তারপর রাজন্যবর্গের তরবারি, সবার শেষে সাধারণের তরবারি ।’
‘স্বর্গপুত্রের তরবারি কী বস্তু ?’
‘ওই তরবারির অগ্রভাগের তীক্ষ্ণ বিন্দুতে, ইয়েন উপত্যকা অধিষ্ঠিত । দুই ফলার এক দিকে, চীন-এর সুমহান প্রাচীর, অন্যদিকে চী ও তাই পর্বতমালা । তাঁর পৃষ্ঠদেশ, চিন এবং ওয়ে । ওই তরবারির বাঁট, চাউ এবং সুঙ । ওঁর খাপের একদিক, হান এবং অন্যদিক উই । বর্বর উপজাতিরা চারপাশে তাঁকে ঘিরে রয়েছে, তাঁকে বেষ্টন ক’রে রেখেছে চারঋতু। পো সাগরের উত্তাল তরঙ্গ সদাসর্বদা তাঁকে রক্ষা করে, তাঁর কটিবন্ধ চাঙ পর্বত। ওই তরবারি পঞ্চভূতের নির্দেশ মান্য করেন, তাঁদেরই ইচ্ছানুসারে তরবারি হতে কখনও করুণা ঝ’রে পড়ে, আবার অন্য কখনও, দণ্ডাদেশ। পুরুষ ও প্রকৃতির লীলা হতে এই তরবারির কর্মকুশলতা আহরিত । গ্রীষ্মকাল ও বসন্তে তিনি যুগপৎ সজাগ ও নিশ্চল অবস্থায় থাকেন, শরতে ও শীতে তিনি সচল । তাঁকে সম্মুখে চালনা করুন, সামনে এসে দাঁড়াবার স্পর্ধা করবে না কেউ । ঊর্ধ্বে তুলে ধরুন তাঁকে, তিনি অবস্থান করবেন সবার শীর্ষে । নিন্মে নামিয়ে ধরুন, তিনি স্পর্শ করবেন অতল । তাঁকে চক্রাকারে ঘোরান, সে-ঘূর্ণির বাইরে কোনও ঘূর্ণি সৃষ্টি করা অসম্ভব! তাঁকে ঊর্ধ্বে চালনা করুন, তিনি ভাসমান মেঘ দ্বিখণ্ডিত ক’রে ফেলবেন। নিন্মে চালনা করুন তাঁকে, তিনি ধরিত্রীর শিরা-উপশিরা ছেদ করতে পারঙ্গম। তাঁর ফলা একবার ঝল্সে উঠলেই পৃথিবীর নৃপতিরা তাঁর সম্মুখে নতজানু হন । তিনি স্বর্গপুত্রের তরবারি!’
চুয়াং ৎসে অবশেষে থামলেন। আত্মবিস্মৃত ওয়েং ওয়াং নিথর অবস্থায় তাঁর সিংহাসনে ব’সে রইলেন। কিছুক্ষণ পরে তাঁর সম্বিৎ ফিরল, তিনি মৃদুস্বরে চুয়াং ৎসে-কে জিজ্ঞাসা করলেন,‘আর, রাজন্যবর্গের তরবারি?’
চুয়াং ৎসে-এর প্রবল ভাবাবেগও ততক্ষণে কিছুটা প্রশমিত হয়েছে, তিনি আবার শান্ত কণ্ঠে বলতে শুরু করলেন, ‘ওই তরবারির অগ্রভাগের তীক্ষ্ণ বিন্দুতে বিচক্ষণ ও নির্ভীক ব্যক্তিগণ অবস্থান করেন। দুই ফলার এক দিকে, নীতিপরায়ণ এবং অন্যদিকে আন্তরিক মানুষ উপবিষ্ট। তাঁর পৃষ্ঠদেশে অবস্থান করেন গুণী ও বিত্তবান। বিশ্বাসভাজন ও প্রাজ্ঞ মানুষ রয়েছেন ওই তরবারির বাঁটে; অসমসাহসী যে ব্যক্তিগণ জয় করেছেন মৃত্যুভয়, তাঁরা ওই তরবারির খাপে অবস্থান করছেন। অসিচালনার সময়ে স্বর্গপুত্রের তরবারির মতোই তাঁর আচরণ, তাঁকে সম্মুখে চালনা করুন, সামনে এসে দাঁড়াবার স্পর্ধা করবে না কেউ। ঊর্ধ্বে তুলে ধরুন তাঁকে, তিনি অবস্থান করবেন সবার শীর্ষে। নিন্মে নামিয়ে ধরুন, তিনি স্পর্শ করবেন অতল। তাঁকে চক্রাকারে ঘোরান, সে-ঘূর্ণির বাইরে কোনও ঘূর্ণি সৃষ্টি করা অসম্ভব! ঊর্ধ্বলোক হতে তিনি মার্গদর্শন লাভ করেন, চন্দ্রসূর্য ও আকাশভরা তারা তাঁকে পথ দেখায়। পৃথিবীর এই স্থাবর চতুষ্কোণ হতে তিনি শক্তিসঞ্চয় করেন, ঋতুচক্রের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা ক’রে চলেন। মধ্যবর্তী স্তরে মানুষের সদিচ্ছা অনুসারে তিনি নিজেকে সুবিন্যস্ত ক’রে নেন, যাতে চতুর্দিশায় এক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তাঁকে একবার চালনা করলে বজ্রনির্ঘোষের অভিঘাত সৃষ্টি হয়। দেশের চারপ্রান্তের অভ্যন্তরে এমন কেউ নেই, যিনি তাঁর প্রতি অনুগত নন। তিনি রাজন্যবর্গের তরবারি।’
কথা শেষ হলে ওয়েং ওয়াং আবার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘সাধারণের তরবারি কী?’
‘সাধারণের তরবারি যারা ব্যবহার করে তাদের পোশাকপরিচ্ছদ অশোভন, প্রত্যেকেরই মাথার চুল ঝাঁকড়া,অবিন্যস্ত, এবং এতই লম্বা যে টুপির নিচ দিয়ে গোছায়-গোছায় বেরিয়ে এসেছে। টুপির আকারও বিচিত্র, টেরছা ভঙ্গিতে মাথা থেকে ঝুলে রয়েছে, টুপির কানা থেকে বিনুনি-করা রুক্ষ সুতোর ট্যাসেলের গুচ্ছ দুলছে, প্রত্যেকের পরনে খাটো মাপের টেলকোট। তাদের চাহনি আর মুখের ভাষা হিংস্র, তাদের আলোচনার একমাত্র বিষয় তলোয়ার-খেলা। সংঘাতের সময়ে সাধারণের তরবারি ঊর্ধ্বে চালনা করলে প্রতিপক্ষের গলামাথা, এবং নিম্নে চালনা করলে প্রতিপক্ষের যকৃৎ কেটে দ্বিখণ্ডিত হয়। এই হল সাধারণের তরবারি। সাধারণের তরবারি যারা ব্যবহার করে তাদের দশা অনেকটা শিকারী মোরগের লড়াইয়ের মতো, যে কোনওদিন যবনিকা পতন হতে পারে। তারা রাজার কোনও কাজে লাগে না।’ এরপরেও ওয়েং ওয়াং-এর উদ্দেশে আরও ক’টি কথা বললেন চুয়াং ৎসে, ‘আপনি রাজা, বিপুল ক্ষমতা আপনার, স্বর্গপুত্রের তরবারি ধারণ করা আপনাকেই সাজে, অথচ দেখুন, সাধারণের তরবারি ধারণ করার অযোগ্য কাজ আপনি ক’রে চলেছেন। আমার আক্ষেপ আমি প্রকাশ করলাম।’
প্রতিযোগিতার শেষে ভোজসভার আয়োজন করা হয়েছিল। অসিযুদ্ধের কোনও প্রতিযোগিতা না হলেও, ওয়েং ওয়াং-র নির্দেশে ভোজসভা শুরু হল। তিনি নিজে্র হাতে চুয়াং ৎসে-কে খাদ্যপরিবেষণ করলেন। চুয়াং ৎসে-র থালা খালি হবার আগেই তিনি বারংবার নিজের আসন ত্যাগ ক’রে অতিথি সৎকারের উদ্যোগ নিলেন। চুয়াং ৎসে তাঁকে বললেন, ‘আপনার আসন গ্রহণ করুন, মহারাজ, শান্ত হোন । তরবারির বিষয়ে আমার আর কিছু বলবার নেই।
ভোজসভার শেষে চুয়াং ৎসে রাজপ্রাসাদ থেকে বিদায় নিলেন। ওয়েং ওয়াং নিজের মহলে ফিরে গেলেন। পরের দিন আবার রাজসভা বসল কিন্তু সকলে এই লক্ষ ক’রে বিস্মিত হলেন যে, ওয়েং ওয়াং-র আসন শূন্য । কেবল ওইদিন নয়, তিন মাস তাঁকে সভার ত্রিসীমানায় দেখা গেল না। অসিযোদ্ধারা আগের মতোই প্রত্যহ রাজসভায় আসতেন এবং নিজেদের মধ্যে অনুশীলন করতেন, ক্রমে তাঁরাও বুঝতে পারলেন যে তাঁদের সুদিন ফুরিয়েছে। সভাসদদের মধ্যে কেউ-কেউ বলেন, ওয়েং ওয়াং-র পরিবর্তনে হতাশ হয়ে তাঁরা যে-যার গ্রামে ফিরে গেলেন। কেউ-কেউ বলেন, ওই রাজপুরীতে্ তাঁরা সকলেই একে অপরের হাতে, প্রাণ হারান।
*
[ঋণস্বীকার: ‘চাইনিজ় উইজ়ডম্’, সম্পাদনা: জেরাল্ড বেনেডিক্ট এবং ‘চুয়াং ৎসে:মিস্টিক, মরালিস্ট অ্যান্ড সোশাল রিফর্মার’ সম্পাদনা: হরবর্ট এ. গাইলস । লেখকের পরিচিতি নিয়ে বিস্তর কলহবিবাদ থাকলেও ধ’রে নেওয়া হয়, চুয়াং ৎসে-র(মতান্তরে ঝুয়াংঝি), খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে হোনান অথবা অনহুই জেলার অন্তর্গত মেং নগরে জন্মেছিলেন। তাঁর আসল নাম চুয়াং চাউ, ‘ৎসে’ একটি সাম্মানিক উপাধি,‘চুয়াং ৎসে’-র অর্থ ‘গুরু চুয়াং’।তাও/ডাও ধর্মের তিন স্থপতির মধ্যে তিনি একজন, অন্যরা হলেন যথাক্রমে লাও ৎসে ও লিয়েহ ৎসে। প্রসঙ্গত, চুয়াং ৎসে-র বন্ধু, এবং এক দিক থেকে বিচার করতে গেলে প্রতিপক্ষ, হুই ৎসু-কে হেয়জ্ঞান করা সমীচীন হবে না। তিনিও একজন ‘ৎসে’।]
পুনর্লিখন : গৌতম বসু
লিয়েহ ৎসে : দু’টি টুকরো
স্বর্গ ও মর্ত্য বিষয়ে চুয়াং ৎসে ও লিয়েহ ৎসে
চী প্রদেশের এক ব্যক্তি আহারনিদ্রা ত্যাগ করলেন; তাঁর একটাই দুর্ভাবনা, যে-কোনও মুহূর্তে আকাশ ভেঙে পড়তে পারে পৃথিবীর ওপর, এবং স্বভাবতই, তখন পৃথিবীও চুরমার হয়ে আরও নিচে তলিয়ে যাবে। এই ভয়ানক অবস্থায়, ভদ্রলোকের প্রশ্ন, তাঁর শোয়াবসার জায়গার কী বন্দোবস্ত হবে? অনেকে অনেক ভাবে প্রবোধ দেবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু কারুর যুক্তিতেই তেমন জোর না থাকায়, সকলকেই সহজে হারিয়ে, ভদ্রলোক আরও মন খারাপ ক’রে ব’সে রইলেন, তাঁকে কোনওভাবেই অবসাদমুক্ত করা গেল না। অবশেষে, এক তরুণের কথায় তিনি যেন সামান্য ন’ড়ে চ’ড়ে বসলেন, সে তাঁকে বোঝাল, ‘দেখুন, স্বর্গ জায়গাটা জমাট বায়ুস্তর বই অন্য কিছু নয়, এমন কোনও জায়গা সেখানে নেই, যেখানে বায়ু অনুপস্থিত। ভেবে দেখুন, আপনি তো সেইরকম একটা বায়ুমণ্ডলে আছেন, দিব্যি হাঁটাচলা করছেন, শরীর বেঁকাচ্ছেন এদিক থেকে ওদিক, লম্বা শ্বাস নিচ্ছেন, ছাড়ছেন। আপনি স্বর্গেই আছেন, বলা যায়! আপনার চারপাশের বায়ুমণ্ডল কি ভেঙে পড়ছে? কেন অযথা চিন্তাভাবনা করছেন?’
কিছুক্ষণ চুপ ক’রে রইলেন চী প্রদেশের সেই ভদ্রলোক, ভাবলেন, ‘সত্যিই তো, আমি এখন যেখানে আছি, কই সেটা তো ভেঙে পড়ছে না!’ পরক্ষণেই নতুন প্রশ্নের উদয় হল তাঁর মনে, যুবককে তিনি জানালেন,‘বেশ, বায়ুস্তর ভেঙে পড়ছে না, এটা না হয় দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু, স্বর্গ যে কেবলই জমাট বায়ুস্তর, এটা কোনওমতেই মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। যদি তাই হতো, একা স্বর্গলোক এতগুলো তারা, এবং চন্দ্রসূর্য একসঙ্গে ধ’রে রাখতে পারত না, সেগুলো টুপ্ টুপ্ ক’রে খ’সে পড়তই।’
যুবকও কম তৎপর নয়, তৎক্ষণাৎ সে ব’লে উঠল, ‘ওগুলো তো আলো! বাতাসেরই মতো বলতে পারেন!ওরা প’ড়ে গেলেও কারুর কোনও শারীরিক ক্ষতি হবে না।’
‘আর পৃথিবীর ধ্বসে পড়ার ব্যাপারটা?’
যুবক বলল,‘পৃথিবী জমাট মাটি; উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম―চার প্রান্তে ছড়িয়ে রয়েছ মাটি, কোথাও এতটুকু ফাঁক নেই। আপনি সেই মাটির ওপর হাঁটছেন, দাঁড়িয়ে পড়ছেন, পা দিয়ে ধুপধাপ শব্দ করছেন। মাটি ধ্বসে পড়ার কথা উঠছে কোথা থেকে?’
অবশেষে ভদ্রলোক শান্ত হলেন এবং বলা বাহুল্য, তাঁর পরিবারের লোকজন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। যুবকের বিবেচনাবুদ্ধির সুনাম শহরে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল।
এক সময়ে এই বৃত্তান্ত স্বয়ং চুয়াং ৎসে-র কানে পৌঁছল। তিনি মৃদু হেসে বললেন,‘রামধনু, মেঘমালা এবং কুয়াশা, ঝড় এবং বাতাস, ঋতুচক্র ― এগুলি সবই স্বর্গলোকের পুঞ্জীভূত বায়ুর বিভিন্ন আকার। পাহাড় ও পর্বত,নদী ও সাগর, ধাতু ও পাথরখণ্ড, আগুন ও কাঠ, এগুলি সবই ভূখণ্ড থেকে উৎপন্ন। এরা প্রত্যেকে অন্তরীক্ষ ও ধরণীর বিভিন্ন অংশের খণ্ড, এই সত্য জেনেও, কীভাবে বলি যে, তা ধ্বংস হবে না? অস্তিত্বের বিচারে সর্ববৃহৎ, ওই মহাশূন্য ; স্বর্গ ও মর্ত্যলোক তার ক্ষুদ্রাংশ মাত্র। সন্দেহ নেই, সুদীর্ঘ সময় অতিবাহিত হবার পর, উভয়েরই অবসান হবে, এবং এ-ব্যাপারেও সন্দেহ নেই যে, কবে তা ঘটতে চলেছে তা এখনই নিরূপণ করা সহজ নয়। তাদের বিনাশ নিয়ে এখনই আতঙ্কিত হওয়া অপ্রাসঙ্গিক, কিন্তু একই সঙ্গে, কেউ যদি মনে করেন সৃষ্টি অক্ষয়,তা হলে, আমাদের আপত্তির কথা আমাদের জানিয়ে রাখতে হবেই। স্বর্গ ও মর্ত্যের বিনাশ যেহেতু সন্দেহাতীত, সেহেতু এমন একটা দিন আসবেই যেদিন তারা উভয়ই বিলুপ্ত হবে। সেই সময়ে আমরা যদি এখানে উপস্থিত থাকি, তা হলে আমাদের দুর্ভাবনা কি খুব অমূলক?’
ঘটনাচক্রে, লিয়েহ ৎসে-ও ওই একই ঘটনার বিষয়ে জানতে পারলেন, এবং তিনিও মৃদু হাসলেন, বললেন, ‘স্বর্গ ও মর্ত্য একদিন ধ্বংস হবেই, এবং অপরদিকে, তারা কোনওদিনই ধ্বংস হবে না ― উক্তি দু’টিই নির্বুদ্ধিতার ফল। তারা ধ্বংস হবে, না চিরকাল অক্ষয় থাকবে, তা আমরা সঠিক ভাবে কোনওদিনই জানতে পারব না। একদিক থেকে যদি একরকম অভিমত পাওয়া যায়, অপরদিকে পাওয়া যাবে ঠিক এর বিপরীতমুখী অভিমত। যেমন, এটা তো আর অস্বীকার করা যায় না যে, যাঁরা জীবিত তাঁরা মৃতাবস্থা সম্পর্কে অবহিত নন, আবার, যাঁরা মৃত, জীবিত থাকার বিষয়ে তাঁদের কোনও ধারণাই নেই। আমরা যখন কোথাও প্রবেশ করি, তখন আমরা জানি না, পূর্বেই কারা–কারা সেখানে ঘুরে গেছেন, আবার, সেখান থেকে আমরা যখন প্রস্থান করি, তখন আগামী দিনে সেখানে কারা আসবেন, তা আমাদের অজানাই রয়ে যায় । সৃষ্টি অক্ষয়, না ভঙ্গুর, এ-নিয়ে আমরা কেন ভাবব?’
*
কাঠুরিয়ার স্বপ্নদর্শন
চেং প্রদেশের এক কাঠুরিয়া, নিজের কুটিরের জন্য জ্বালানী কাঠের সন্ধানে জঙ্গলে ঘুরছিল, হঠাৎ তার সামনে ভয়ানক ভীত এক হরিণ এসে উপস্থিত। অসহায় হরিণটিকে সে তৎক্ষণাৎ তীরবিদ্ধ ক’রে বধ করল বটে, কিন্তু মৃত জীবটিকে নিয়ে কী করবে বুঝতে পারল না, কারণ তার আশু প্রয়োজন খাদ্যের নয়, কাঠের। অগত্যা জঙ্গলের মধ্যেই খানাখন্দ খুঁজতে-খুঁজতে, একটা পছন্দসই জায়গা পাওয়া গেল। সেইখানে গাছের ভাঙা ডাল, শুকনো পাতা দিয়ে সযত্নে হরিণটিকে ঢেকে রেখে, সংগৃহীত কাঠের গোছা মাথায় নিয়ে সে বাড়ির পথ ধরল, ভাবখানা এই যে, আমার হরিণ কেউ চুরি করতে পারবে না, বাকিটা কাল দেখা যাবে। কাঠুরিয়া অন্যমনস্ক প্রকৃতির মানুষ, বাড়ি ফিরতে-ফিরতে ঘটনাটি সে সম্পূর্ণ ভুলে গেল। পরের দিন অলস মনে স্মৃতি রোমন্থন করতে-করতে হঠাৎ তার মনে প’ড়ে গেল শিকারের কথা। অল্প কথায় বৌকে গতকালের ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়েই সে দৌড়ল জঙ্গলের দিকে।
কাঠুরিয়া জঙ্গলের ভিতরে পায়ে-চলা পথ ধ’রে হাঁটছে আর বিড়–বিড় ক’রে নিজের মনে ব’লে চলেছে,‘তারপর ডান দিকে ঘুরে ঢালু জায়গাটায় এলাম, রাশি-রাশি শুকনো ফুল পড়েছিল, আরও এগিয়ে গেলাম, এবার বাঁদিকে বেঁকলাম, বাঁদিকে না ডানদিকে? তারপর, তারপর ...’। সবকিছু আরও অস্পষ্ট, আরও ধোঁয়াটে হতে লাগল। অবশেষে, কাঠুরিয়া ক্লান্ত হয়ে খালি হাতে বাড়ি ফিরে এল, নিজেকে বোঝাল, পুরোটাই স্বপ্ন ছিল বোধহয়, ঐ জঙ্গল, ভয়ে কাঠ হয়ে-যাওয়া ঐ হরিণ! হরিণ হারাবার কোনও দুঃখই অবশিষ্ট রইল না কাঠুরিয়ার মনে, কারণ সমস্তই তো স্বপ্ন।
ওদিকে একটা চোরও ঘুরছিল জঙ্গলে, সে লুকিয়ে-লুকিয়ে কাঠুরিয়ার পিছু-পিছু যেতে- যেতে তার সব বিড়বিড়ানি শুনতে পেল। কাঠুরিয়া জঙ্গল থেকে বেরিয়ে যাওয়া-মাত্র সে ফিরে গেল সেখানে, কাঠুরিয়ার বিবরণ পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসরণ ক’রে লুকনো হরিণের ঢিবিতে সটান পৌঁছে গেল! কাঁধের দু–দিকে হরিণটাকে ঝুলিয়ে মহানন্দে নিজের বাড়ি ফিরল সে, বৌকে বোঝাল, ‘কাঠুরিয়া স্বপ্ন দেখেছিল যে সে একটা হরিণ শিকার করেছে, কিন্তু হরিণটাকে কোথায় রেখেছে, কিছুতেই তার আর সে-কথা মনে পড়ল না। আমি খুঁজে পেলাম সেই হরিণ! এর থেকে স্পষ্ট প্রমাণ মিলছে যে, কাঠুরিয়ার স্বপ্ন সত্যি।’
তার বৌ খুব বুদ্ধিমতী, সে বলল, ‘তা কেন হবে গো, স্বপ্নটা তুমিই দেখেছিলে। স্বপ্নে তুমি এক কাঠুরিয়াকে দেখেছিলে যে একটা হরিণ শিকার করেছে। কাঠুরিয়াকে এখন দেখা যাচ্ছে না বটে, কিন্তু হরিণটা তো আছে ! তার মানে, স্বপ্নটা তোমার এবং সেটা সত্যি।’
চোর সহজসরল মানুষ, এত জটিলতা তার মোটেও পছন্দ নয়। সে জানাল, ‘একটা হরিণ পাওয়া গেছে, সেটাই বড় কথা । স্বপ্ন কাঠুরিয়ার না আমার, জেনে আমার কী লাভ?’
সেই রাতে কাঠুরিয়া একটা দীর্ঘ স্বপ্ন দেখল। কোথায় সে শিকার লুকিয়ে রেখেছিল, তারপর কী–কী হল, কে এল, মাটি থেকে কী খুঁড়ে বার করল, কোথায় নিয়ে গেল তার শিকার, সব যেন পর-পর এক জাদুলণ্ঠনে ভেসে উঠতে লাগল! সেই অদ্ভুত স্বপ্নের পিছু-পিছু ছুটে কাঠুরিয়া পৌঁছে গেল চোরের কুটিরে। কাঠুরিয়া তার শিকার ফিরিয়ে দেবার দাবি জানাল, বিস্তর ঝগড়াঝাঁটিতে মুখর হল পাড়া, কিন্তু কোনও ফল ফলল না। অবশেষে রাগে, দুঃখে কাঠুরিয়া আদালতের দ্বারস্থ হল।
প্রধান বিচারপতি দু-পক্ষের জবানবন্দি মনোযোগ সহকারে শুনলেন, তারপর কাঠুরিয়াকে বললেন, ‘প্রথম কথা, আপনি হরিণ বধ করলেন কিন্তু ভুল ক’রে ভেবে বসলেন ওটা একটা স্বপ্ন । দ্বিতীয় কথা, স্বপ্নের মধ্যে হরিণটাকে আপনি খুঁজে পেলেন বটে কিন্তু, এবার ভুল ক’রে ভেবে বসলেন ওটা বাস্তব। অন্য ব্যক্তি আপনার হরিণ নিয়ে চম্পট দিলেন, এবং, এখন, আপনার মালিকানাই তিনি অস্বীকার করছেন। তাঁর গৃহিণী বলছেন, মানুষ এবং হরিণ, উভয়ের অস্তিত্ব কেবল স্বপ্নে, প্রকৃতপক্ষে শিকারের ঘটনাটিরই কোনও বাস্তব অস্তিত্ব নেই। একটিই বাস্তব এখন আমার সামনে, এই হরিণ। আমার মনে হয়, যিনি হরিণ শিকার করেছিলেন, এবং, জঙ্গল থেকে হরিণটাকে যিনি উদ্ধার করেছিলেন, তাঁরা হরিণটাকে সমান-সমান ভাগ ক’রে নিলে সব দিক থেকে ভাল হয়।
চেং প্রদেশের ভূস্বামীর সভায় বিচারপতির রায়ের খবর পৌঁছল।ভূস্বামী কৌতূহলভরে তাঁর
প্রিয় সভাসদের দিকে ঝুঁকে প’ড়ে, নিচু স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন,‘পুরোটাই বিচারপতির স্বপ্নদর্শন নয় তো?’
ঘটনার বিবরণ এবং বিচারপতির সুচিন্তিত রায়ের সংবাদ চেং প্রদেশের বাইরে ছড়িয়ে প’ড়ে, অবশেষে দেশের রাজধানীতে প্রবেশ করল। মন্ত্রীসভার পক্ষ থেকে বাদী ও বিবাদী পক্ষের সমস্ত জবানবন্দি এবং বিচারপতির রায় স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর বিবেচনার জন্য নিবেদন করা হল। মহামান্য প্রধানমন্ত্রী অভিমত প্রকাশ করলেন, ‘কোন্টা স্বপ্ন আর কোন্টা স্বপ্ন নয়, এ-ক্ষেত্রে তা নির্ধারণ করা আমার সাধ্যাতীত। আমি যতদূর বুঝি, ঘুম এবং জাগরণ পৃথক করতে পারতেন কেবল পীতবর্ণ সম্রাট এবং মহাজ্ঞানী কনফিউসিয়াস, কিন্তু, আমাদের দুর্ভাগ্য তাঁরা কেউই আর ইহজগতে নেই। আপাতত, আমি সম্মানীয় বিচারপতির রায়ের সঙ্গে সহমত প্রকাশ করলাম।’
*
[ঋণস্বীকার: ‘দ্য বুক অফ্ লিয়েহ ৎসে’, সম্পাদনা : এ. সি. গ্রেহ্যাম। লিয়েহ ৎসে সম্পর্কে প্রাপ্ত তথ্য অপ্রতুল, এমনই যে, অনেকে ধ’রে নিয়েছেন বাস্তব জগতে তাঁর কোনও অস্তিত্বই ছিল না, তিনি চুয়াং ৎসে-র সৃষ্ট এক কাল্পনিক চরিত্র মাত্র। লিয়েহ ৎসে-র লেখায় কখনও বাস্তব প্রবেশ ক’রে স্বপ্নের জগতে, আবার কখনও স্বপ্ন হয়ে ওঠে কঠিন বাস্তব। তাঁর লিখনভঙ্গিমাই লেখকপরিচয়ে এই বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে কি না, কে বলতে পারেন! একটি বিকল্প হিসেবে ভেবে নেওয়া যেতে পারে, তিনিও খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে হোনান জেলার অন্তর্গত ঝেং প্রদেশে জন্মেছিলেন এবং মধ্যবয়স পর্যন্ত প্রতিবেশীদের বাইরে তাঁকে কেউই চিনতেন না, যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষপীড়িত দেশে তাঁকে এ-জেলায় ও-জেলায় ঘুরে বেড়াতে হয়েছে। আজ সে পরিস্থিতি নেই, তাও/ডাও ধর্মের তিন স্থপতির মধ্যে তাঁর স্থান সংশয়াতীত, অন্যরা হলেন যথাক্রমে লাও ৎসে ও চুয়াং ৎসে। মানুষের বিশ্বাস, লিয়েহ ৎসে বাতাসের পিঠে চ’ড়ে বেড়াতেন। ]
পুনর্লিখন : গৌতম বসু